প্রবাহ

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ at ৭:০৯ পূর্বাহ্ণ

ইরানে নারীর কর্মতৎপরতা

১১ ফেব্রুয়ারি ইরানের জাতীয় দিবস। সে লক্ষে ইরানের নারী সমাজ নিয়ে আজকের এ প্রয়াস।
ইরানে নারীরা পুরুষের পাশাপাশি কাজ করে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এ দেশে নারীর কর্মতৎপরতা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন হবে। বিদেশী যে কোন যাত্রী রাজধানী তেহরানে ইমাম খোমেনী আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে অবতরণ করলে চোখে পড়বে ইমিগ্রেশন কাস্টমসে নারীদের কর্ম তৎপরতা। পুরুষদের দেখা যাবে অস্ত্র হাতে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করতে।
বিমান বন্দর থেকে যখন হোটেল যাওয়া হবে রিসিপশনে দেখা মিলবে হোটেলের মান অনুপাতে দু’জন বা ততোধিক রিসিপশনিস্ট নারী দাঁড়িয়ে আছে। পাসপোর্ট নিয়ে ফরম পূরণ করায়ে রুম বরাদ্দ দিচ্ছে। হোটেলের কক্ষে গেলে রুম সার্ভিস হিসেবে মহিলা কর্মী আসবে রুমের মধ্যে কোন সমস্যা আছে কি না জানতে। সকাল ৯/১১ টার দিকে রুম পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে সাজিয়ে দিতে যাবতীয় সরঞ্জাম নিয়ে আসবে ২ জন করে নারী।
খাবার খেতে হোটেলের রেস্টুরেন্টে যাবেন, এখানেও ক্যাশ কাউন্টারে দেখা যাবে নারী ম্যানেজার। টেবিল সামনে নিয়ে চেয়ারে বসলে খাবার অর্ডার নিতে আসবে নারী ওয়োইটার।
প্রয়োজনের তাগিদে অফিসে গেলেও দেখা মিলবে অফিসের অবস্থাভেদে ২/৩ জন বা ৫/৬ জন নারী টেবিল সামনে নিয়ে চেয়ারে বসে কর্মরত। হয়ত এও দেখা মিলতে পারে চেয়ারের পাশে নিচের কার্পেটে সন্তানকে শোয়ায়ে রেখেছে। হয়ত এও দেখা মিলতে পারে চেয়ার খালি মা সন্তানকে দুধ খাওয়াতে ভিতরে গেছে। ইরানে পরিবারে গৃহিণী কর্মস্থলে ঘরে শিশু সন্তান রেখে যাওয়ার ব্যবস্থা তুলনামূলক কম। সন্তানকে ডে-কেয়ারে অথবা কর্মস্থলে রাখতে দেখা যায়। বিশেষ করে কয়েক মাস বা ১ থেকে ৩ বছরের শিশু। শহরে হাঁটাহাঁটি করলে তখন দেখা যাবে নারীরা গাড়ি চালিয়ে কর্মস্থলে যাচ্ছে। যে কোন মার্কেটে গেলে দেখা যাবে সেলসম্যানের দায়িত্ব পালন করতেছে নারীরা।
ইমাম খোমেনী আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর শহর থেকে কিছুটা দূরত্বে। শহরের অভ্যন্তরে মেহেরাবাদ বিমান বন্দর দিয়ে বিশাল ইরানের অভ্যন্তরে কোথাও যাওয়া আসা করলে এখানেও দেখা মিলবে এয়ার লাইনের পক্ষে আপনার লাগেজ নিয়ে ট্যাগ দিচ্ছে, বোয়িং কার্ড দিচ্ছে, বিমানে উঠার জন্য আপনাকে দিক নির্দেশনা দিচ্ছে নারীরা। সরকারি এয়ার বাদেও ইরানে বেসরকারি ৫/৭টি এয়ার লাইন দৈনিক হাজার হাজার যাত্রী ইরানের অভ্যন্তরে ও বিদেশে যাওয়া আসা করে। ককপিট ক্রু ও কেবিন ক্রু সবাই ইরানী। কেবিন ক্রু তথা বিমানবালারা মাথায় কাপড় রেখে দুই হাত নাড়াচড়া করে দ্রুততার সাথে যাত্রীদের সেবা দান করতে দেখা যায়। যা শাড়ি পরে করলে কিছুটা হলেও ব্যাঘাত হয়।
উক্ত সব ক্ষেত্রে এক মাত্র নারীরা কর্মরত তা নয়। তবে তুলনামূলক নারীরা সংখ্যাধিক্য মনে হবে। পুুরুষজনকে ভারী কাজ করতে দেখা যাবে বেশি। যেমন রাস্তাঘাট নির্মাণ মেরামত, অস্ত্র হাতে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করা।
শাহ এর আমলে ইরানীদের জীবনযাত্রা ছিল পশ্চিমা স্টাইলের। কিন্তু ১৯৮৯ সালে ইমাম খোমেনীর নেতৃত্বে ইসলামী বিপ্লবের পর ইরানের জীবনযাত্রা শত ভাগ পাল্টে যায়। আমেরিকার নির্দেশে পশ্চিমা বিশ্ব উপ- সাগরীয় রাজতন্ত্রীয় আরব দেশসহ ইরাকের লৌহ মানব সাদ্দাম হোসেনকে লেলিয়ে দেয় ইরানের বিরুদ্ধে। ইরানের প্রতিকূলতার সুযোগে সাদ্দাম হোসেন পেছনে মহাশক্তির সমর্থন সহযোগিতা নিয়ে ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামে। দীর্ঘ ৮ বছর এ ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধ চলে। তারপরও ইরানকে কাবু করা যায়নি। এতে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় যুদ্ধ বিরতি হয় মাত্র। ইমাম খোমেনীর নেতৃত্বে নতুন শাসনতন্ত্র চালু করা হয়। সে নিয়মনীতিতে পরিচালিত হচ্ছে ইরান। এতে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট থাকলেও তার উপর সর্বোচ্চ ক্ষমতা ইমামের হাতে। ইমাম খোমেনীর ইন্তেকালের পর বর্তমান ইমাম আলী খামেইনী।
সরকারি আইনমতে নারীরা শালীনতা রক্ষা করে জীবন প্রবাহ চালিয়ে যাবে। ইরানীদের মধ্যে বাংলাদেশসহ আমরা ভারতবর্ষের লোকজনের মত শ্যামলা বা কালো নর-নারী চোখে পড়বে না। তারা দেখতে সুন্দর, ফর্সা। বিশ্বে লেবানন, ফিলিস্তিন, জর্ডান, সিরিয়া, রাশিয়ার দাগিস্তান, চেচনিয়া ও ইরান এসব দেশের মানুষের গঠন বলিষ্ঠ সুন্দর। ইরানের নারীরা আমাদের নারী সমাজের মত প্যান্ট পরে। উপরে সেলোয়ার স্টাইলে না পরে উপর থেকে হাঁটু পর্যন্ত কোট পরিধান করে থাকে। অনেকটা শেরোয়ানী স্টাইলের। মাথায় উড়না থাকবে। শতকরা ৮০-৯০ জন নারী কালো ড্রেস পরিধান করে। তবে বয়স্কসহ শতকরা ২০-৩০ জন নারী বড় কালো চাদর মাথার উপর দিয়ে শরীরের দুইদিকে টেনে নিয়ে সামনের দিকে বাম হাতে ধরবে। তাদের শিয়া মতাদর্শ মতে বোরকার স্থলে এ চাদর প্রথাই বেশি প্রচলিত। অর্থাৎ আমাদের দেশের মত বোরকার স্থলে অতি ধর্ম পালনকারী নারীরা শরীরের উপর অতিরিক্ত কালো চাদর জড়িয়ে নেয়।
ইরানের পার্শ্ববর্তী উপসাগরীয় আরব দেশের মত ঘরে কাজের মেয়ে তথা খাদ্দামা প্রথা নেই বললেই চলে। এতে ইরানের কল্যাণ। আয়েশী না হয়ে স্বামী স্ত্রী কর্ম তৎপর। ঘরের কাজ বাহিরের কাজ নিজেরাই করে। উচ্চ মধ্যবিত্ত সচ্ছল পরিবারে স্বামী স্ত্রী দুজনের আলাদা আলাদা দুইটি গাড়ি। স্বামীর গাড়ি স্বামী ,স্ত্রীর গাড়ী স্ত্রী চালাচ্ছে। একাধিক বার ইরানীদের বাড়িতে দাওয়াত খাওয়া হয়েছিল। দেখা যাচ্ছিল স্ত্রীকে স্বামী সহযোগিতা করতেছে, যেহেতু এখানে কাজের লোকজন নেই। ১৬ লাখ ৪৮ হাজার বর্গ কিলোমিটারের দেশ ইরান। যা বাংলাদেশের প্রায় ১০ গুণ বড়। জনসংখ্যা ৭ কোটি, শতকরা ৯৫ জনের অধিক শিক্ষিত। অর্থাৎ বিশাল দেশে ৭ কোটি শিক্ষিত নর-নারী নিজেরা বিলাসী না হয়ে কর্ম তৎপর থেকে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
ফলে আজ ইরানে ট্রেন, বাস, ট্রাক, কারসহ যাবতীয় কিছু নিজেদের উৎপাদিত। আরও উৎপাদিত শত আসনের বিমান। আমাদের দেশে ইরান থেকে ট্রেন আমদানী হয়। বিলাসী না হয়ে পুরুষের পাশাপাশি নারীরা গৃহিণী হয়ে ঘরে না থেকে কর্ম তৎপর থাকায় দেশের কল্যাণ হচ্ছে।
ইরানীরা স্বাস্থ্যবান। যেহেতু তাদের খাওয়া দাওয়া প্রোটিন সমৃদ্ধ ও পুষ্টিকর। তারা মসলা উৎপাদন করে কিন্তু খায় কম। বিভিন্ন বাদাম ও বিভিন্ন ফল ফলারের জন্য ইরান বিখ্যাত।
মুসলিম বিশ্বের মধ্যে ইরানের সাথে সাথে তুরস্ক ও ইন্দোনেশিয়ায়ও দেশের কল্যাণে নারীদের কর্ম তৎপরতা ব্যাপক ভাবে চোখে পড়বে। অর্থাৎ এ বড় বড় তিনটি মুসলিম দেশের নারীরা তুলনামূলক দেশের কল্যাণে বেশি তৎপর বলা যাবে।
এক কথায় ইমাম খোমেনীর ইসলামী বিপ্লবের পর নারীদের শালীনতা রক্ষা করতে হচ্ছে মাত্র। কিন্তু দেশে নারীর বিচরণে যে ব্যাপকতা রয়েছে তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন হবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক ও কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ক্যাম্পাসে পূর্ণাঙ্গ ক্যান্সার হাসপাতাল
পরবর্তী নিবন্ধউইগুরদের ভাষা বিলুপ্ত করে দিচ্ছে চীন