ফারদিন খুন হননি, আত্মহত্যা করেছেন : ডিবি-র‌্যাব

মানতে নারাজ সহপাঠীরা, কনভিন্সড নন বাবাও

| বৃহস্পতিবার , ১৫ ডিসেম্বর, ২০২২ at ৬:৩১ পূর্বাহ্ণ

বুয়েটছাত্র ফারদিন নূর পরশের লাশ উদ্ধারের পর ময়নাতদন্তে হত্যার আলামত পাওয়ার কথা জানিয়েছিলেন চিকিৎসক; তারপর তদন্ত নিয়ে পরিবার ও সহপাঠীদের হতাশার মধ্যে ৪০ দিন পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানিয়েছে, এই তরুণ আত্মহত্যা করেছিলেন। এই তরুণের মৃত্যুর ঘটনাটির তদন্তভার গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) হাতে, পাশাপাশি ছায়া তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছিল র‌্যাব। এর আগে দুই সংস্থার ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্যে বিভ্রান্তি ছড়ালেও একই উপসংহারে পৌঁছেছে র‌্যাব ও ডিবি। দুই পক্ষই বলেছে, নিখোঁজ হওয়ার দিন ভোররাতে ডেমরার সুলতানা কামাল সেতু থেকে শীতলক্ষ্যা নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ফারদিন। গোয়েন্দা পুলিশ জানিয়েছে, পরীক্ষার ফল খারাপ হওয়া এবং বিদেশ যেতে অর্থ জোগাড় করতে না পারার হতাশা থেকে এই তরুণ আত্মহননের পথ বেছে নেন। ফারদিন নূর পরশ আত্মহত্যা করেছেন বলে র‌্যাব-পুলিশ তদন্তে পাওয়ার দাবি করলেও তা মানতে নারাজ বুয়েটে তার সহপাঠীরা। এর প্রতিবাদে তারা কর্মসূচিও ডেকেছেন। অন্যদিকে ফারদিনের বাবা সাংবাদিক কাজী নূরউদ্দিন রানাও বলছেন, যে তথ্যের ভিত্তিতে আত্মহত্যার কথা বলা হচ্ছে, তাতে একমত নন তিনি। খবর বিডিনিউজের।

ফারদিনের মৃত্যুর তদন্তে নেমে চনপাড়ার মাদকের আখড়ার প্রসঙ্গটি র‌্যাবের মাধ্যমে এলেও এখন সংস্থাটি বলছে, ফারদিনের মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক একবার চনপাড়া টাওয়ারের অধীনে পাওয়ায় এই বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছিল। লাশ উদ্ধারের পর মাস গড়িয়ে গেলেও হত্যামামলার তদন্তে অগ্রগতি না দেখে এবং র‌্যাব-ডিবির বিপরীত বক্তব্য শুনে ফারদিনের পরিবার ও তার সহপাঠীদের অসন্তোষের মধ্যে বুধবার প্রথমে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান হারুন অর রশীদ তাদের তদন্তে পাওয়া তথ্য সাংবাদিকদের জানান। ফারদিনের মৃত্যুর তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে জানিয়ে র‌্যাব বুধবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় সংবাদ সম্মেলন ডাকার আগে তদন্তে নিজেদের পাওয়া তথ্য তুলে ধরেন ডিবির কর্মকর্তা হারুন। তিনি বিকালে বিডিনিউজকে বলেন, আপাত দৃষ্টিতে আমার কাছে মনে হচ্ছে, এটি একটি আত্মহত্যা। আমি ডাক্তারের (ময়নাতদন্তকারী) সঙ্গে কথা বলেছি, পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট দেখেছি, সার্বিক দিক দেখে মনে হয়েছে, এটি আত্মহত্যার ঘটনা। কী কারণে এই বুয়েটছাত্র আত্মহত্যা করতে পারেন, সে বিষয়ে ফোনে কিছু না জানিয়ে বিস্তারিত শুনতে তার কার্যালয়ে যেতে বলেন।

