প্রবাহ

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ৫ মে, ২০২১ at ৬:৫৬ পূর্বাহ্ণ

সমরকন্দ-তৈমুর লং-হযরত কাশেম বিন আব্বাস (র.)
উজবেকিস্তানের ২য় বৃহত্তম নগরী সমরকন্দ, যা বিশ্বে আলোচিত মহানগরী। এই মহানগরীর ইতিহাসে আলোচিত শাসক তৈমুর লং ও মহান সাহাবা হযরত কাশেম বিন আব্বাস (র.) এ নগরীতে শায়িত। আরও শায়িত রয়েছেন একাধিক ইমাম, অলি, দরবেশ।
খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ বছর বা তারও আগে থেকে সমরকন্দে লোকালয় গড়ে উঠে। এর অবস্থান চীন থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত (চীলক রোড়) বাণিজ্যপথের মধ্যে হওয়ায় এ শহরটি বেশ সমৃদ্ধ। তখন থেকে এটি মধ্য এশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ শহর। খ্রিস্টপূর্ব ৭০০ সালে প্রাচীন পারস্যের প্রাদেশিক রাজধানীতে পরিণত হয় সমরকন্দ। পশ্চিম ইউরোপিয়ানদের কাছে এ শহরের ব্যাপক পরিচিতি ছিল। মহাবীর আলেকজান্ডার ৩২৯ খ্রিস্টপূর্বে এ শহর বিজয় করেন। খোলাফায়ে রাশেদীনের আমলে এখানে ইসলামের আগমন হয়। পরবর্তীতে আরবরা এখানে বিজয় লাভ করে। ফলশ্রুতিতে ইসলামিক সাংস্কৃতিক একটি কেন্দ্রে পরিণত হয় সমরকন্দ।
১২২০ খ্রিস্টাব্দে মোঘল শাসক চেঙ্গিস খান শহরটি প্রায় সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেন। ১৩৬৯ খ্রিস্টাব্দে তৈমুর লং সমরকন্দে তার সাম্রাজ্যের রাজধানী বানালে এ শহর আবার উন্নতি লাভ করে।
১৫০০ শতকে তৈমুরের সাম্রাজ্যের পতন শুরু হয়। এতে ১৪৯৯ খ্রিস্টাব্দে উজবেকরা শহরটি দখল করে নেয়। উজবেক শাসকেরা ১৬০০ শতকে তাদের রাজধানী বুখারায় সরিয়ে নিলে সমরকন্দের গুরুত্ব কমে যায়। ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে সমরকন্দ বুখারার আমিরের অধীনে চলে আসে। ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়া সমরকন্দ দখল করে নেয়; এতে এ শহর আবার গুরুত্ব পেতে শুরু করে।
জেরফ্‌শন নদীর পানি প্রবাহের ধারা সমরকন্দের নানাবিধ কল্যাণ সাধিত হয়। সমরকন্দ প্রাচীন শহর বিধায় এ মহানগর নতুন ও পুরাতন দু’ভাগে বিভক্ত। পুরাতন শহরে সাহাবা, একাধিক অলি দরবেশ শায়িত। আরও রয়েছে প্রাচীন মসজিদ ও স্থাপনা, তৎমধ্যে বিবি খানম মসজিদ বিখ্যাত। আরও রয়েছে তৈমুর লং এর সমাধি। এখানকার শতকরা ৮৮ % সুন্নি মুসলমান।
মুঘল বাদশাহ বাবর বারে বারে প্রচেষ্টা চালায় সমরকন্দ দখল করতে। এখানে শীতকালে অতি ঠান্ডা হালকা বরফ পড়ে। গরমকালে তাপমাত্রা ৪০ এর উপরে উঠে।
তৈমুর লং: জন্ম : ৯ এপ্রিল ১৩৩৬ খ্রিস্টাব্দ; মৃত্যু: ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৪০৫ খ্রিস্টাব্দ; ৬৮ বছর বয়সে।
তৈমুর লং এর পূর্ণনাম সুজাউদ্দিন তৈমুর। সমরকন্দ তৈমুর লং এর নানা স্মৃতি বিজড়িত বলা যাবে। পশ্চিম ও মধ্য এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল দখলে এনে তৈমুরীয় সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। অতঃপর ১৩৭০-১৪০৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ক্ষমতায় আসীন ছিলেন। তৈমুর লং অপরাজেয় সমরবিদ হিসেবে ইতিহাসের অন্যতম সফল সেনা নায়ক হিসেবে বিবেচিত। তার কারণেই তৈমুরীয় রাজ বংশ প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এ বংশ কোন না কোনভাবে ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে নেতৃত্বে আসীন ছিল। তৈমুরের পূর্ব পুরুষ তুর্কি সেলযুগীয় সুলতানের অনুপ্রেরণা হিসেবে অনুসরণ করতেন। আলেকজান্ডার ও চেঙ্গিস খানের মত তিনিও বিশ্ব জয়ে সেনাবাহিনী নিয়ে বের হয়েছিলেন। যুদ্ধ করতে করতে তিনি এক পর্যায়ে আহত হন। যার ফলে তার এক পা অকেজো হয়ে যায়।
