ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা পেশায় সচেতন হওয়ার আহবান

মোহাম্মদ কামরুজ্জামান

| বৃহস্পতিবার , ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৫:৩৪ পূর্বাহ্ণ

ফিজিও (শারীরিক) ও থেরাপি (চিকিৎসা) এ দুইটি শব্দ থেকে এসেছে ফিজিওথেরাপি (চযুংরড়ঃযবৎধঢ়ু) শব্দটি। এটি একটি স্বতন্ত্র চিকিৎসা ব্যবস্থা, যেখানে তাপ, চাপ, শব্দ, বিদ্যুৎ শারীরিক পদ্ধতিগত ব্যায়াম এবং অন্যান্য মেথডের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হয়। এ পদ্ধতির চিকিৎসকরা ফিজিওথেরাপিস্ট নামে পরিচিত। বিভিন্ন শারীরিক অক্ষমতার জন্য ফিজিক্যাল থেরাপি চিকিৎসা বিজ্ঞানের আধুনিক শাখা।
ক্রমবর্ধমান জনসংখা বৃদ্ধির ফলে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখা ও দিন দিন বেড়েই চলছে। আবার যানবাহন-শিল্প-কল-কারখানা বৃদ্ধির ফলে দুর্ঘটনাও বেড়েই চলছে। বিভীন্ন ধরনের দুর্ঘটনার ফলে বিভিন্ন ধরনের বিকলাঙ্গতা, ব্যথা, স্পোর্টস ইনজুরি ও প্যারালাইসিস সংক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। এই সকল রোগীদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসন করতে ফিজিওথেরাপি অত্যন্ত কার্যকর এবং অপরিহার্য চিকিৎসা পদ্ধতি।
বাংলাদেশে ফিজিওথেরাপিঃ ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের অবসানের পর যুদ্ধাহত পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষ যারা যুদ্ধে আহত হন, তাদের পুনর্বাসনের জন্য জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে আমেরিকান প্রখ্যাত অর্থপেডিক সার্জন অধ্যাপক আর .জে . গার্স্ট তার ভলান্টারী বিশেষজ্ঞ টিম নিয়ে তাদের চাহিদা অনুযায়ী তৎকালীন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের করিডরে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের এবং সাধারণ আহত মানুষদের বিশেষায়িত চিকিৎসা, অথোপেডিক ও ফিজিওথেরাপি এন্ড রিহ্যাবিলিটেশন/ পুনর্বাসন চিকিৎসা চালু করেন। এতে হাজার হাজার যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যান। সমগ্র বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য ফিজিওথেরাপি ও পুনর্বাসন চিকিৎসা ব্যবস্থা চালু করার লক্ষে প্রফেসর ডা. আর জে গার্স্ট ১৯৭২ সালে সরকারের একান্ত সমর্থনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা অনুষদের অধীনে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে প্রথম প্রফেশনাল ফিজিওথেরাপি স্নাতক ডিগ্রি কোর্স চালু করেন। বাংলাদেশ- আমেরিকা-ইউরোপের বিভিন্ন বিষয়ের শিক্ষকদের সহযোগিতায় ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত ২টি ব্যাচে ২৫ জন ফিজিওথেরাপি স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করে ফিজিওথেরাপিস্ট হন। সেই সাথে এদেশের কয়েকটি হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজে ফিজিওথেরাপির একাডেমিক এবং ক্লিনিক্যাল পদ সৃষ্টির মাধ্যমে অনেকেই পদায়ন হন, আবার অনেকেই উচ্চতর ডিগ্রির জন্য বিদেশে চলে যান, যাদের অধিকাংশ এদেশে ফিরে আসেন নি।