বই বিমুখদের দায়িত্ব কে নেবে

মুশফিকুর রহমান | সোমবার , ১৩ মার্চ, ২০২৩ at ৫:৫১ পূর্বাহ্ণ

পৃথিবীতে কেবল আমরাই ভাষার জন্য প্রাণ দেওয়া জাতি। প্রতি বছরের মত এই ভাষার মাসে আয়োজিত বইমেলা২০২৩ শেষ হলো। একদিনে সর্বোচ্চ ২৭৬ টি বই মেলা উপলক্ষে প্রকাশিত হয়েছিল। যা ছিল একজন বইপ্রেমির জন্য অত্যন্ত খুশির খবর। ধরণা করা হচ্ছে এ বছর বইমেলায় প্রায় একশ কোটি টাকার বই বিক্রয় হবে। যার ফলে বলা যায় বই প্রকাশনা আজ বাংলাদেশে ‘প্রকাশনা শিল্প’র রূপ নিয়েছে।

আর এই অর্জনের পেছনে অব্যাহত ছিল প্রকাশক ও লেখকদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে প্রচার প্রচারণা, নতুন বইয়ের উপর সর্বোচ্চ ছাড়, ডিজিটাল লেনদেনকারী প্রতিষ্ঠান নগদ ও বিকাশের দেওয়া ক্যাশব্যাক সুবিধা। তার পাশাপাশি বইমেলায় প্রকাশিত নতুন ও পুরাতন বই দেশে প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে দিতে রকমারিনগদ কাজ করেছিল। বইমেলা ঘিরে প্রতিদিন ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মোড়ক উন্মোচনসহ প্রখ্যাত লেখক ও গুণী মানুষদের পদচারণা। লেখকপাঠকদের হাজারো অনুভূতি সহ বইমেলার নানান আয়োজনের কথা দেশের সকল মানুষদের কাছে পৌঁছে দিতে কাজ করেছিল পত্রিকা, টিভি ও অন্যান্য অনলাইন মিডিয়াসহ নানান বই সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠন। যার ফলে বইমেলার খবর পান নি এমন কেউ এই দেশি বাকি ছিল বলে মনে হয় না। বিশেষ করে দেশের যুবকরা। কিন্তু ঢাকা ও চট্টগ্রাম বইমেলায় যুবকদের কত শতাংশ উপস্থিত ছিল এবং বই কিনেছে তার হিসাব মেলানোর সময় এসেছে। মেলায় অবস্থিত খাবারের দোকানগুলোতে যে পরিমাণ ভিড় ছিল সেভাবে ভোজন রসিকদের হাতে তেমন বইয়ের থলে লক্ষণীয় ছিল না। তবে আশার কথা হলো আজ তারা মেলায় এসেছিল, হয়ত বা কাল তারা বই কিনবে।

কিন্তু যারা একেবারেই বইমেলায় আসেনি, বইয়ের স্পর্শটুকুও নেয় নি তাদের দায়িত্ব কে নিবে? বই বিমুখদের বইয়ের প্রতি উজ্জ্বীবিত করার জন্য বাংলা একাডেমি, সিটি কর্পোরেশন, লেখক, প্রকাশক কিংবা প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার লোকজন ব্যর্থ হয়েছিল বলে ধরে নেয়াটা দোষের কিছু নয়। যার ফলে প্রশ্ন করা যেতে পারে এই যুবকরা বই বিমুখ কেনই বা ছিলেন?

শিক্ষিত যুবকরা যদি বই বিমুখ হয়ে উঠে তাহলে তাদের পরবর্তী প্রজন্মের ভবিষ্যতইবা কী? এমন চিন্তায় পতিত হলে আমাদের লেখকপ্রকাশকদের কপালে ভাঁজ পড়াটাই স্বাভাবিক। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সমাজ, ধর্মীয়প্রতিষ্ঠন, রেস্তোরাঁ, গণপরিবহণ, সাংস্কৃতিক ক্লাবগুলো থেকে শুরু করে পাড়ামহল্লায় একটা দারুণ গণজাগরণ সৃষ্টি করতে হবে।

নেপোলিয়ন বলেছিলেন একজন মানুষের জীবনে ষাট হাজার বই না থাকলে জীবন কাটে না। এত বড় দাগে না হলেও প্রতি মাসে অন্তত একটি কাব্যগ্রন্থ, উপন্যাস, গল্পগুচ্ছ, অনুবাদ, কিংবা প্রবন্ধ পড়তেই হবে। বই পড়লে আত্মা যে প্রশান্তি পায় সে কথা আমাদের যুবকদেরকেই বুঝে উঠতে হবে। যুবকরা যে ‘টিকটক’ কিংবা ‘ফেইসবুক’ নিয়ে ব্যস্ত থাকে সেই প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্ণধারগণ নিজেরাই প্রতিদিন প্রচুর বই পড়েন। ইলন মাস্ক বই পড়ে নিজেই রকেট সাইন্সের বিদ্যা অর্জন করেছিলেন। বই পড়া যে মস্তিস্কের ব্যায়াম সেটা আমাদের যুবকদের কাছে দ্ব্যর্থহীন ভাবে তুলে ধরতে হবে। আর এই দায়িত্ব নিতে হবে দেশের সিটি কর্পোরেশন থেকে শুরু করে চেয়ারম্যান কার্যালয়গুলোকে। সরকারিবেসরকারি প্রতিটি অফিসে বইয়ের প্রচারণা অব্যহত রাখা জরুরি হয়ে উঠেছে। প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বইপড়ার গুরুত্ব জানিয়ে ব্যানার কিংবা দেয়ালিকা লাগাতে হবে। একজন মানুষ একই প্রচারণা ভিন্ন তিনটি স্থানে দেখলে তা তার মস্তিস্কায়ন হবেই।

এক্ষেত্রে প্রকাশনা সংগঠন শুধু বইমেলা কেন্দ্রিক প্রচারণা না চালিয়ে বছরজুড়ে প্রচারণা চালাতে পারে। এতে সারাবছর ধরে যে ব্যয় হবে তা বছরান্তে উঠে আসবে। বছর ঘিরে বেড়ে উঠা বিশাল এই পাঠক সংখ্যা পরবর্তী বইমেলায় এর দারুণ প্রতিদান দিবে। যার ফলশ্রুতিতে পাঠক পাবে মজবুত ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আর লেখক প্রকাশকগণ পাবে তাঁদের ন্যায্য প্রতিদান। লেখক : কবিকথাসাহিত্যিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রকৃত বন্ধু
পরবর্তী নিবন্ধপারিবারিক আদালত আইন ২০২২ ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা