দেশ হতে দেশান্তরে

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ৩ অক্টোবর, ২০২১ at ৫:২৭ পূর্বাহ্ণ

সীমাহীন বেগ ও মুফতে পাওয়া উদ্বেগ

লাভের লাভ তো কিছুই হয় নি, বরং যা হয়েছিল তা হল মনের ভেতর অনিশ্চয়তাজনিত ভীষণ চাপ এক! অনেকদিন আগে, মানে যে সময়টাকে ধরা হয়ে থাকে দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লবের সময়, সেই সময়ে চল্লিশ দশকের শেষ দিকে না জানি পঞ্চাশের দশকের শুরুতে, আমাদের প্রথিতযশা সাহিত্যিক বিনয় মুখোপধ্যায় মানে যাযাবর বাবু লিখেছিলেন ‘আধুনিক বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ।’ আর এখন, এই মুহূর্তে বেইজিং এর রিজেন্ট হোটেলের সীমানা পেরিয়ে তিয়েন আন মেন মুখি আমাদের যাত্রায় যখন মূল রাস্তায় গাড়ি উঠছে, তখন কি না যাযাবর বাবু নখের যোগ্য নই যে আমি, তার কি না মনে হচ্ছে; আজকের এই ডিজিটাল সময়, যেটিকে নাকি বলা হচ্ছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের কাল, এ কালে বিজ্ঞান মানুষকে অবশ্যই দিয়েছে সীমাহীন বেগ সাথে মুফতে পাওয়া গেছে ততোধিক উদ্বেগ!
খুব বেশী দিন আগের কথা তো নয়। এই আমিই তো আশি এমনকি নব্বই দশকে, বাংলাদেশেরই এক জেলা থেকে আরেক জেলায় ফোন করার জন্য টেলিফোন অফিসে ফোন করে যাকে নাকি বলা হতো ট্রাঙ্ক কল, তা বুক করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতাম চাতক পাখির মতন। তখন তো মনে এমন চাপ তৈরি হতো না। বরং ফোন বুক করে তো নিশ্চিন্তে করতে থাকতাম অন্যসব কাজ। তাহলে হলোটা কি লাভ আমার কিম্বা গোটা মানবজাতির এখন, এক সময় যা অকল্পনীয় ছিল,সেরকম দ্রুতগতিতে যোগাযোগ স্থাপনের উপায় হাতে হাতে আসার পর? বরং মনে তো হচ্ছে এতে মানুষের ধৈর্যশক্তি কমে গেছে ভয়াবহভাবে, সাথে যোগ হয়েছে মনের ভেতর যখন তখন তৈরি হওয়া অকারন কালাপাহাড় জাতীয় চাপের বোঝা! অতএব বেজেছে মানসিক শান্তির বারোটা! আর মানসিক শান্তি না থাকলে, দেহে কি করে শান্তি বাঁধবে বাসা? খুব বেশী জোরে না হলেও মোটামুটি গতিতে চলতে থাকা শকটের গতি এসময় কমে আসতেই, তার কার্যকারণ নির্ণয়ে উইন্ডশিল্ডের বাইরে নজর যেতেই দেখা গেল একটা জ্যামের মতো অবস্থা সামনে। ড্রাইভারের সিটের পাশে বসে থাকার কারনে আগে থেকেই অবশ্য চোখ আমার বাইরেই ছিল অবশ্যম্ভাবীভাবে। কিন্তু মনের ভেতরের দুশ্চিন্তার বেগ, উদ্বেগের ঝড়ের কারণে, বাইরের দৃষ্টিগোচর থাকেলও, আসলে দেখছিলাম না কিছুই। বরং সেই দেখাদেখির শুরুটা হলো এইমাত্রই; আর তাতে ঘন ধোঁয়াশার চাদরে ঢাকা রাস্তা আর আশেপাশের দৃশ্যকে কেমন যেন যাকে বলে মেন্দা বা ম্যাড়ম্যাড়ে ভাবের বলেই মনে হল।
আচ্ছা উঠেছি এখন কোন রাস্তায়? উদ্বেগের কারণে আশপাশ নিয়ে খুব সচেতন না থাকলেও একদম অচেতন তো ছিলাম না এতক্ষণ। হোটেলচত্বরের পিক আপ ড্রপ এলাকা থেকে বেরুবার জন্য, লি খাঁ সামনের দিকে গাড়ি চালিয়ে, বা দিকে বাঁক নিয়ে হোটেলের সামনের সেই বাগান ঘেঁষে প্রথমে উঠে পড়েছিল এয়ারপোর্ট থেকে শহরের দিকে আসা সেই সদর রাস্তাতেই ততটুকু বুঝ আমার ছিল।