বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক চেতনা ও দর্শন এবং আমাদের স্বাধীনতা

নেছার আহমদ | রবিবার , ২৬ মার্চ, ২০২৩ at ৪:৫১ পূর্বাহ্ণ

বঙ্গবন্ধু ছিলেন রাষ্ট্র নায়কোচিত রাজনীতিক, তাঁর সকল চিন্তা চেতনা জুড়ে ছিল বাঙালির জাতীয় মুক্তি বা স্বাধীনতার স্বপ্ন। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনের মূলে ছিল বাঙালির জাতীয় মুক্তি বা স্বাধীনতা ও গণমানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন তার কথা ‘দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো’। স্বাভাবিকভাবে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন এবং স্বাধীনতা এক ও অভিন্ন। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন নিয়ে সংক্ষিপ্তকারে এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

চিন্তাচেতনায়, চলনেবলনে, আচারআচরণে, রুচিতে, ভাবনায়, পোশাকপরিচ্ছদে, খাদ্যভ্যাসে, ইতিহাসঐতিহ্যমনস্কতায়সব কিছুতেই বঙ্গবন্ধু ছিলেন খাঁটি বাঙালি। বাংলার সবুজ গ্রাম, উর্বর মাটি, সোনালি ফসলে ভরা মাঠে, পল্লীগীতি, বাঙালি খাবার, বাংলা ভাষা সবই ছিল তাঁর হৃদয়ের গহিনে। আগরতলা মামলায় ১৯৬৮ সালের মধ্য জানুয়ারিতে যখন পাকিস্তানি সেনা প্রহরায় ঢাকার কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্টে আনা হয়, সে সময়ে তাঁর মনের অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে লেখেন, ‘মনে মনে বাংলার মাটিকে সালাম দিয়ে বললাম, তোমাকে আমি ভালোবাসি। মৃত্যুর পরে তোমার মাটিতে যেন আমার একটু স্থান হয়, মা’ (কারাগারের রোজনামচা, পৃ: ২৫৬)। বাঙালি সত্তাই ছিল বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সত্তার ভিত্তিভূমি। পাকিস্তানে বন্দি থাকা অবস্থায় মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তিনি বলতে পেরেছিলেন, ‘ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় আমি বলব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা’। পাকিস্তানি শাসন পূর্বে বঙ্গবন্ধুর আন্দোলনসংগ্রামের মূল ভিত্তি ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদ। তিনি ছিলেন ভাষা আন্দোলনের প্রথম কারাবন্দি (১১ মার্চ ১৯৪৮)। ভাষা আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্ব অর্থাৎ ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্র ভাষার স্বীকৃতির দাবিতে তিনি বন্দি অবস্থায় দীর্ঘ এগারো দিন অনশন পালন করেছিলেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের সংবিধানে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতীয়তাবাদকে রাষ্ট্র পরিচালনার অন্যতম মূল নীতি হিসেবে সংবিধানে অন্তর্ভূক্ত করেন। বঙ্গবন্ধু একাধিকবার উল্লেখ করেন, ‘বাঙালি জাতিয়তাবাদ না থাকলে আমাদের স্বাধীনতার অস্তিত্ব নষ্ট হবে’।

বঙ্গবন্ধুর হৃদয় জুড়ে ছিল বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির সার্বিক মুক্তি। এক মামলায় তাঁর কারাদণ্ড হওয়ায় বেদনার্ত কয়েদিকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘দুঃখ করবেন না, আমিতো এই পথে জেনে শুনেই নেমেছি, দুঃখ তো আমার কপালে আছেই। দেশকে ও দেশের মানুষকে ভালবাসলে, কষ্ট ও জুলুম স্বীকার করতে হয়’ (কারাগারের রোজনামচা, পৃ: ২৩২)

১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু ‘আমাদের বাঁচার দাবী’ ৬ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এটি ছিল বাঙালির শোষণমুক্তি বা স্বাধীনতার সনদ। বঙ্গবন্ধুর কথায়, ‘এ ৬ দফা ক্ষমতা দখলের সংগ্রাম নয়, জনগণকে শোষণের হাত থেকে বাঁচাবার জন্য সংগ্রাম’ (কারাগারের রোজনামচা, পৃ: ৬৫)। তাই তিনি ঘোষণা করেছিলেন, ‘৬ দফা দাবির সাথে কোনো আপস হবে না’ (কারাগারের রোজনামচা, পৃ: ১৬৭), ‘৬ দফা দাবি দরকার হলে একলাই করে যাবো’ (কারাগারের রোজনামচা, পৃ: ২২৬)। ধর্ম নিরপেক্ষতা রাষ্ট্র পরিচালনার একটি নীতি। এর অর্থ ধর্মহীনতা বা ধর্ম বিমুখতা নয়। এর অর্থ হচ্ছে, রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে রাষ্ট্র নায়করা নাগরিকদের ধর্ম বা বিশ্বাসের বিষয়ে বিষয়ে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ থাকবেন। কে কোনো ধর্মে বিশ্বাসী বা কে অবিশ্বাসী অথবা নাস্তিক এ বিষয়ে রাষ্ট্রযন্ত্র কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করবে না। ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সকল নাগরিকের সমান অধিকার, সবাই রাষ্ট্রের দৃষ্টিতে সমানএই হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা।

