প্রবাহ

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ২৫ মে, ২০২২ at ৬:৫৭ পূর্বাহ্ণ

রেলে ভাড়া প্রদান নিয়ে বিচিত্র কথা

গত ৫ মে রেলের টিটিই কর্তৃক বিনা টিকেটের যাত্রীকে জরিমানা করার ঘটনায় অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। বিনা টিকেটের যাত্রী রেলমন্ত্রীর আত্মীয় বিধায় জরিমানা করে টিটিই এর কার্যকলাপে ক্ষিপ্ত হয়ে শফিকুল ইসলাম সাময়িক বরখাস্ত হন। এ নিয়ে সারা দেশে আলোচনা সমালোচনার ঝড় উঠে। পরে সাময়িক বরখাস্ত এর আদেশ প্রত্যাহার করে নেয়া হয়।

TTE (travelling ticket examiner) মূলত ব্রিটিশ আমল থেকে চালু থাকা পদ, যাদের দায়িত্ব হচ্ছে চলমান ট্রেনে ও স্টেশনে যাত্রীদের টিকেট চেক করা ও টিকেট না থাকলে বিধিমতে জরিমানা করা।

উক্ত বিষয় নজরে আসায় রেলকে ভাড়া প্রদান নিয়ে আমার জীবনের কয়েকটি ঘটনা সম্মানিত পাঠক মহলে জানাতে আগ্রহ জাগে। রেল শত ভাগ সরকারী সম্পত্তি। আরামদায়ক, চিন্তামুক্ত ও অনেকটা নিরাপদ যানবাহন হিসেবে দূরযাত্রার জন্য রেলের বিকল্প নেই।

ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যাত্রীদের আরাম দিতে রেল অনেকটা এগিয়ে যাচ্ছে। সে তুলনায় আমরা অনেক অনেক পিছিয়ে। জাপান, চীন, ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্বল্প সময়ে আরামে পৌঁছে দিতে বুলেট ট্রেন চালু করা হয়েছে। যার গতি ঘণ্টায় ৩-৫ শত কি.মি। চীনে গেলে বুলেট ট্রেনে চড়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে আমার। পার্শ্ববর্তী বিশাল দেশ ভারতেও রাজধানী এক্সপ্রেস এবং শতাব্দী এক্সপ্রেস বেশ আরামদায়ক রেল। টিকেটের টাকার মধ্যেই খাবার প্রদান করে বিনামূল্যে। বর্তমান মোদী সরকার বন্দে ভারত নামে ঘণ্টায় প্রায় ১৬০ কি.মি গতির আরও আরামদায়ক উন্নতমানের ট্রেন চালু করে। এ ট্রেনে ভাড়ার ভিতর টাইমে টাইমে স্বাস্থ্যসম্মত ও সুস্বাদু খাবার প্রদান করে।

১৭ কোটি অধ্যুষিত ঘনবসতিপূর্ণ জনসংখ্যার এই দেশে নিরাপদ ও আরামদায়কভাবে মহাসড়কে যানজটমুক্ত যাতায়াত সহজ হওয়ার নয়। এ রকম ঘনবসতিপূর্ণ আমাদের দেশে সহজ যাতায়াতের জন্য রেলই অন্যতম মাধ্যম। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমাদের রেলওয়ে মনে হয় সেবাতে পিছিয়ে, দুর্নীতির ভারে ভারাক্রান্ত। সরকারী সম্পদ নিয়ে লুটপাট নিয়মিত বিষয়ে পরিণত হয়েছে।

গত ক বছরে বিভিন্ন দেশ থেকে কয়েক শত ইঞ্জিন ও হাজারের কাছাকাছি কোচ আমদানি করা হয়েছে। সে তুলনায় রেলের সেবার মান তত উন্নত হয়েছে বলা যাবে না। এখনও রেলে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা যেতে প্রায় ৬ ঘণ্টার কাছাকাছি সময় লাগতেছে। দোহাজারী-কক্সবাজার রেল লাইন ও রেল স্টেশন নির্মাণের কাজ দ্রুত এগিয়ে চললেও কক্সবাজার যেতে রেলের সুবিধা পাওয়া সুদুর পরাহত। যেহেতু দোহাজারী-চট্টগ্রাম রেল লাইন নতুনভাবে সাজাতে হবে। কালুরঘাটে কর্ণফুলী নদীর উপর নির্মাণ করতে হবে নতুন সেতু। দেশকে এ লাইনের সুফল দিতে নির্মাণ করতে হবে ষোলশহর-ফৌজদারহাট নতুন রেল লাইন।

আগের সরকার রেলকে সংকোচিত করে কর্মকর্তা-কর্মচারীকে অবসরে যেতে উৎসাহিত করে, যা ছিল আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।