এও বুঝেছি সে রাস্তায় উঠেছিল সে, সেই জায়গা দিয়েই, যেখানে গত সন্ধ্যায় নেমেছিলাম বাস থেকে। ওখান থেকে মূল রাস্তায় ওঠার জন্য লি খাঁ ডানে মোড় নিয়ে সদর রাস্তায় উঠে, কিছুদুর সামনে এগিয়ে ইউটার্ন নিয়ে ফের চালাচ্ছিল গাড়ি সোজা সরল রেখাতেই, এই জ্যামের দেখা পাওয়ার আগ পর্যন্ত তাও মনে পড়ল। যার মানে হচ্ছে আছি এখনো সেই সদর রাস্তাতেই যেটির অন্যপাশ দিয়ে গতকাল এসেছিলাম এয়ারপোর্ট থেকে। একদম থেমে থাকা জ্যাম না এটা। তাই চলছে গাড়ি ধীরে। হোটেল পিছনে ফেলে খুব বেশিদূর আসিনি এখনো নিশ্চয় , কারণ হয়েছে তো মাত্র মিনিট তিন, চার বা পাঁচ। গতরাতে খাবারের খোঁজে বেরিয়াছিলাম যখন একাকী, তখন হয়তো এর চেয়ে বেশিদূরই গিয়েছিলাম হেঁটে। তবে হেঁটেছিলাম যেহেতু রাস্তার ওই পাশ দিয়ে তাই বুঝতে পারছি না, আছি এখন ঠিক কোন জায়গায়? কারণ রাস্তার মাঝামাঝি লেনে থাকায়, আমাদের বা পাশে চলতে থাকা গাড়ির পর যে আইল্যান্ড আছে, তা পেরিয়ে রাস্তার ওপাশের দোকান পাঠ বা দালানের নীচতলা তো নজরে আসছে না।
অবশ্য তা দেখতে পেলেই বা কি? তাতেই কি বুঝতে পারতাম না কি যে আছি কোথায় । রাতের অন্ধকারে এই এলাকায় প্রথম এসে, আজীবনের দিককানা আমি তার কতোটাই বা করতে পারতাম হদিশ। তার উপর রাতে আর দিনে তো দেখছি এ রাস্তার আবহ পাল্টে গেছে এক্কেবারে দিনে রাতে, তবে তা উল্টাভাবে। রাতের অন্ধকারকে বেইজিং ধোঁয়াশা যতোই জাপটে ধরুক না কেন, গোটা পাথের দু পাশে, উপরে আর আশে পাশের দালানের গায়ে নানান রংয়ের বাতি নানান ডিজাইনে জ্বলতে থাকায়, রাস্তাঘাটে তেমন লোকজন না থাকলেও গোটা এলাকাটায় ছিল একটা গমগমে উৎসব মুখর ভাব তখন। সেই জায়গায় এখন দিনের আলো ফোঁটার পর সেই লাইটগুলো সব নিভিয়ে দেয়ায়; লাগছে চারদিক কেমন যেন, যা বলেছিলাম ওই ম্যান্দা বা ম্যাড়ম্যাড়ে ভাবের। অবশ্য এই আলোয় সেই বাতিগুলো জ্বলতে থাকলেও অবস্থার যে খুব একটা উন্নতি হতো, তা মনে হয় না। কথায় আছে না রাতের “সব তারারাই আছে দিনের আলোর গভীরে”, ঘটনা হতো অনেকটা ঐরকম।

এরই মধ্যেই বেশ কিছুক্ষণ আগেই লি খাঁ বাড়িয়ে দিয়েছিল গাড়ির গতি। কারণ সামনের গাড়িরও যে বেড়ে গিয়েছিল গতি একইভাবে। ধারণা করলাম সামনে কোথাও আছে ট্রাফিক সিগন্যাল, যাতে লাল বাতি জ্বলে উঠাতেই একদম সামনের গাড়িগুলো থেমে থাকলেও, আমাদের মতো পেছনের গাড়িগুলো চলছিল ধীরগতিতে, নিজ নিজ লেনে। আর ট্রাফিক লাইট সবুজ হতেই, স্বভাবতই স্বয়ংক্রিয় ভাবেই সব গাড়ির গতিই গিয়েছিল বেড়ে। এদিকে গাড়ির পেছনের সিটে বরাবরের মতো চলছে দু ভাইয়ের গাড়ি দেখাদেখি নিয়ে কখনোবা হৈ হৈ উল্লাস আর কখনোবা মৃদু বচসা। আর সে বচসা উচ্চকিত হয়ে উঠতে নিলেই শোনা যাচ্ছে তা থামানোর জন্য পেছনে তাদের সহযাত্রী দুই পরাশক্তির কণ্ঠে বেজে উঠছে নানা স্বরে আর লয়ে পুত্রদের নিজেদের মধ্যে আপোষ রফা করে নেবার ব্যাপারে পরামর্শ, না হয় হুমকি ধামকি। অবশ্য পরাশক্তি বলে কথা! তাদের যে কোন সাধারণ পরামর্শকেও যে সবসময়ই, অবশ্য করণীয় নির্দেশ হিসাবে ধরে নেয়ার নিয়ম আছে এ গ্রহে, তা এখনো হয়তোবা আত্মস্থ করতে পারেনি আত্মজরা আমার।