জীবনের প্রথম থেকেই বঙ্গবন্ধু তাঁর চেতনা ও বিশ্বাসে ছিলেন অসাম্প্রদায়িক। তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবোধ জন্ম নেওয়া সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনি ব্রিটিশবিরোধী ত্যাগী ও কারানির্যাতন ভোগকারী স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রসঙ্গ টেনে লেখেন, …..এই সকল নিঃস্বার্থ স্বাধীনতা সংগ্রামী ও ত্যাগী পুরুষরা ইংরেজদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সাথে সাথে হিন্দু ও মুসলমানদের মিলনের চেষ্টা করতেন এবং মুসলমানদের ওপর যে অত্যাচার ও জুলুম হিন্দু জমিদার ও বেনিয়ারা করেছিল, তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতেন, তাহলে তিক্ততা এত বাড়ত না’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ: ২৩২৪)

১৯৫০ সালের শেষদিকে ফরিদপুর কারাগারে গোপালগঞ্জের সহবন্দি সমাজকর্মী ও মহাত্মা গান্ধীর অনুসারী চন্দ্রঘোষের বঙ্গবন্ধুর প্রতি ‘মানুষকে মানুষ হিসেবে’ দেখার উপদেশের প্রত্যুত্তরে তাৎক্ষণিক বক্তব্য প্রণিদানযোগ্য। তিনি বলেছিলেন, ‘চিন্তা করবেন না, আমি মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখি। রাজনীতিতে আমার কাছে মুসলমান, হিন্দু ও খ্রিস্টান বলে কিছু নাই। সকলেই মানুষ’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ: ১৯১)

যে মানুষকে ভালবাসে, সে কোনদিন সাম্প্রদায়িক হতে পারে না’। সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ার আহ্বান জানিয়ে বঙ্গবন্ধু দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে তাঁর এক ভাষণে বলেছিলেন, ‘যারা এই বাংলার মাটিতে সাম্প্রদায়িকতা করতে চায় তাদের সম্পর্কে সাবধান হয়ে যেও। আওয়ামী লীগের কর্মীরা, তোমরা কোনোদিন সাম্প্রদায়িকতাকে পছন্দ করো নাই। তোমরা জীবনভর তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছো। তোমাদের জীবন থাকতে যেন বাংলার মাটিতে আর কেউ সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করতে না পারে।’

গণতন্ত্রই ছিল বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির পথ। গোপন বা ষড়যন্ত্রের রাজনীতির কোনোদিন তিনি আশ্রয় নেননি। বঙ্গবন্ধু এ বিষয়ে তাঁর মনের অভিব্যক্তি প্রকাশ করতে গিয়ে লেখেন, ‘ভাবতে লাগলাম রাজনীতি এত জঘন্য হতে পারে! ক্ষমতার জন্য মানুষ যে কোনো কাজ করতে পারে। …. আমি তো ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে বিশ্বাস করি নাই। জীবনভর প্রকাশ্যভাবে রাজনীতি করেছি।…..গোপন কিছুই করি না বা জানি না।….জেলে যেতে হবে জেনেও ছয় দফা জনগণের কাছে পেশ করেছিলাম।….. অত্যাচার চরম হবে, তবুও গোপন করি নাই। আজ দুঃখের সাথে ভাবছি আমাকে গোপন ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িত করতে শাসকদের একটু বাঁধলো না! এরা তো আমার চরিত্রের বৈশিষ্ট্য ভাল করে জানে (কারাগারের রোজনামচা, পৃ: ২৫৮)

বঙ্গবন্ধু সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বিশ্বাসী ছিলেন, পশ্চিমের অবাধ পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় নয়। ১৯৫২ সালে চীন সফর সম্বন্ধে বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি লেখেন, “আমি নিজে কমিউনিস্ট নই। তবে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে বিশ্বাস করি না। একে আমি শোষণের যন্ত্র হিসেবে মনে করি’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ: ২৩৪)

