প্রিয় ক্যাম্পাসে বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস

আইআইইউসির ৫ম সমাবর্তন আধুনিক শিক্ষার পাশাপাশি কর্মমুখী শিক্ষায় দক্ষ হতে হবে : শিক্ষা উপমন্ত্রী

আজাদী প্রতিবেদন | সোমবার , ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৪:৩২ পূর্বাহ্ণ

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক থেকেই দেখা যাচ্ছিল ক্যাম্পাসের প্রবেশপথ। পথ জুড়ে বর্ণিল সাজ। একাধিক নিরাপত্তা গেট অতিক্রম করে মিলছে মূল অনুষ্ঠানস্থলে প্রবেশের অনুমতি। পুরো ক্যাম্পাস ব্যানার-ফেস্টুনে সাজানো। যুতসই স্পটগুলোতে স্থাপন করা হয়েছে ছবি তোলার ঘর। স্পটগুলোতে ভিড়।
শরীরে কালো গাউন, মাথায় টুপি। কারো কারো গাউনের রং আলাদা। দলে দলে ছবি তোলায় ব্যস্ততা। কেউ তুলছেন সেলফি। চোখে-মুখে উচ্ছ্বাস। এরা সবাই গ্র্যাজুয়েট। পুরনো ক্যাম্পাসে এসে প্রিয় সহপাঠীদের কাছে পেয়ে আবেগে আপ্লুত সবাই। কোলের সন্তান নিয়েও এসেছেন কেউ কেউ। তাদের বাঁধ ভাঙা উচ্ছ্বাস জানান দেয়, সমাবর্তনের দিন আজ। আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামের (আইআইইউসি) ৫ম সমাবর্তনের চিত্র এটি। চট্টগ্রাম শহর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে সীতাকুণ্ডের কুমিরায় বিশ্ববিদ্যালয়টির স্থায়ী ক্যাম্পাস। সমাবর্তন উপলক্ষে গতকাল সেখানে দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালা ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়টির চ্যান্সেলর রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ মনোনীত প্রতিনিধি হিসেবে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী সমাবর্তনে সভাপতিত্ব করেন।
সমাবর্তন বক্তা ছিলেন ইমেরিটাস অধ্যাপক ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ড. আইনুন নিশাত। বিশেষ অতিথি ছিলেন আইআইইউসির বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দীন নদভী এমপি এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য বিশ্বজিৎ চন্দ। স্বাগত বক্তব্য রাখেন আইআইইউসি উপাচার্য প্রফেসর আনোয়ারুল আজিম আরিফ। সমাবর্তনে মোট ১৫ হাজার ৩৬১ জনকে
সনদ বিতরণ করা হয়। এদের মধ্যে স্নাতক পর্যায়ে ৯ হাজার ৪৫৯ জন এবং স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ৫ হাজার ৯০২ জন। গ্র্যাজুয়েটদের মধ্যে চ্যান্সেলর স্বর্ণ পদক দেওয়া হয় ৩৬ শিক্ষার্থীকে। ভাইস চ্যান্সেলর অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয় ১৩৭ জন শিক্ষার্থীকে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রথমবারের মতো প্রবর্তন করেছে বোর্ড অব ট্রাস্টি চেয়ারম্যান স্বর্ণপদক। প্রথমবারের মতো শরীয়াহ অনুষদের শিক্ষার্থী জোবাইদুন নাহার পান্নাকে গতকাল এ পদক দেওয়া হয়।
সভাপতির বক্তব্যে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেন, আধুনিক শিক্ষার পাশাপাশি কর্মমুখী শিক্ষায় গ্র্যাজুয়েটদের দক্ষ হতে হবে। গ্র্যাজুয়েটদের এক থেকে দুই শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষক হতে পারে, কিন্তু বাকিরা দক্ষতা না থাকায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরির বাজারে পিছিয়ে পড়ছে।
