প্রসঙ্গ : ‘চুল এত বড় কেন’

পংকজ দেব অপু | রবিবার , ৩ অক্টোবর, ২০২১ at ৫:২৬ পূর্বাহ্ণ

শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে অচল শিক্ষায়তন। বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, সিরাজগঞ্জের রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় ‘সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বাংলাদেশ অধ্যয়ন’ বিভাগের ১৪ জন শিক্ষার্থীর চুল কেটে দিয়েছেন তাদের বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান ফারহানা ইয়াসমিন বাতেন। শিক্ষক কেন নরসুন্দরের ভূমিকা পালন করলেন আমরা সে সম্পর্কে সংক্ষেপে জেনে নিই।
সেপ্টেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রথমবর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষার সময়সূচি ঘোষণা করে। তাতে দুটো পরীক্ষার মধ্যে কোন বিরতি না থাকায় শিক্ষার্থীরা বিভাগে এর প্রতিবাদ করে। আনুষ্ঠানিকভাবে কর্তৃপক্ষ বরাবর একটি স্মারকলিপি লিখেও চেয়ারম্যানের ভয়ে সেটি জমা দিতে পারেনি শিক্ষার্থীরা।
২৬ সেপ্টেম্বর ছিলো ‘রাষ্ট্রবিজ্ঞান পরিচিতি’ বিষয়ের পরীক্ষা। পরীক্ষার হলে ঢোকার মুখে চেয়ারম্যান বলেছিলেন কারা আন্দোলন করতে চেয়েছে তিনি সেটা জানেন। এরপর কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে একজন ছাত্রের চুলের মুঠি ধরে জিজ্ঞেস করেন ‘চুল এত বড় কেন’?
এরপর চুল মুঠোয় ধরা যায় যাদের এরকম ১৪ জনকে আলাদা করে পরীক্ষার হলের বাইরে দাঁড় করিয়ে বিভাগের এক কর্মচারীকে কাঁচি আনতে বলা হয়। তারপর প্রত্যেকের চুল কেটে দেয়া হয়। এবড়োথেবড়ো চুল দেখে কেঁদে কেঁদে এক শিক্ষার্থী বলে ‘গ্রামে শুনেছি, অনৈতিক কাজ করলে চুল এইভাবে কাটা হয়। আমি সবাইকে কি বলবো, বলতে পারেন?’ ফেসবুকে কাটা চুলের ছবি পোস্ট দেয়া হলে অল্পসময়ে সেটা ভাইরাল হয়। এর প্রতিবাদে ২৭ সেপ্টেম্বর রাত থেকে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ শুরু করে। অনেকে অভিযোগ করে আসছে চুল কেটে চূড়ান্ত অপমান করা হোলো শিক্ষার্থীদের, এর আগে তিনি ধমকাধমকি হুমকি ও ভয়ভীতি প্রদর্শনও করেছেন নানাভাবে।
এভাবেই ধমকাধমকি করে, ভীতি প্রদর্শন করে শিক্ষার্থীদের তিনি কী বার্তা দিলেন সেটা কি একবারও ঠান্ডা মাথায় ভেবেছেন? সন্তান সমতূল্য শিক্ষার্থীদের অন্তর স্পর্শ করার বদলে তিনি জোরজবরদস্তি কেন বেছে নিলেন বোঝা গেল না। তিনি কি তবে মানসিক রোগী? টিনএজ পার হওয়া কোমলমতি শিক্ষার্থীদের অন্তরের ভাষা কি পাঠ করার কখনো চেষ্টা করেছেন তিনি? আমরা কি আমাদের শিক্ষা-জীবনের স্মৃতিময় দিনগুলো একবার স্মরণ করতে পারি না? সে বয়সেই তো আমরা ক্লাসের ফাঁকে বারবার আয়নার সামনে এসে দেখতাম চুল ঠিক আছে কিনা অথচ সেই চুলের মুঠি ধরে ম্যাডাম শুধু টানাটানিই করলেন না, এবড়োথেবড়োভাবে কেটেও দিলেন। সবার সামনে চুল কেটে দেয়ার ঘটনা ব্যাপক প্রচারের পর ‘নাজমুল হাসান’ নামের এক ছাত্র সোমবার রাতে অতিরিক্ত ঘুমের ঔষধ খেয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করে (সূত্র: প্রথমআলো)।
নৈতিকতার মাপকাঠিতে আমরা যদি এই ঘটনার নিরপেক্ষ মূল্যায়ন করি, তবে জোর দিয়ে বলতে পারি চুলকাটার এমন নির্দয় সিদ্ধান্ত ‘ফারহানা ইয়াসমিন’ নামের সেই শিক্ষক নিতে পারেন না। সরকারি সিদ্ধান্তে বহু আগেই শিক্ষকদের হাত থেকে বেত কেড়ে নেয়া হয়েছে। তার কারণ হলো আদর দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে সম্মানিত শিক্ষকরা তাদের প্রিয় শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদান করবেন। শিক্ষকদের আন্তরিক স্নেহে শিক্ষার্থীদের মনোজগৎ আলোকিত হবে। তারা শিক্ষকদের উগ্রমূর্তি অন্তরের আয়নায় ধারণ করে নিজেকে রুক্ষ শিক্ষকের মতো অসুন্দর করে গড়ে তুলবে না, হয়ে উঠবে দারুণ সহমর্মী একজন আলোকিত মানুষ হিসেবে।