পরে নিজের কার্যালয়ে হারুন সাংবাদিকদের বলেন, তার (ফারদিন) স্পেন যাওয়ার কথা ছিল, টাকা ম্যানেজ হয়নি। তার পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ হচ্ছিল। সবকিছু মিলেই মনে হয়েছে, সে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিল। সে সাঁতার জানত না, সবকিছু মিলে আমরা মনে করছি এটি আত্মহত্যা, বলেন তিনি। ঘণ্টাখানেক পরে কারওয়ান বাজারে র‌্যাবের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে বাহিনীর মুখপাত্র খন্দকার আল মঈন বলেন, সিসিটিভি ফুটেজ, ডিজিটাল ফুটপ্রিন্টসহ অন্যান্য সকল সংশ্লিষ্ট আলামত বিবেচনায় নিয়ে আমাদের তদন্তে বের হয়ে আসে যে, বুয়েট শিক্ষার্থী ফারদিন স্বেচ্ছায় সুলতানা কামাল ব্রিজ হতে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে মৃত্যুবরণ করে।

বুয়েটের পুরকৌশলের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ফারদিন (২৪) বিতার্কিক ছিলেন। এই বছরই স্পেনের এক অনুষ্ঠানে তার যাওয়ার কথা ছিল। বাবা-মার বড় ছেলে ফারদিন থাকতেন ঢাকার ডেমরার কোনাপাড়ায় পরিবারের সঙ্গে। গত ৪ নভেম্বর দুপুরে কোনাপাড়ার বাসা থেকে বেরিয়েছিলেন ফারদিন; বলে গিয়েছিলেন, পরদিন তার পরীক্ষা রয়েছে বলে রাতে বুয়েটের হলেই থাকবেন। পরীক্ষা দিয়ে বাসায় ফিরবেন। কিন্তু পরদিন পরীক্ষায় তার অনুপস্থিত থাকার খবর জেনে খোঁজাখুঁজি করেও ছেলেকে না পেয়ে থানায় জিডি করেন ফারদিনের বাবা কাজী নূরউদ্দিন রানা। তিনদিন পর ৭ নভেম্বর নারায়ণগঞ্জে শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে লাশ পাওয়া যায়। ফারদিনের লাশ পাওয়া যায় গোদনাইলে বর্ণালী টেঙটাইল মিলের ঘাট এলাকায়। উদ্ধারের সময় তার হাতে ঘড়ি পরা ছিল; জামা-প্যান্ট ছিল প্রায় অক্ষত। তার মানিব্যাগও সঙ্গে ছিল বলে পুলিশ জানায়।

তবে নারায়ণগঞ্জ হাসপাতালে ময়নাতদন্তের পর চিকিৎসক শেখ ফরহাদ সাংবাদিকদের বলেন, নিখোঁজ হওয়ার দিনই হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন ফারদিন। তার মাথা ও বুকে একাধিক আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। মৃত্যুর আগে শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন ওই ছাত্র। এরপর এই বুয়েটছাত্রের মৃত্যু নিয়ে তুমুল আলোচনার মধ্যে ফারদিনের বাবা রামপুরা থানায় হত্যামামলা করলে তার তদন্তভার দেওয়া হয় ডিবিকে। পরে ফারদিনের বান্ধবী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আমাতুল্লাহ বুশরাকে ডিবি গ্রেপ্তারের পর রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। তিনি এখন কারাগারে রয়েছেন। যেদিন ফারদিন নিখোঁজ হয়েছিলেন, সেদিন বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর বুশরার সঙ্গে ছিলেন তিনি। রাতে বুশরাকে রামপুরায় পৌঁছে দেওয়ার পর তাকে আর পরিচিতজনরা দেখেনি। মামলার তদন্তে নেমে ডিবি ফারদিনের মোবাইল ফোন ট্র্যাক করে ওই সময়ের পর ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীর তীরের উল্টো দিকে কেরানীগঞ্জে, সদরঘাটে, গুলিস্তানে এবং সর্বশেষ যাত্রাবাড়ীতে তার অবস্থান শনাক্ত করে।