এসময়েই মনে হল, আচ্ছা আমাদের এই তিয়েন আন মেন স্কয়ার ভ্রমণের ব্যাপারে একটা ছোটখাট ব্রিফিং দিয়ে দেয়া দরকার সবাইকে, যা এখনো দেয়া হয়নি। শুধু বলেছি এ বেলা যাচ্ছি আমরা তিয়েন আন মেন । ওইখানে কি কি দেখার আছে, সে ব্যাপারে বাইরের ধোঁয়াশার মতো আমারও ধোঁয়াশা ধারণা থাকেলও তাদের কার কি রকম ধারণা আছে , তা তো জানি না। অবশ্য সে ব্যাপারে সওয়াল জওয়াব শুরু করে এ মুহূর্তে গাড়ির ভেতরে একটা মৌখিক পরীক্ষা নেবার আবহ তৈরি করার মানে নেই। তা নিয়ে যতোটা জানি, বলবো তা ওখানে ঘুরতে ঘুরতেই। আপাতত শুধু জানিয়ে দেই আমার পরিকল্পনার কথাই, যদিও আমার মনে তেমন কোন পরিকল্পনাও নেই। শুধু ভেবে রেখেছি আর যাই হোক, প্রথমেই দেব গোটা তিয়েন আন মেন স্কয়ারে একটা চক্কর । যতোটা মনে পড়ছে চল্লিশ নাকি ৪৫ হেক্টর জমির জুড়ে বিদ্যমান এই বিশাল স্কয়ারে ১৯৪৯ সনের ১লা অক্টোবরে মাও সে তুং, সমাজতান্ত্রিক চায়না নামের যে কল্যাণকামী রাষ্ট্রের গোড়াপত্তনের ঘোষণা দিয়েছিলেন, সেই একই চত্বরে কি না তার ঠিক চল্লিশ বছর পর, ১৯৮৯ সনে ছাত্র জনতার ঢল নেমেছিল, সমাজতন্ত্র নামের সেই রাষ্ট্র কাঠামোটিকেই ধবসিয়ে দিতে! যা নাকি কঠোর হস্তে দমন করেছিল চায়নার তৎকালীন সমাজতন্ত্রী নেতারা। আর এতে প্রাণ দিতে হয়েছিল প্রায় হাজার দশেক মানুষকে।
এসব ভাবতে ভাবতে পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে সকলের উদ্দেশ্যে ব্রিফিং দেয়ার জন্য যেই না মুখ খুলতে যাচ্ছি, তখনই মনে হল লি খাঁ সোজা রাস্তা থেকে ডানে বাঁক নিয়ে উঠে পড়েছে আরেক রাস্তায়। একবার ভাবলাম ফের ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে এসেছি কোন জায়গায়। বা কোন জায়গায় এসে লি খাঁ নিলেন এই মোড়। কিন্তু সাথে সাথে বাতিল করে দিলাম সে চিন্তা এইভেবে যে, এই রাস্তা চিনে আর কী হবে? এই হিমসাগরে আমাদের তো আর হেঁটে হেঁটে ঘোরার প্লান নাই। যেখানেই যাই আজ আর আগামীকাল, লি খাঁই তো ভরসা। অতএব সে চিন্তা বাদ দিয়ে পরবর্তী দু তিন বা চার মিনিট ধরে জানালাম যে প্রথম দেব গোটা তিয়েন আন মেনে একটা চক্কর। কারণ ওইরকম একটা ঐতিহাসিক জায়গার শুধু এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে, চলে আসলে তো হবে না। যদিও জানি না, যে ওখানে তারা চিহ্নিত করে রেখেছে কি না, যে ঠিক কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে মাও সে তুং দিয়েছিলেন সেই ঘোষণা। আর ১৯৮৯ সনের তিয়েন মেন স্কয়ারে সরকার বিরোধী ছাত্র জনতার যে ঢল নেমেছিল, তা থামাতে গিয়ে এখানকার সরকার যে দমননীতি নিয়েছিল; সেটির প্রতি সারাবিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য ধান্দাবাজ পশ্চিমা মিডিয়া আগুয়ান ট্যাংক বহরের সামনে বুক চিতিয়ে থাকা যে যুবকটির ছবি বহুল প্রচার করেছিল, সেই জায়গাটি তো আর এরা অবশ্যই চিহ্নিত করে রাখবে না! তাও পুরো জায়গাটা ঘুরলেই না, মনে মনে হলেও তার একটা চিত্র খাড়া করা যাবে। অতএব ওটাতে একটা গোটা চক্কর না দিলেই নয়।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রসঙ্গ : ‘চুল এত বড় কেন’
পরবর্তী নিবন্ধকরোনাকালে বিশ্বের অতি ধনী ব্যক্তিরা ও তাঁদের প্রারম্ভিক জীবন