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে চিকিৎসা ও শিক্ষা কার্যক্রমের পাশাপাশি পঙ্গু হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান ( আর আই এইচ ডি – রিহ্যাবিলিটেশন ইন্সটিটিউট এন্ড হসপিটাল ফর দ্য ডিস্যাবল্ড) করেন যা পরবর্তীতে নাম পরিবর্তন করে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর) নামে পরিচিত। ১৯৭৮–৭৯ সালে বিদেশী বিশেষজ্ঞ টিম বাংলাদেশ ত্যাগ করে নিজ দেশে ফিরে যান, তখন ই ফিজিওথেরাপি স্নাতক ডিগ্রি কোর্স বন্ধ হয়ে যায়। প্রায় ১৬ বছর কোর্স টি বন্ধ থাকার পর ১৯৯৫-৯৬ সালে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্তে পুনরায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা অনুষদের অধীনে আর আই এইচ ডি ( বর্তমান নিটোর) এ এক বছর বাধ্যতামূলক ইন্টার্নশীপ সহ ৫ বছর মেয়াদী ব্যচেলর অব সাইন্স ইন ফিজিওথেরাপি প্রফেশনাল ডিগ্রি কোর্স চালু করেন যা এখন ও চলমান। বর্তমানে ফিজিওথেরাপি স্নাতক ডিগ্রি কোর্স টি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা অনুষদের অধীনে সরকারি ভাবে আর আই এইচ ডি/ নি টো র সহ আর ও কয়েকটি সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পরিচালিত হচ্ছে।
ফিজিওথেরাপিতে প্রফেশনাল স্নাতক ডিগ্রি প্রাপ্ত ফিজিওথেরাপিস্টগণ নামের আগে প্রিফিক্স ব্যবহার জটিলতায় পড়লে ২০১১ সালে বি পি এ এবং কতিপয় ফিজিওথেরাপিস্ট মহামান্য সুপ্রিমকোর্টের বরাবরে বি এম ডি সি এক্ট ২০১০ এর বিরুদ্ধে রীট পিটিশন দায়ের করলে মহামান্য হাইকোর্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা অনুষদ সহ সরকার ও ইউ জি সি অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান থেকে বিপিটি/ বি এস সি পিটি ডিগ্রিপ্রাপ্ত ফিজিওথেরাপিস্ট দের নামের পূর্বে (ডা.) প্রিফিক্স ব্যবহারে যাতে কোনো প্রকার আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কর্তৃক হয়রানী করা না হয় সে ব্যপারে নির্দেশ প্রদান করেন। যা রীটের ( রীট পিটিশন নংঃ ১০৯৯৮/২০১১ ) নিস্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত চলবে। উল্লেখ্য ২০১৮ সালের ২৫ অক্টোবর ( মহামান্য রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষরিত ১৪/১১/২০১৮) মহান জাতীয় সংসদে ফিজিওথেরাপিস্ট সহ আর ও কিছু পেশাজীবীদের নিয়ন্ত্রণের জন্য ‘বাংলাদেশ রিহ্যাবিলিটেশন কাউন্সিল ২০১৮’ গঠন হয়। এই আইন অনুসারে ফিজিওথেরাপিস্টগন পরিচালিত হবেন, বি এম ডি সি আইন দ্বারা নহে।
ফিজিওথেরাপি প্রফেশনাল কোর্সে যে সকল বিষয় পড়ানো হয় এর মধ্যেঃ এনাটমী, ফিজিওলজি, বায়োকেমিস্ট্রি, মাইক্রোবায়োলজি, জেনারেল মেডিসিন, কমিউনিটি মেডিসিন, জেনারেল সার্জারী, সাইকোলজি, অর্থোপেডিকস মেডিসিন, রিউমেটলজি, নিউরোলজি, ফার্মাকোলজি সহ ফিজিওথেরাপি রিলেটেড সকল প্রকার বিষয় মোট ৫৩৫০ ঘণ্টা পড়ানো হয়।
স্নাতকোত্তর ফিজিওথেরাপি শিক্ষা: দেশে ২০১১ সাল থেকে প্রথম বারের মত বিদেশী শিক্ষকদের তত্ত্বাবদানেগণ বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর চিকিৎসা বিজ্ঞান অনুষদের অধীনে মাস্টার্স অব ফিজিওথেরাপি ( এম পি টি) পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এম এস সি পিটি চালু হয়।
বর্তমানে বাংলাদেশে ফিজিওথেরাপিতে দুটি শিক্ষা ব্যবস্থা চালু আছে। ১. ব্যাচেলর অফ ফিজিওথেরাপি: ভর্তি যোগ্যতা: এস এস সি এবং এইচ এস সি তে বিজ্ঞান সহ জি পি এ – ৮, ফিজিওথেরাপি স্নাতক প্রফেশনাল ডিগ্রিপ্রাপ্ত ফিজিওথেরাপিস্টগণ বি আর সি এক্ট ২০১৮ এবং বিশ্ব সাস্থ্য সংস্থার (ডঐঙ) নির্দেশনা অনুযায়ী সরাসরি এবং স্বতন্ত্র ভাবে রোগীদের রোগ নির্ণয় মূল্যায়ন, ইনভেস্টিগেশন, চিকিৎসা ও পরামর্শ করে থাকবেন।
২। ডিপ্লোমা ইন মেডিকেল টেকনোলজি (ফিজিওথেরাপি)গণ ফিজিওথেরাপিস্টদের পরামর্শ অনুযায়ী রোগিদের ফিজিওথেরাপি সেবা প্রদান করবেন।
লেখক: ফিজিওথেরাপিস্ট, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও সভাপতি, বাংলাদেশ ফিজিক্যাল থেরাপি এসোসিয়েশন, চট্টগ্রাম বিভাগ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজন্মদিবসে আজাদীকে খোলা চিঠি
পরবর্তী নিবন্ধদৈনিক আজাদী এক বিশ্বস্ততার নাম