বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশের চলচ্চিত্র

শৈবাল চৌধূরী | সোমবার , ২৯ নভেম্বর, ২০২১ at ৮:৫৬ পূর্বাহ্ণ

১ম পর্ব

তরুণ বয়সে বঙ্গবন্ধু যখন (১৯৪২ সাল) কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে পড়তেন এবং বেকার হোস্টেলে থাকতেন, তখন এ উপমহাদেশে চলচ্চিত্র শিল্প রীতিমতো প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে। কলকাতায় তখন ম্যাডান পিকচার্স, নিউ থিয়েটার্স, ভারতলক্ষী পিকচার্সসহ আরো অনেক চিত্র প্রতিষ্ঠানের রমরমা অবস্থা। বলতে গেলে কলকাতা তখন পুরো দক্ষিণ এশিয়ার চলচ্চিত্র জগতকে নেতৃত্ব দিচ্ছে।
সে সময়ে বঙ্গবন্ধু কলকাতায়। লেখাপড়ার পাশাপাশি রাজনীতিতেও সক্রিয় হচ্ছেন ছাত্র রাজনীতিতে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে। কিন্তু পরবর্তীকালে চলচ্চিত্রের প্রতি তাঁর আগ্রহের দিকটি লক্ষ্য করে আমার মনে হয়, কলকাতায় থাকাকালীন তিনি সিনেমার প্রতিও উৎসাহী ছিলেন। যদিও এ বিষয়ে সুস্পষ্ট কিছু জানা যায় না। কিন্তু অনুমানটি মনে হয় অমূলক কিছু নয়।
বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের প্রাতিষ্ঠানিকতার সূচনা বঙ্গবন্ধুর হাত ধরে। এই সূচনার নেপথ্যে ছিল তাঁর প্রত্যক্ষ ভূমিকা। অবশ্য এদেশের চলচ্চিত্রের সূচনাটি আরো আগের। যদিও সেটা ছিল অপ্রাতিষ্ঠানিক ও সৌখিন।
ঢাকার নবাব পরিবারের উদ্যোগে এদেশের চলচ্চিত্র নির্মাণের শুরুটা হয় ১৯৩১ সালে ‘দি লাস্ট কিস’ নামের একটি নির্বাক ছবি নির্মাণের মধ্য দিয়ে। ১২ রীলের এই ছবির বাংলা, উর্দু ও ইংরেজিতে সাব টাইটেল করা হয়। ১৯৩১ সালের শেষের দিকে ছবিটি ঢাকার তৎকালীন মুকুল (পরবর্তীকালে আজাদ) প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায় এবং অত্যন্ত সফলভাবে মাসব্যাপী প্রদর্শিত হয়।
তবে তারও আগে ঢাকায় চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রচেষ্টা শুরু হয় নবাব পরিবারেরই উদ্যোগে। ১৯২৭-২৮ সালে ‘সুকুমারী’ নামে একটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি নির্মিত হয় ঢাকায় সম্পূর্ণ সৌখিন ও পরীক্ষামূলকভাবে। চাররীলের এই ছবিটি কোনো সিনেমা হলে প্রদর্শিত হয়নি। এটি ঘরোয়াভাবে প্রদর্শিত হতো। সেদিক থেকে ‘দি লাস্ট কিস’ ছিল অনেকটাই পেশাদারী।
‘সুকুমারী’ ও ‘ দি লাস্ট কিস’ দুটি ছবিরই প্রযোজক নবাব পরিবার ও পরিচালক ছিলেন অম্বুজ কুমার গুপ্ত। অম্বুজ গুপ্ত ছিলেন সে সময়কার ঢাকার একজন বিশিষ্ট ক্রীড়াবিদ ও নাট্য পরিচালক।
১৯৫৬ সালে মুক্তি পায় এদেশের প্রথম সবাক কাহিনীচিত্র মুখ ও মুখোশ। এটিও শতভাগ পেশাদারী উদ্যোগ না হলেও সারাদেশের বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে ছবিটি মুক্তি পায় এবং দর্শকপ্রিয়তা অর্জন করে। ছবিটিতে অনেক ত্রুটি থাকলেও এদেশের মানুষ দেশের প্রথম চলচ্চিত্র হিসেবে এটিকে সাদরে বরণ করে এবং এদশের চলচ্চিত্রের নান্দীমুখ হয়ে ঐতিহাসিক স্বীকৃতি অর্জন করে এ ছবি।
কিন্তু কোথায় যেন একটি বড় অভাববোধ করতে থাকেন এদেশের চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট জনেরা। ততদিনে সারাদেশে শতাধিক প্রেক্ষাগৃহ তৈরি হয়ে গেছে এবং চলচ্চিত্র দেশের একটি বড় বিনোদন মাধ্যমে পরিণত হয়েছে। এদেশ তখন পশ্চিমবঙ্গের বাংলা, মুম্বাইয়ের হিন্দি ও তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের উর্দু ছবির বড় বাজার। এদেশের অনেক চলচ্চিত্রকর্মী শিল্পী কুলাকুশলী যারা কলকাতা, মুম্বাই, লাহোর, করাচিতে কাজ করতেন, তারা ঢাকা ফিরতে শুরু করেছেন। তারা ঢাকায় এসে এদেশে চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রবল তাগিদ বোধ করতে লাগলেন।
কিন্তুু পশ্চিম পাকিস্তানিরা চাইছিলেন না এখানে ছবি তৈরি হোক। তারা এজন্যে যেটাকে মূল অজুহাত হিসেবে দেখাতে চাইছিলেন সেটি হচ্ছে এদেশের আর্দ্র আবহাওয়া যা সিনেমা স্যুটিং এর জন্য অনুপযোগী। কিন্তু এদেশের চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টদের যুক্তি ছিল কলকাতার অনেক ছবির অংশ বিশেষের স্যুটিং এখানকার আউডডোরে করা হয়েছে। তখনতো কোনো অসুবিধা হয়নি সে সব ছবির পরিস্ফুটনে।
শেষ পর্যন্ত রীতিমত চ্যালেঞ্জ থেকে আবদুল জব্বার খানের প্রযোজনা ও পরিচালনায় অনেকটাই অপেশাগতভাবে তৈরি হয় ‘মুখ ও মুখোশ’, যেটি মুক্তি পায় ১৯৫৬ সালের ৩ আগস্ট ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও খুলনায়।
‘মুখ ও মুখোশে’র গুণগত বিচারের চাইতে এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। বাঙালির সাহস বাড়িয়ে দেয় এ ছবি। বাঙালি বুঝতে পারলো সেও পাকিস্তানের মতো সিনেমা বানাতে পারে তার নিজের দেশে।
এবার বাঙালি দাবি তুললো এদেশে ফিল্ম স্টুডিও নির্মাণের। নানাভাবে সরকারের কাছে দেন দরবার শুরু হলো। মুখ ও মুখোশ তৈরির কয়েক বছর আগে থেকে বাংলাদেশে বেসরকারি পর্যায়ে ফিল্ম স্টুডি নির্মাণের উদ্যোগ অনেকবার গৃহিত হলেও সরকারি অনুমোদন না পাওয়ায় সেসব উদ্যোগ বাস্তবায়িত হতে পারেনি।
১৯৫৩ সালে জে আর্থার র‌্যাংক কোম্পানি চট্টগ্রাম ও কঙবাজারে স্টুডিও স্থাপনের চেষ্টা করেন। ১৯৫৩ সালেই চট্টগ্রামের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী তারেক আহমদ চৌধুরী ‘হনিউড’ নামের একটি স্টুডিও প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। ১৯৫৪ সালের ডিসেম্বরে কোবাদ এন্ড কোম্পানি চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় সমুদ্রতীরে স্টুডিও নির্মাণের পরিকল্পনা নেন। একই সময় আল হেলাল নামেও একটি স্টুডিও স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয় চট্টগ্রামে। শেষোক্ত দুটি স্টুডিওকে অনেক দেরীতে অনুমোদন দেয়া হয়। কিন্তু ততদিনে উদ্যোক্তারা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন।
একটা মজার বিষয় হলো, বেসরকারি পর্যায়ে যে সব স্টুডিও তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়, তার সবক’টিই চট্টগ্রামে। চট্টগ্রামের সাগর, পাহাড়, হ্রদ, নদীসমৃদ্ধ প্রাকৃতিক পরিবেশই হয়তো এর প্রধান কারণ। তাছাড়া বাণিজ্যিক দিকটাতো ছিলই।
যা হোক, দীর্ঘদিন ধরে সরকারি বেসরকারি কোনো পর্যায়েই আর ফিল্ম স্টুডিও স্থাপনের উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয় না। এদিকে চলচ্চিত্রানুরাগীদের দাবি চলতেই থাকে সরকারি পর্যায়ে পূর্ণাঙ্গ স্টুডিও স্থাপনের। তারা বারংবার তাগিদ দিতে থাকেন। যদিও পাকিস্তানি কেন্দ্রীয় সরকার এতে কোনো সাড়া দিচ্ছিলেন না। তারা বরং নিজেদের প্রয়োজনে ১৯৫৫ সালের ১৯ জুন ঢাকায় সরকারি চলচ্চিত্র বিভাগ প্রতিষ্ঠা করে। ঢাকার তেজগাঁওতে বিজি প্রেসের একটি খালি ভবনে ল্যাবরেটরি, প্রিন্টিং মেশিন, রেকর্ডিং স্টুডিও প্রজেকশন রুমের সমন্বয়ে গঠন করা হয় একটি স্টুডিও, ডিপার্টমেন্ট অফ ফিল্ম এন্ড পাবলিকেশন, ডিএফপি। এটা করা হয় মূলতঃ সরকারি নিউজ রিল ও প্রচারচিত্র নির্মাণের উদ্দেশ্যে, যা জনগণের বিনোদনের কিংবা শিল্পচর্চার ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা পালনে অক্ষম।
ইতোমধ্যে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের পতন ঘটে। পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষমতায় আসে যুক্তফ্রন্ট সরকার। শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের নেতৃত্বে গঠিত মন্ত্রিসভায় বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী নিযুক্ত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সে সময় তথ্য কিংবা সংস্কৃতি বিষয়ক কোনো মন্ত্রণালয় ছিল না।
বঙ্গবন্ধু সে সময়েই জনগণের প্রিয় নেতা হয়ে উঠতে শুরু করেছেন। ঢাকায় একটি স্থায়ী পূর্ণাঙ্গ ফিল্ম স্টুডিও নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে তাঁর সঙ্গে আলোচনা করেন আবদুল জব্বার খান, ড. আবদুস সাদেক, নুরুজ্জামান প্রমুখ চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টজন। বঙ্গবন্ধু তাদের প্রস্তাবে সম্মত হন এবং একটি বিস্তারিত পরিকল্পনা তাঁর কাছে জমা দিতে অনুরোধ করেন। (ক্রমশঃ)

পূর্ববর্তী নিবন্ধএক কবি ও গীতিকার
পরবর্তী নিবন্ধঐশীর চোখে শুভ যেমন!