বাঁশখালী গ্রামের বাড়ীতে রেল থেকে অবসরে আসা একজনকে বললাম তুমি রেল থেকে অবসরে এসে অনেক টাকা পেয়েছ; এখন হজ্ব করে এস। উত্তরে বলল, এ টাকা দিয়ে হজ্ব করলে হবে না। তার যুক্তিতে রেলের বেতন পেতে তেমন ডিউটি করতে হয় না।

আমার জীবনে ১৯৫০ এর দশকে চট্টগ্রাম-দোহাজারী লাইনে কাঞ্চননগর স্টেশন পর্যন্ত যাওয়া হয়েছিল আব্বার সাথে পটিয়া টি এস্টেটে কয়েকদিন থাকতে। ঐ সময় পর পর কয়েক বার যাওয়া হয়েছিল। তখনকার সময় চট্টগ্রাম স্টেশনকে বটতলী স্টেশন বলা হত। সেই সময় বট গাছ নিয়ে নানান কথা ছিল।

১৯৬৬/৬৭ সালে চট্টগ্রাম থেকে রেলে ঢাকা যাওয়া হয়েছিল। তখন চট্টগ্রাম-ঢাকার প্রধান যাতায়াত মাধ্যম ছিল রেল। দৈনিক তিনটি রেল ছিল খুবই জনপ্রিয়। সম্ভবত চট্টগ্রাম থেকে সকাল ৭ টায় উল্কা, দুপুর ১২ টায় গ্রীণ এ্যারো, রাত ১০ টায় মেইল। এ মেইল ট্রেনে অনেক কোচ। এখানে ডাক বিভাগের জন্য কোচ ছিল, সরকারী বেসরকারী বড় বড় কর্তা ব্যক্তি যাত্রীরা যাতায়াত করত। যতটুকু মনে পড়ে চট্টগ্রাম-ঢাকা থার্ড ক্লাস ৭ টাকা, ইন্টার ক্লাস ১১ টাকা, ফার্স্ট ক্লাস ও সেকেন্ড ক্লাস ২০-২৫ টাকার মধ্যে। তখন ঢাকা রেল স্টেশন ছিল ফুলবাড়ীয়ায়।

২৫/৩০ বছর আগে চট্টগ্রাম-সিলেট পাহাড়িকা এক্সপ্রেস চালু হয়। ৯০ এর দশকের শুরুর দিকে আমরা ৪ জন এ ট্রেনে চট্টগ্রাম থেকে সিলেট পৌঁছি সন্ধ্যায়। সিলেট রেল স্টেশনে পৌঁছেই ফিরতি সিলেট-চট্টগ্রাম টিকেট করার ইচ্ছে, যেহেতু তখন আধুনিক টিকেট সিস্টেম ছিল না। ২ রাত পরের দিন সকালে চট্টগ্রাম আসতে ১ম শ্রেণীর ৪ জনের টিকেট চেয়েছিলাম। ২ জনের পেলাম, বাকী ১ জনের কুমিল্লা, অপর জনকে ফেনী পর্যন্ত টিকেট দিল।

১ম শ্রেণী কেবিনে পাশাপাশি ৩ জন বসার সিট। ৪ জন অনায়াসে বসা যায়। চাপাচাপি করে বসলে ৫ জনও বসা যায়।

কুমিল্লা থেকে যাত্রী উঠল আমাদের কেউ নামল না; এটেনডেন্ট বুঝতে পারল না। ফেনী থেকে যাত্রী উঠল, আমাদের কেউ নামল না। এটেনডেন্ট কৌতুহলী বিধায় জানতে চাইলে বিষয়টি তাকে জানিয়ে দেয়া হয়। তিনি নিজে থেকে আমাদেরকে চট্টগ্রাম রেল স্টেশন পার করে দিতে সহযোগিতা করবে বলে; আমি নীরব ছিলাম। বিকেল ৩/৪ টার দিকে ট্রেন চট্টগ্রাম স্টেশন (তখন নতুন স্টেশন চালু হয়নি) পৌঁছলে রেলের ওভারব্রীজ হয়ে যাত্রীরা দ্রুত পার হয়ে যাচ্ছিল। এটেনডেন্ট আমাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছিল, কিন্তু আমি তাকে সুযোগ দিলাম না। ওভারব্রীজের উপর কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে থাকলাম। এটেনডেন্ট অবস্থা অনুধাবন করে চলে গেল। যাত্রীরা দ্রুত চলে গেলে ব্রীজের উপর টিটিই এর কাছে আমাদের সমস্যার কথা বললাম। তিনি আমাদেরকে স্টেশনের নিচতলায় টিটিইগণের কক্ষে নিয়ে গেলেন। বড় কক্ষ ডিম্বাকৃতির টেবিল। ইচ্ছা করলে ১০/১২ জন টিটিই বসতে পারবে। ৩/৪ জন টিটিই ঐ সময় আছে। এ টিটিই হিসাব করে ৪ শত টাকার কিছু বেশি দিতে বললেন। আমি টাকার রশিদ চাইলাম। টিটিই বলল রশিদ দিতে হলে দ্বিগুণ টাকা দিতে হবে। আমার যৌক্তিকতা তার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। অন্য ২/৩ টিটিই খেয়াল করলেন এবং বলছেন ৪ শত টাকার কিছু বেশি দিয়ে চলে যান। আমি বললাম, আপনাদের টাকা দিতে চাই না। রেলকে টাকা দিতে চাই। শেষ পর্যন্ত প্রায় দ্বিগুণ ৯ শত টাকা দিয়ে রশিদ নিয়ে নিলাম।

আরেকটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে, প্রায় ২০ বছর আগে এক সহযাত্রীসহ এই পাহাড়িকা প্রথম শ্রেণীতে করে আখাউড়া হয়ে আগরতলা যাওয়া হয়েছিল। ফেরার পথে আখাউড়া আসলে চট্টগ্রাম আসতে প্রথম শ্রেণির টিকেট চাইলাম। আমরা ২ জন, টিকেট পেলাম একজনের। অনন্য উপায় হয়ে একজনের শোভন শ্রেণি নিলাম। কিন্তু ২ জনই বসলাম প্রথম শ্রেণিতে ও চট্টগ্রাম চলে আসলাম। পরবর্তীতে অতিরিক্ত টাকার চাঁদপুরগামী লাইনের সিটবিহীন টিকেট ক্রয় করে ছিড়ে ফেলি, যাতে প্রথম শ্রেণির সমপরিমাণ টাকা রেলের ফান্ডে জমা হয়।

প্রায় ১৫/২০ বছর আগে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম আসা হচ্ছিল সুবর্ণ এক্সপ্রেসে। দুইটি কোচ এসি, বাকী সব কোচ নন এসি। এসি ৩৩০ টাকা নন এসি ১৬৫ টাকা। ঢাকা বিমান বন্দর রেল স্টেশনে চট্টগ্রাম আসতে সুবর্ণ এক্সপ্রেসের অপেক্ষায় ছিলাম। তখন দেখলাম ভাতিজা গিয়াসু চট্টগ্রাম আসছে নন এসি টিকেটে। তাকে আমার সাথে এসিতে উঠায় নিই। দেখলাম আমার পাশের সিটটি খালি থাকায় ভাতিজাকে বসায়ে নিলাম। টিটিই আসল। ভাতিজার টিকেট আপগ্রেড করে দিতে বললাম; টিটিই ক্ষমতা নাই বলল। চট্টগ্রাম চলে আসলাম। ভাতিজার জন্য বাকী ১৬৫ টাকা চট্টগ্রাম-চাঁদপুর লাইনের সিটবিহীন টিকেট ক্রয় করে ছিড়ে ফেলে দিই,আগের বারের মত।

আজ দেশে সরকারী সম্পদ মানে লুটেপুটে খাওয়া। সরকারী সম্পদ মানে শত শত না হাজার হাজার কোটি টাকার লোকসান। তৎমধ্যে রেলও অন্যতম একটি। মাননীয় মন্ত্রী, সচিব, মহাপরিচালক পশ্চিম ও পূর্ব অঞ্চলের শত শত উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ভাববেন আশা করি। অবসরে যাবেন, মৃত্যু নিকটবর্তী। আমরা সন্তান-সন্ততির জন্য দেশে বিদেশে অবৈধ সম্পদ অর্জন রেখে যাচ্ছি। সন্তান-সন্তাতিরা তাদের সন্তান-সন্ততির জন্য হা-হুতাশ করবে। দেশে বিদেশে সম্পদ রেখে যাওয়া পিতা মাতার জন্য হা-হুতাশ করে না। রেলেও যে ভাল সৎ মানুষ নেই তা নয়। থাকলেও শতে কয়জন আছে, কিভাবে আছে অজানা।

প্রসঙ্গক্রমে বলতে হচ্ছে, দেশে ২বার ব্যবহারিক সামগ্রী কিনা হয়েছিল। কেনার পর জানতে পারি এসব জিনিস অবৈধভাবে দেশে ঢুকে। ফলে ক্রয়কৃত কালো দ্রব্যকে সাদা করতে ২ বার করে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাস্টম হেডে টাকা জমা করা হয়। এসব প্রসঙ্গে অন্য সময় প্রবন্ধ লিখব বলে আশা রাখি।
লেখক : গবেষক, প্রাবন্ধিক, কলাম লেখক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধজাতীয় কবি