তিনি বলেন, আমাদের শিক্ষার্থীরা বহির্বিশ্বের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিজেদের আরো বেশি করে বিকশিত করার জন্য একাধিক ভাষা শিক্ষা নেওয়া দরকার। নীতি ও নৈতিকতার মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞান কখনো বৃথা যায় না। একটি সুশৃঙ্খল রাষ্ট্র, সমাজ ব্যবস্থার জন্য ধর্মীয় শিক্ষা ও নৈতিকতা চর্চার প্রয়োজন রয়েছে। কিন্ত পঁচাত্তরে জাতির জনককে নির্মমভাবে হত্যার পর এক শ্রেণীর স্বার্থবাজ মানুষ ইসলাম ধর্ম নিয়ে রাজনীতি শুরু করে, যা দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করে। ধর্ম মানে অরাজকতা নয়। ইসলাম কখনো অরাজকতাকে প্রশ্রয় দেয় না।
গ্র্যাজুয়েশনপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে শিক্ষা উপমন্ত্রী বলেন, প্রতিষ্ঠান থেকে পাওয়া শিক্ষা বা ডিগ্রি নিয়ে বসে থাকলে চলবে না। ডিগ্রি অর্জন সবকিছু নয়, নীতি নৈতিকতা শিক্ষাই প্রধান। কর্মক্ষেত্রে সময়ের চাহিদার সঙ্গে মানিয়ে নেয়ার জন্য নিজেদের প্রস্তুত করতে হবে। শিক্ষিত হয়ে আত্মঅহমিকা ত্যাগ করতে হবে। কোনো কর্মই ছোট নয়। দেশে ও বিদেশে প্রতিটি স্থানে নিজেদের কর্মোপযোগী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
তিনি বলেন, বর্তমান সময়ে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে বিশ্ব নাগরিক হওয়ার লক্ষ্যে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি বিষয়ভিত্তিক দক্ষতা অর্জন করতে হবে। প্রতিযোগিতামূলক এই বিশ্বে টিকে থাকতে হলে স্কিল বেইজ প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষিত হতে হবে।
তিনি বলেন, ইসলাম মানে মওদুদীবাদ নয়। আমরা ইসলামের মূল আদর্শ ও অনুশাসন থেকে সরে যাচ্ছি। ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার করলে কীভাবে সমাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেটা বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী হিসাবে পরবর্তীতে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। আর সে কারণেই তিনি তাঁর রাষ্ট্রচিন্তায় ধর্মনিরপেক্ষতা সংযুক্ত করেছিলেন। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। শিক্ষা ক্ষেত্রে সারা দেশে আইআইইউসির সুনাম রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখানে আন্তর্জাতিক মানের পরিবেশে পাঠদান চলে।
সমাবর্তন বক্তৃতায় প্রফেসর ইমেরিটাস ড. আইনুন নিশাত বলেন, আজ থেকে প্রাতিষ্ঠানিক পাঠ শেষ হলেও জীবনের পাঠ শুরু। শিক্ষার শেষ নেই, বর্তমান প্রতিযোগিতার যুগে নিজেকে বিশেষভাবে সক্ষম বা বিষয়ভিত্তিক পারদর্শী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষার মাধ্যমে জীবনকে উপভোগ করুন। বিষয়ভিত্তিক পারদর্শী হলে আনন্দ পাওয়া যায়।
তিনি বলেন, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তি হচ্ছে ইসলামভিত্তিক জ্ঞান। ইসলাম কিংবা যেকোনো ধর্ম মানুষকে সৎপথে চলতে, প্রতিবেশীকে ভালোবাসতে, গুরুজনকে সেবা করতে এবং সমাজ ও দেশের সেবা করতে শিখিয়েছে। তথাকথিত আধুনিকায়নের নামে সমাজ কেমন যেন বদলে যাচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘এথিকস’ বিষয়ে বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে। আধুনিক সময়ে সমাজে এথিকস কর্মপন্থার বড়ই অভাব। আজকে লজ্জার সাথে বলতে হচ্ছে, দেশের প্রতিটি পেশায় সততা ও এথিকসের বড়ই অভাব। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এ ব্যাপারে তেমন কিছু করছে বলে আমার জানা নেই। এই বিশ্ববিদ্যালয় যদি এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ভূমিকা পালন করে, একজন নাগরিক হিসেবে আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, সমগ্র জাতি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে।
