করোনাকালে বিশ্বের অতি ধনী ব্যক্তিরা ও তাঁদের প্রারম্ভিক জীবন

ড. নারায়ন বৈদ্য | রবিবার , ৩ অক্টোবর, ২০২১ at ৫:২৭ পূর্বাহ্ণ

২০২০ সালের প্রথম থেকে ২০২১ সালের শেষ পর্যায় পর্যন্ত বিশ্বে করোনা দাপটের সাথে বিরাজ করছে। কিছুদিন পর পর রূপ পাল্টিয়ে মানব জাতিকে কাবু করছে। প্রত্যেক দেশে হ্রাস পেয়েছে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। ফলে বিপুলসংখ্যক লোক ক্রমাগত বেকার হয়ে পড়ছে। বিশ্বে বেকারত্ব যতই বাড়ছে ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে দারিদ্র্য অবস্থা। স্পষ্টভাবে খাদ্যাভাব দেখা না দিলেও দরিদ্র পরিবারে মুখে তুলে নেয়া রুটি দিন দিন পাতলা হয়ে আসছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বেশ কিছুদিন আগে থেকেই হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করে আসছে। অথচ সমগ্র বিশ্বে এমন কি বাংলাদেশেও করোনাকালীন ধনীর পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। শুধুমাত্র বাংলাদেশে এ সময়ে ১১ হাজার মানুষ কোটিপতির ঘরে পৌঁছে গেছে। ইনভেস্টোপেডিয়া ও নিউজ ১৮ ডটকম এর তথ্যানুসারে ২০২১ সালে অতিধনীর তালিকায় আছে জেফ বেজোস, ওয়ারেন বাফেট, বিল গেটস, ইলন মাস্ক, মার্ক জাকারবার্গ ও রতন টাটা।
বর্তমান বিশ্বের অতিধনীদের সম্পদের বাহার দেখে অনেকেই অবাক হন। কিন্তু তাদের অনেকেই অতি ক্ষুদ্র কাজ করার মধ্য দিয়ে নিজদের কর্মজীবন শুরু করেন। মূলত দূরদর্শী কর্মপরিকল্পনা, কঠোর পরিশ্রম আর একাগ্রতার ফলেই তাঁরা নিজেদের অবস্থার পরিবর্তন করতে পেরেছেন। এ জগতের একটা অলিখিত নিয়ম হচ্ছে যে, অশিক্ষিত বা কম শিক্ষিত ও অনগ্রসর মানুষই ছোটখাটো কাজ করেন। কিন্তু কখনো কখনো ধনীদের জীবনেও এমন কাজ করতে দেখা যায়। কারণ পৃথিবীতে অনেকেই সোনার চামচ মুখে দিয়ে জন্ম নেননি। তাদের মেধা, কর্মপরিকল্পনা এবং কঠোর পরিশ্রমই তাদেরকে সাফল্যের শিখরে পৌঁছে দিয়েছে। ব্যক্তিগত জীবনে এ সাফল্যের সুবাদে তাঁরা নিজ নিজ দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জনে যেমন অবদান রেখেছেন, তেমনি বিশ্বজুড়ে মানবজাতির কাছেও অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে আছেন। এসব ধনী ব্যক্তিদের জীবনধারা, কর্মক্ষেত্র ও দেশ আলাদা হলেও কয়েকটি বিষয়ে বেশ মিল পাওয়া যায়। প্রথমতঃ যৌবনের প্রারম্ভে তাদের লক্ষমাত্রা ছিল অবিচল। দ্বিতীয়ত কর্মক্ষেত্রে সফলতা অর্জনের জন্য তাঁরা ছিলেন অবিচল ও কঠোর পরিশ্রমী। তাঁদের কয়েকজনের প্রারম্ভিক জীবন এবং তাঁদের সম্পদের পরিমান সম্পর্কে জানা যাক।
জেফ বেজোস: বিশ্বের শীর্ষ ধনী ও যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্বখ্যাত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আমাজনের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) জেফ বেজোসের প্রথম চাকুরি ছিল ফাস্টফুড তৈরির গ্রিল অপারেটর হিসেবে। তিনি মাত্র ১৬ বছর বয়সে যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ামি অঙ্গরাজ্যে ফাস্টফুড চেইন ম্যাকডোনাল্ডসের গ্রিল অপারেটর হিসেবে কাজ শুরু করেন। সেখানে তিনি বার্গার বানানোর কাজও করতেন। মজুরী পেতেন ঘন্টা হিসেবে। প্রতি ঘন্টায় তাঁর মজুরি ছিল ২ দশমিক ৬৯ ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ২২৯ টাকার সমান। এ চাকরির অভিজ্ঞতা থেকেই বেজোস গুরুত্বপূর্ণ বেচাকেনা, তথা ব্যবসায়িক শিক্ষা লাভ করেন। এখন তাঁর সম্পদের নীট মূল্য হচ্ছে ২০ হাজার ৭৯০ কোটি ডলার। ব্যবসা ক্ষেত্রের পরিধি তিনি শুধু যুক্তরাষ্ট্রে সীমাবদ্ধ রাখেনি। সমগ্র বিশ্বের অধিকাংশ দেশে তিনি ব্যবসাকে প্রসারিত করেছেন।