একই গ্রন্থের তিনি আরো লেখেন, ‘আওয়ামী লীগের মধ্যে অনেক নেতা ও কর্মী আছে যারা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করে; এবং তারা জানে সমাজতন্ত্রের পথই একমাত্র জনগণের মুক্তির পথ’ (পৃ: ২৫৮)। ‘যারা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করে, তারা কোনোদিন কোনো রকমের সাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাস করতে পারে না। তাদের কাছে মুসলমান, হিন্দু, বাঙালি, অবাঙালি সকলেই সমান’ (পৃ: ২৫৮)

বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির মূলে ছিল দুটি বিষয়, () বাঙালির জাতীয় মুক্তি বা স্বাধীনতা, যা দীর্ঘ আন্দোলনসংগ্রাম শেষে ১৯৭১ সালে তাঁর নেতৃত্বে ন’ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত হয়; () শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বাংলার ক্ষুধাদারিদ্র্যঅশিক্ষাপীড়িত, সমাজে চির অবহেলিত, অধ:স্তন, নির্যাতিতনিপীড়িত, যুগের পর যুগ ধরে শোষিতবঞ্চিত, গরিবদুঃখী গণমানুষের মুখে সুখের হাসি ফোটানো।

বঙ্গবন্ধুর পুরো জীবন ছিল বিশ্বব্যাপী স্নায়ুযুদ্ধের সময়। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তাঁর অবস্থান ছিল সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহের পক্ষে এবং পুঁজিবাদসাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে ইতিহাস খ্যাত তাঁর উক্তিটি : ‘বিশ্ব আজ দুই ভাগে বিভক্তশোষক ও শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে’।

বঙ্গবন্ধু বিশ্বশান্তি ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমস্যা সমাধানের নীতিতে গভীরভাবে বিশ্বাসী ছিলেন। আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা থেকেই একই নীতি অনুসরণ করে আসে। বঙ্গবন্ধু প্যালেস্টাইন প্রশ্নে আরবইসরাইল সংঘর্ষ, কাশ্মীর প্রশ্নে ভারতপাকিস্তান দ্বন্দ্বসহ বিশ্বের অন্যান্য স্থানের অনুরূপ দ্বন্দ্বসংকট নিরসনে একই অবস্থান গ্রহণ করেন। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভকালে ঐ সংস্থায় তাঁর ভাষণেও বঙ্গবন্ধু বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার ওপর সবিশেষ গুরুত্বারোপ করেন। বিশ্বশান্তির প্রশ্নে তাঁর অবস্থান ও অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৩ সালে বিশ্বশান্তি পরিষদ বঙ্গবন্ধুকে ‘জুলিও কুরি’ উপাধিতে ভূষিত করে।

তিনি বলেন, ‘নতুন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত জনগণের কর্তব্য বিশ্বশান্তির জন্য সংঘবদ্ধভাবে চেষ্টা করা। যুগ যুগ ধরে পরাধীনতার শৃঙ্খলে যারা আবদ্ধ ছিল, সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যাদের সর্বস্ব লুট করেছে তাদের প্রয়োজন নিজের দেশকে গড়া ও জনগণের অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক মুক্তির দিকে সর্বশক্তি নিয়োগ করা। বিশ্বশান্তির জন্য জনমত সৃষ্টি করা তাই প্রয়োজন হয়ে পড়েছে (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃ: ২৩৪)

বাংলাদেশ রাষ্ট্র সৃষ্টির অনুরূপ, বাঙালির স্বাধীন অস্তিত্ব, জাতীয় সংহতি ও রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ উন্নয়নঅগ্রগতির ক্ষেত্রেও বঙ্গবন্ধুর দর্শন বা শিক্ষা অনন্তকাল ধরে জাতির জন্য আবশ্যকীয় হয়ে থাকবে। শুধু বাঙালিজাতির জন্য কেন বিশ্বমানবতার জন্যও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে অনেক কিছু শিক্ষণীয় রয়েছে।

তথ্য সূত্র: ১। ‘কারাগারে রোজনামচা’ শেখ মুজিবুর রহমান, বাংলা একাডেমি। ২। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ শেখ মুজিবুর রহমান, ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড। ৩। হারুনঅর রশিদ লিখিত, ৭ই মার্চের ভাষণ কেন বিশ্বঐতিহ্য সম্পদ বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশ, বাংলা একাডেমি, ২০১৯২০২০।

লেখক : প্রাবন্ধিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনাটক থাকুক সঙ্ঘবদ্ধ মানুষের সম্মিলিত চেতনায়
পরবর্তী নিবন্ধমার্চের মহাজাগরণ ও স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