আইআইইউসি বোর্ড অব ট্রাস্টের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. আবু রেজা মোহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভী এমপি বলেন, আইআইইউসির গ্র্যাজুয়েটরা আলোকবর্তিকা। তারা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে। বিশ্বের নানা প্রান্তে যখন আমি যাই, তখন আইআইইউসির গ্র্যাজুয়েটদের সাথে আমার দেখা হয়। তখন আমার গর্ববোধ হয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন প্রক্রিয়ার সঙ্গে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে সম্পৃক্ত। মধ্যপ্রাচ্যসহ মুসলিম বিশ্বের নানা দেশ থেকে আমি আইআইইউসির জন্য অনুদান এনেছি। আইআইইউসি দেশের উচ্চশিক্ষায় আজ অনন্য অবদান রাখছে।
তিনি বলেন, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে ও আশপাশের এলাকায় আজ সরকারের টাকায় পিচঢালা সড়ক হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে বয়ে চলা খালে স্লুইচ গেট নির্মাণ করা হচ্ছে। সেখান থেকে প্রয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয়ে পানি ব্যবহার করা যাবে। এই খাল একটি মিনি হাতিরঝিল হবে। ইতোমধ্যে এই প্রকল্পের জন্য ২২ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে। এটি একটি পিকনিক স্পট হবে। ভবিষ্যতে গ্র্যাজুয়েটরা এসে এখানে অনুষ্ঠান করতে পারবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য বিনামূল্যে পরিবহন চালু আছে, যার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ১ কোটি ২৫ লাখ টাকা খরচ করে; যেটি দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে বিরল। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনটি নতুন বিভাগ খোলা হচ্ছে, যা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। নানা উন্নয়নের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত বিশ্ববিদ্যালয়ের চেহারা পাল্টে যাচ্ছে; যার প্রমাণ আপনারা দেখতে পাচ্ছেন। ২০২৩ সালের মে ও জুন মাসের দিকে আরো একটি সমাবর্তন আয়োজনের ইচ্ছে রয়েছে। মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে সে সমাবর্তনে আমরা আমন্ত্রণ জানাব। ততদিনে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমূল পরিবর্তন আসবে বলে ঘোষণা দেন তিনি।
সমাবর্তনে স্বাগত বক্তব্য রাখেন আইআইইউসির উপাচার্য প্রফেসর আনোয়ারুল আজিম আরিফ। উপস্থিত ছিলেন উপ-উপাচার্য প্রফেসর ড. মছরুরুল মওলা, ট্রেজারার প্রফেসর ড. মুহাম্মদ হুমায়ুন কবির, শরীয়াহ ও ইসলামিক স্টাডিজ অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. শাকের আলম শওক, বিজ্ঞান ও প্রকৌশল অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. আকতার সাঈদ প্রমুখ। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিওটির সদস্য খাদিজাতুল আনোয়ার সনি এমপি, বিওটির সদস্য রিজিয়া রেজা চৌধুরী, চবি উপাচার্য প্রফেসর ড. শিরীণ আখতার ও চবি উপ-উপাচার্য প্রফেসর ড. বেনু কুমার দে উপস্থিত ছিলেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজঙ্গল সলিমপুরের ৩১ বাসিন্দা গ্রেপ্তার
পরবর্তী নিবন্ধরেমিট্যান্স প্রেরকরা ডলার প্রতি পাবেন সর্বোচ্চ ১০৮ টাকা, রপ্তানিকারকরা ৯৯