ইলন মাস্ক: বর্তমান বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ ধনী ইলন মাস্ক বেড়ে উঠেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকায়। ১৯৮৩ সালে যখন তাঁর বয়স ১৭ বছর, তখন তিনি অভিবাসী হিসেবে কানাডায় পাড়ি জমান। সেখানে তিনি তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে। সেই প্রথম চাকুরিতে তাঁর কাজ ছিল কম্পিউটার গেমস বিক্রি করা। কাজটির বিনিময়ে তিনি মাসে পেতেন মাত্র ৫০০ মার্কিন ডলার। পরবর্তীতে মাস্ক কানাডা ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। এখন তিনি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বৈদ্যুতিক গাড়ি, বাড়ির গ্রিড স্কেল, সৌর প্যানেল, সৌর ছাদ টাইলস প্রভৃতি পণ্য উৎপাদনকারী। তাছাড়া মহাকাশযান প্রস্তুত এবং মহাকাশে পর্যটন সেবা প্রদানের লক্ষ্যে গঠিত স্পেস এক্সপ্লোরেশন টেকনোলজিস কর্পোরেশনের সিইও। তাঁর সম্পদের পরিমাণ ১৭ হাজার ৬০ কোটি ডলার।
বিল গেটস: বিল গেটস ধনী হওয়ার ইতিহাস আরো আশ্চার্য্যতম। জীবনের প্রারম্ভে তিনি ছিলেন একজন সাধারণ প্রোগ্রামার। ছোটবেলার বন্ধু পল অ্যালেনকে সঙ্গে নিয়ে বিল গেটস প্রতিষ্ঠা করেন মাইক্রোসফট কর্পোরেশন নামের একটি প্রতিষ্ঠান। মাত্র ১৫ বছর বয়সে তিনি টিআরডাব্লিউ নামের একটি প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার প্রোগ্রামার হিসেবে কাজ করেন। বিশ্বখ্যাত হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়েও ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু লেখাপড়া শেষ করেননি। সাবেক স্ত্রী মেলিন্ডার সঙ্গে মিলে তিনি গড়ে তোলেন বিশ্বের বৃহত্তম বেসরকারি দাতব্য প্রতিষ্ঠান ‘বিল এন্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন’। এ প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বে শিক্ষার অগ্রগতি, ক্ষুধামুক্তি ও টিকা ব্যবস্থার উন্নয়ন নিয়ে কাজ করে। বর্তমানে তিনি বিশ্বের চতুর্থ শীর্ষ ধনী। তাঁর নীট সম্পদের মূল্য ১৩ হাজার ৪৩০ কোটি ডলার। অবশ্য কিছুদিন পূর্বেই তাঁর স্ত্রীর সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে।
মার্ক জাকারবার্গ: ২০০২ সালে মাত্র আঠার বছর বয়সে মার্ক জাকারবার্গ-এর প্রথম চাকুরি ছিল মিউজিক প্লেয়ার তৈরি করা। এ মিউজিক প্লেয়ারটির নাম ছিল সাইন্যাপস। ২০০৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারী তিনি আরও চার বন্ধু সঙ্গে মিলে প্রতিষ্ঠা করেন ফেসবুক। ফেসবুক প্রতিষ্ঠা করার পর তাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এ ফেসবুকের ওপর ভিত্তি করে মাত্র ৩৭ বছর বয়সে তিনি এখন বিশ্বের পঞ্চম শীর্ষ ধনী। বর্তমানে মার্ক জাকারবার্গের সম্পদের নীট মূল্য হয় ১৩ হাজার ৪৩০ কোটি ডলার।
ওয়ারেন বাফেট: বিশ্বে বিনিয়োগ গুরু হিসেবে যিনি খ্যাতি লাভ করেছেন তিনি হচ্ছেন ওয়ারেন বাফেট। মাত্র ১৩ বছর বয়সে বাফেট সংবাদপত্রের হকার হিসেবে তাঁর কর্মজীবন শুরু করেন। তিনি বিলি করতেন বিশ্বখ্যাত পত্রিকা ওয়াশিংটন পোষ্ট। এ কাজের বিনিময়ে বাফেট মাসে ১৭৫ ডলার মজুরি হিসেবে পেতেন। এরপর বাফেট পিনবল মেশিনের ব্যবসায় নিয়োজিত হন। তিনি বড় ব্যবসায় নিয়োজিত হবার জন্য দূরদর্শী পরিকল্পনা গ্রহণ করে কঠোর পরিশ্রম করতে শুরু করেন। একদিন ঠিকই সফল বিনিয়োগকারী হিসেবে বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জন করেন। বর্তমানে বাফেট বার্কশায়ার হ্যাথওয়ের চেয়ারম্যান ও সিইও। এখন তার নিট সম্পদের পরিমাণ ১০ হাজার ১১০ কোটি ডলার, যা নিয়ে তিনি বিশ্বের ষষ্ঠ শীর্ষ ধনী।
রতন টাটা: টাটা গ্রুপের কর্ণধারেরা আসলে ভারতীয় ছিল না। তাদের আদি নিবাস ছিল ইরানে। ১৯৪০ এর দশকে ইরানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর কঠোর মনভাবের কারণে ইরান থেকে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা ইউরোপ ও এশিয়াতে অভিবাসন হতে বাধ্য হয়। এ অবস্থায় টাটা গ্রুপের পূর্ব পুরুষেরা ভারতে এসে ব্যবসা কাজে নিয়োজিত হয়। ১৯৬১ সালে রতন টাটা নিজেদের পারিবারিক প্রতিষ্ঠান টাটা ষ্টিলের একটি দোকানে কাজ করার মধ্য দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। বর্তমানে শিল্পগোষ্ঠী টাটা সন্স ও টাটা গ্রুপের সাবেক চেয়ারম্যান রতন টাটা অবসর জীবনযাপন পালন করছেন। রতন টাটা তথা টাটা গ্রুপ এখন বিশ্বের ৬১তম ধনী। তাঁর সম্পদের নিট মূল্য ২ হাজার ৯১০ কোটি ডলার।
ষ্টিভ জবস: যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রযুক্তি উদ্ভাবক ও উদ্যোক্তা, যাকে পার্সোনাল কম্পিউটার (পিসি) বিপ্লবের পথিকৃৎ বলা হয়, তিনি হলেন ষ্টিভ জবস। ২০১১ সালে যদিও তিনি মারা যান তবুও তাঁর অ্যাপল ব্রান্ড এখনও বিশ্বের সর্বোচ্চ স্থান দখল করে আছে। ১৯৭৬ সালে তাঁর দুই সহযোগী ষ্টিভ ওজনিয়াক ও রোনাল্ড ওয়েনকে সঙ্গে নিয়ে তিনি অ্যাপল কম্পিউটার প্রতিষ্ঠা করেন। এটি এখন বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান ও অভিজাত ব্রান্ড। অথচ তিনি জীবনের প্রারম্ভে ভিডিও গেমস তৈরির কাজ শুরু করেন। গেমসটির নাম ছিল আতারি। ২০১১ সালে মারা যাওয়ার সময় তাঁর সম্পদের নিট মূল্য ছিল ২ হাজার ৯১০ কোটি ডলার।
একমাত্র মার্ক জাকারবার্গ ছাড়া অন্য কোন ধনী ব্যক্তি স্পল্প সময়ের মধ্যে বিত্তশালী হতে পারেনি। প্রত্যেক ধনী ব্যক্তির প্রারম্ভিক জীবন ছিল কষ্টকর। দূরদর্শী পরিকল্পনা, কঠোর পরিশ্রম আর একাগ্রতার ফলেই তাঁরা আজ এ অবস্থায় উপনীত হয়েছে। বাংলাদেশের যুব সমাজকে এ অবস্থা থেকে শিক্ষা নেয়া খুবই প্রয়োজন। কারণ এ দেশের যুব সমাজের মধ্যে একটি প্রবণতা প্রায় দেখা যায় যে, তারা দ্রুত সময়ে বিত্তশালী হতে চায়। এখানে আরো একটি বিষয় দেখা যায় যে, এ করোনাকালীন সময় ধনী ব্যবসায়ীদের আয়ের পরিমাণ কমেনি। বরং বৃদ্ধি পেয়েছে।
লেখক : পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক,
বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধহোয়াটস অ্যাপ না খুলেই চ্যাটের ছবি ভিডিও দেখবেন যেভাবে