গত ১৭ নভেম্বর ডিবি কর্মকর্তা হারুন বলেছিলেন, একটি সিসি ক্যামেরার ভিডিওতে ফারদিনকে রাত ২টায় যাত্রাবাড়ী থেকে রূপগঞ্জের তারাবগামী একটি লেগুনায় উঠতে দেখা গিয়েছিল। তিনি বুধবার বলেন, বুশরাকে নামিয়ে দিয়ে রাত ৯টার পরে কেরানীগঞ্জের একটি ব্রিজের কাছে গিয়েছিল, এরপর সেখান থেকে জনসন রোডে যায় এরপর গুলিস্তান হয়ে যাত্রাবাড়ীতে যায়। রাত ২টা ৭ মিনিটে লেগুনাতে উঠে। পরে ২টা ৩৪ মিনিটে সুলতানা কামাল ব্রিজে যায়। যে সমস্ত জায়গায় ঘোরাঘুরি করছে, এগুলো পর্যালোচনা করে আমরা দেখেছি সে একাই ছিল, তার সাথে কেউ ছিল না। এছাড়া সে যার যার সাথে কথা বলেছে, তাদের সাথে আমরা কথা বলেছি।

ডেমরার সুলতানা কামাল সেতুর উপর থেকে ফারদিন সেই রাতে ঝাঁপ দিয়েছিলেন বলার পক্ষে প্রমাণ মেলার কথা বলেন ডিবি কর্মকর্তা হারুন। ২টা ৩৪ এর দিকে আমরা দেখেছি, সেখান থেকে একটা শব্দ পানিতে পড়েছে এবং ওই সময়ই আমরা যে মোবাইল পর্যালোচনা করেছি, তাতে ওই সময়ে তার সেখানেই থাকার কথা। ওই রাতে সেই শব্দ কীভাবে শনাক্ত করেছেন, সে বিষয়ে বিস্তারিত বলেননি ডিবির এই কর্মকর্তা। আমরা তার মানসিক অবস্থা, তার বিভিন্ন জায়গায় চলাচল এবং ব্রিজের কাছে গিয়ে আমরা যে সেলটা দেখলাম, সেখানে ব্রিজের মাঝামাঝি জায়গায় সে ছিল সর্বশেষ এবং সেখান থেকে আমরা আবছাভাবে যে পানির মধ্যে একটা শব্দ হয়েছে, সেটা আমরা ব্রিজ থেকেও পেয়েছি। এই সবকিছু মিলিয়ে আমার কাছে আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়েছে, এইটা একটা সুইসাইডাল ঘটনা।

আত্মহত্যা মানতে নারাজ সহপাঠীরা : ফারদিন নূর পরশ আত্মহত্যা করেছেন বলে র‌্যাব-পুলিশ তদন্তে পাওয়ার দাবি করলেও তা মানতে নারাজ বুয়েটে তার সহপাঠীরা। সহপাঠী মো. শাফী বলেন, পরীক্ষার ফলাফল বা সিজিপিএ নিয়ে ফারদিনকে আমরা কখনও ডিপ্রেসড দেখি নাই। ফারদিন মৃত্যুর আগে আমাদের সঙ্গে ১০ দিন একটা সার্ভে করেছে। সার্ভে শেষে পরীক্ষার আগের রাতে সারা ঢাকা ঘুরে ঘুরে সুইসাইড করেছে! এটা কি বিশ্বাসযোগ্য? সুইসাইড করার জন্য তো বাসা আছে, হল আছে, নিজের রুম আছে। এত ঢং করে আত্মহত্যা করবে কেন? তিনি বলেন, পুলিশ প্রায় দুই মাস ইনভেস্টিগেট করে গতকাল (মঙ্গলবার) ডিপার্টমেন্ট থেকে ওর রেজাল্ট শিট নিয়েছে। গতকাল রেজাল্ট নিয়ে আজকেই ডিক্লেয়ার করে দিল, এটা সুইসাইড। এটা তো প্রথম দিনই করতে পারত। এটা ডিক্লেয়ার করতে তো দুই মাস লাগার কথা না।

শাফী বলেন, বলা হচ্ছে, বিদেশ যেতে অর্থ জোগাড় করতে না পারার হতাশা থেকে আত্মহত্যা করেছে। টাকার জন্য বুয়েট শিক্ষার্থী কখনও আত্মহত্যা করতে পারে না। বুয়েট শিক্ষার্থীরা এতটা গোবর নয়, রেজাল্ট দিয়ে জীবনকে জাজ করবে, ফারদিন তো অবশ্যই না। ডিবেটে তার পারফর্মেন্স দেখলেই এটা বোঝা যায়। প্রাথমিক পোস্ট মর্টমে ডাক্তার কিন্তু বলেছিল, তার গায়ে আঘাত, মাথায় আঘাত পেয়েছে। তখন বলা হয়েছে, এটা পরিকল্পিত হত্যা। দুই মাস পরে কেন সুইসাইড বলা হচ্ছে?

মাশিয়াত জাহিন নামের ফারদিনের আরেক সহপাঠী বলেন, আত্মহত্যার বিষয়টি আমরা সহপাঠীরা কেউই বিশ্বাস করছি না। আমাদের একটা সার্ভে (জরিপ) করতে হয়েছিল, সেটা শেষ করে সে যায়। সেটি ১০ দিন সারারাত সারাদিন ফিল্ডে থেকে করতে হয়েছে। যারা তার সাথে ছিল, তারা সবাই ফারদিনকে উৎসাহ নিয়ে কাজ করতে দেখেছে। যার মধ্যে মরে যাওয়ার মোটিভ থাকবে, সে তো ১০ দিন ধরে এই উৎসাহ নিয়ে কাজ করত না।

মাশিয়াত বলেন, ডিবি যখন নদীতে ঝাঁপ দেওয়ার কথা বলছে, তার কয়েক ঘণ্টা আগেও সে অন্য একজনের সাথে সময় কাটিয়েছে, খাওয়া-দাওয়া করেছে, কথা-বার্তা বলছে, কোনো অস্বাভাবিকতা দেখা যায়নি। স্পেনে বিতর্ক করতে যাওয়া নিয়েও অনেক এক্সাইটেড ছিল। টাকা নিয়ে ডিবি যেটা বলছে সেটা সিভিয়ার কোনো সমস্যা না, ওটা ম্যানেজ হয়ে যেত, কোনো স্পন্সর ম্যানেজ হয়ে যেত। আর রেজাল্ট তেমন খারাপও ছিল না, ভালোও ছিল না (কোনো ফেল ছিল না) কিন্তু সে সহ-শিক্ষা কার্যক্রমে তো এগিয়ে আছে। শুধু রেজাল্টের জন্য কখনোই সুইসাইড করার প্রশ্নই আসে না।

তিনি বলেন, এজন্য আমরা কালকে (আজ) কর্মসূচিও ডেকেছি। আমরা সেখানে পয়েন্ট বাই পয়েন্ট কথা বলব যে কেন আত্মহত্যার বিষয়টি বিশ্বাসযোগ্য না। সহপাঠীরা জানান, বুয়েটের শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে বুয়েট শহীদ মিনারে বৃহস্পতিবার সকালে ব্রিফিং ও প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে।

ফারদিনের বাবা নূরউদ্দিন রানা বুধবার সাংবাদিকদের বলেন, ডিবি ও র‌্যাবের বক্তব্যে আমি কনভিন্সড না। রামপুরার পর ফারদিনের যেসব (সিসি ক্যামেরার) ভিডিও দেখানো হয়েছে তার কোনোটিই স্পষ্ট নয়। ডেমরার সুলতানা কামাল সেতু থেকে থেকে ফারদিন ঝাঁপ দিয়েছে বলে যে কথা বলা হচ্ছে তারও কোনো স্পষ্ট ভিডিও নেই। সেখানে ঢেউ দেখা যায়। কিন্তু ফারদিনই যে সেখান থেকে লাফিয়ে পড়েছে, তার গ্যারান্টি কী। এটা তো অন্য কেউ হতে পারে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রেস ক্লাব বার্ষিক ক্রীড়া ব্যাডমিন্টন ইভেন্ট শুরু
পরবর্তী নিবন্ধঅনূর্ধ্ব-১৪ ক্রিকেটারদের জ্ঞাতার্থে