তাকে বিশ্ব বিধাতা তৈমুর, দীর্ঘ জৈয়ী দুনিয়া কাঁপানো তৈমুর নানা নামকরণে অনেক গ্রন্থ রচিত আছে।
তার সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ছিল আধুনিক তুরস্ক, সিরিয়া, কুয়েত, ইরান, ইরাক থেকে মধ্য এশিয়ার অধিকাংশ অংশ। যার মধ্যে রয়েছে কাজাকিস্থান, আফগানিস্তান, রাশিয়া, তুর্কমিনিস্তান, উজবেকিস্তান, কিরগিস্তান, পাকিস্তান, ভারতের অংশ বিশেষ ও চীনের কাসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত।তিনি একটি আত্মজীবনী মূলক গ্রন্থ রচনা করে যান। তৈমুর লং মুসলমান ছিলেন। তবে এ নিয়ে কিছুটা মতভেদ রয়েছে। অনেক লেখক তাকে বর্বর নয় বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি ছিলেন খোদা ভীরু, প্রকৃত সুশাসক। তৈমুর লং এর পিতা ছেলের উদ্দেশ্যে বলেন,“বাবা আমি চাই না তুমি যে রাসূলের উম্মত, সে রাসূলের রাস্তা থেকে সরে যাও। আল্লাহর রাসূলের বংশধরদের সম্মান করতে শিখ। দরবেশের কাছ থেকে শিক্ষা নিও। নামাজ, রোজা, হজ্ব আর যাকাত এ চার স্তম্ভের উপর শক্ত হয়ে দাঁড়াইও।
এখানে উল্লেখ্য আল্লাহর রাসূল (স.)’র সহোদর চাচাতো ভাই মহান সাহাবা হযরত কাশেম ইবনে আব্বাস (রহ.) এ সমরকন্দে শহীদ হন। এতে হয়ত তৈমুর লং এর পিতা ছেলের প্রতি অছিয়ত (উপদেশ) রাখতে উপরোক্ত কথাগুলো বলেছিলেন।
একাধিক বর্ণনায় তৈমুর লং অত্যধিক ধার্মিক ছিলেন বলে উল্লেখ দেখা যায়। তিনি কুরআন মাজীদ তেলাওয়াত ও ইবাদত বন্দেগীকে গুরুত্ব দিতেন। যুদ্ধের সময় নামাজ কাজা করতেন না। অলি দরবেশগণকে শ্রদ্ধা করতেন। তিনি নাকি নিজেই বলতেন আমি তৈমুর, আল্লাহ পাকের গোলাম।
হযরত কাশেম বিন আব্বাস (র.)
আল্লাহর রাসূল (স.)’র আপন চাচা হযরত আব্বাস (র.), হযরত আবদুল্লাহ (র.)’র ছোট ভাই। উনার পুত্র হযরত কাশেম বিন আব্বাস (র.)। আল্লাহর রাসূল (স.)’র যখন ওফাত হয় তখন তাঁর বয়স ১২/১৩ বছর। ওফাতের পর পবিত্র কবর শরীফ খনন হলে হযরত কাশেম (র.) এই কবরে নেমেছিলেন বলে আমাদের সাথে পাকিস্তানী সহযাত্রী এক বিজ্ঞ আলেম সকলকে জানান। তিনি আরও বলেন সমরকন্দ বাসী তাকে পেয়ে অতি উৎফুল্ল হয়ে যায়। তাঁকে নেতা হিসেবে মেনে নেয়। তিনি এখানে শহীদ হন।
এমনিতেই হযরত ইমাম হাসান ও ইমাম হোসাইনসহ অনেক আহলে বায়েত আওলাদে রাসূল উম্মতে মুহাম্মদীর অতি জনপ্রিয়তার কারণে শহীদ হতে হয়েছে সে সময়ের শাসকদের মাধ্যমে।
৬৭৬ খ্রিস্টাব্দে আরব ভূমি থেকে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে হযরত কাশেম ইবনে আব্বাস (র.) সমরকন্দে আসেন। এখানে তাঁকে শহীদ করা হয়। তাঁর মস্তক মোবারক এখানে পুরাতন সমরকন্দের পাহাড়ের উপর সমাহিত। সমরকন্দবাসীর কাছে তিনি একজন জিন্দা বাদশাহ হিসেবে সমধিক পরিচিত। তাঁর কবরকে ঘিরে এখানে পাহাড়ে পরবর্তী নানান অবকাঠামো তৈরি হয়। এখানে রয়েছে অলি দরবেশগণের কবর, অফিস, গেস্ট হাউস ইত্যাদি। এখানকার অবকাঠামো বারে বারে সংস্কার করা হয়। প্রত্যেক রাজা বাদশাহ, সরকার প্রধান এখানে অবদান রাখতে সচেষ্ট থাকে। বহু রাজা বাদশাহর সদস্য অতি আগ্রহ করে এখানে কবরস্থ হন। সমরকন্দবাসীর কাছে ইহা অত্যন্ত পবিত্র এরিয়া। এখানকার প্রত্যেক অবকাঠামোর রয়েছে দীর্ঘ বর্ণনা।
হযরত কাশেম ইবনে আব্বাসকে লক্ষ্য করে আল্লাহর রাসূল (স.)’র একটি হাদীস শরীফ রয়েছে যা এখানকার পাহাড়ের দিকে উঠবার সময় ইংরেজ ও উজবেক ভাষায় দেয়া আছে।
গত ২০১৯ সালের নভেম্বরে ৮ দিনব্যাপী উজবেকিস্তান সফরকালে বুখারা থেকে সমরকন্দ আসা হয়। এখানে অবস্থানকালে হযরত কাশেম বিন আব্বাস (র.)’র যেয়ারতের পাশাপাশি তৈমুর লং এর সমাধি কমপ্লেক্সে যেয়ারতসহ ঘুরে ফিরে দেখা হয়।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধসাখাওয়াত হোসেন মজনুকে যেমন দেখেছি
পরবর্তী নিবন্ধসুপ্রিম কোর্ট বারের সভায় হট্টগোল