আমাদের দুর্ভাগ্য কিছুসংখ্যক শিক্ষক তার ব্যক্তি-জীবনের রাগ-দুঃখ-হতাশা ঝাড়তে খুঁজে নিয়েছেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। শিক্ষার্থীর কোমল মনে আঘাত দিয়ে, তাদের বকাঝকা করে, কষ্ট লাঘব করার অপপ্রয়াস চালাচ্ছেন, তা কোনোভাবেই গ্রহণীয় নয়। আইন হাতে তুলে নিয়ে এসব অসহিষ্ণু শিক্ষক নামধারী ব্যক্তি অনেক উচ্চতম অবস্থানে অধিষ্ঠিত শিক্ষক সমাজ কে কলঙ্কিত করছেন।
দুটি সত্য ঘটনা বলব। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের অনার্স পরীক্ষার ফলাফল দিয়েছে। আমাদের এক বন্ধু অনার্স পরীক্ষায় তৃতীয় শ্রেণি পেয়ে দারুণ হতাশ। সান্ত্বনা পাওয়ার জন্য আমি তাকে নিয়ে গেছি আমাদের বিভাগীয় চেয়ারম্যান-এর কাছে। কথা শুনেই চেয়ারম্যান স্যার ক্ষেপে গিয়ে বললেন-লেখাপড়া করোনি। রেজাল্ট খারাপ তো হবেই। তোমার সাথে কি শত্রুতা আছে স্যারদের? বন্ধু বলল-২ বছরে আমার নম্বর যা, তৃতীয় বর্ষে কম পেলেও আমি তৃতীয় বিভাগ পেতে পারি না। স্যার তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে বললেন-তুমি কৈফিয়ত চাও ? যাও বেরিয়ে যাও। বাজে কথা শোনার সময় কোথায় আমার ? প্রচন্ড হতাশা নিয়ে সেদিন স্যারের কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম। বারবার চোখে ভেসে ভেসে উঠছিল সেই উগ্র শিক্ষকের মুখ। বন্ধু সান্ত্বনার বদলে ধমক খেয়ে দারুণ বেসামাল হয়ে নেশাভাং দিয়ে শুরু করলো তার উচ্ছৃঙ্খল জীবন। মার্কসশিট হাতে পেয়ে দেখা গেলো-১০০ নম্বর যোগ না করার কারণে তার এমন ‘ফলাফল বিপর্যয়’ হয়েছে। ছেলে বলে সে নেশাসক্ত হয়েছে, মেয়ে হলে হয়তো আত্মহত্যা করতো। মার্কসশিট নিয়ে স্যারের কাছে আবার গিয়েছিলাম তার অসুন্দর আচরণের প্রতিবাদ জানাতে। তখন তিনি নমনীয় কন্ঠে শুধু বলেছিলেন ‘সরি’।
পরবর্তী ঘটনা আমার কলেজের। কতগুলো ছাত্রী ক্লাস ফাঁকি দিয়ে শিক্ষকদের আবাসিক ভবনে আমাদের টিউবওয়েলের পানি পান করতে গিয়েছিল। একজন সিনিয়র শিক্ষক তাদের দেখে প্রচণ্ড রেগে গেলেন, হঠাৎ মেজাজ হারিয়ে বললেন- ক্লাস ফাঁকি দিচ্ছো ? জুতিয়ে একদম মুখ সোজা করে দেবো। স্যারের কথা শুনে ছাত্রীদের মুখের অবস্থা এমন হল সঙ্গে থাকা আমি সেটা দেখে খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। পরবর্তীতে ছাত্রীদের আমি সান্ত্বনার বাণী শুনিয়ে ছিলাম। আমি আমার সহকর্মীকে এরকম আচরণ সম্পর্কে কিছু বলতে না পারলেও নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করেছিলাম ‘জুতা’ শব্দটির ব্যবহার না করে তিনি কি তাদেরকে হালকাভাবে বকাবকি করতে পারতেন না? তাহলে হয়তো আমার শিক্ষার্থীরা ‘শিক্ষক’ আর‘ চর্মকার’ এর পার্থক্য সহজে বুঝতে পারতো।
চুলকাটার প্রসঙ্গ এলো বলেই আমরা হয়তো পরম সম্মানিত ‘শিক্ষক’ শব্দটিকে কাঠগড়ায় দাঁড় করালাম। এভাবেই যুগে যুগে অনেক শিক্ষক শিক্ষার্থীর মনোবেদনার কারণ হয়েছে। প্রিয় স্যারদের বলছি-একটু ভাবুন তো, আপনার সন্তান যদি তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তার শিক্ষক কর্তৃক নিগৃহীত হয়, অন্যায় শাস্তির মুখোমুখি হয়ে আত্ম হননে উদ্বুদ্ধ হয় আপনি কি সেই অনৈতিক অত্যাচারী শিক্ষককে কখনো ক্ষমা করতে পারবেন ?
অধ্যাপক ফারহানা ইয়াসমিন তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন-এটা তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, এরকম কোনো ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটেনি। তবে আমাদের কৌতূহল ‘নাজমুল হাসান’ কেন আত্মহত্যা করতে গেলো ? তার অবস্থা আশঙ্কামুক্ত নয়। প্রিয় শিক্ষকবৃন্দ, লেখাপড়ার পাশাপাশি আপনার কাছেই তো শিক্ষার্থীরা শিখবে আচরণ, যা তাদেরকে ভালো মানুষ হতে সাহায্য করবে। আপনি যদি সুন্দর আদর্শের পতাকা তার সামনে তুলে ধরতে ব্যর্থ হন, তবে এর পরিণতি হবে ভয়াবহ। পাদটীকা : ফারহানা ইয়াসমিনের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিটি (সমকাল)।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, বাংলা বিভাগ,
নানুপুর লায়লা-কবির অনার্স কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রাণ ফিরে আসুক সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান
পরবর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে