প্রবাহ

আহমদুল ইসলাম চৌধুরী | বুধবার , ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ at ৮:০১ পূর্বাহ্ণ

৬ রজব হযরত খাজা মঈন উদ্দিন চিশতি (রহ.)’র ওফাত বার্ষিকী। কেহ তাঁকে সোলতানুল হিন্দ, কেহ গরীবে নওয়াজ, আর কেহবা খাজা বাবা হিসাবে ভক্তি সহকারে সম্বোধন করে থাকেন। তাঁর কারণে আজমীরকে আজমীর শরীফও বলা হয়ে থাকে।
হযরত খাজা মঈন উদ্দিন চিশতি (রহ.) হিজরি ৫৩৭ সনে ১১৩৮ খ্রিস্টাব্দে মধ্য এশিয়ার খোরাসানের অর্ন্তগত সঞ্জর নামক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। সঞ্জরের অপর নাম সজিস্তানও বলা হয়ে থাকে। হযরত খাজা (রহ.)’র পিতার নাম সৈয়দ গিয়াসুদ্দীন হাসান (রহ.), আর মাতার নাম বিবি উম্মুল ওয়ারা (রহ.)।
খাজা (রহ.)’র পিতার দিক দিয়ে হোসাইনী এবং মাতার দিক দিয়ে হাসানী সৈয়দ হন। বিভিন্ন গ্রন্থ বিশ্লেষণ করে হযরত খাজা (রহ.)’র নিম্নরূপ বংশ পরিক্রমা পরিলক্ষিত হয়। খাজা মঈন উদ্দিন চিশতি (রহ.)’র পিতা হযরত গিয়াসুদ্দীন হাসান (র.), তৎ পিতা হযরত নজমুদ্দীন তাহের (রহ.), তৎ পিতা ইমাম মুসা কাজিম (রহ.), তৎ পিতা হযরত সৈয়দ ইব্রাহীম (রহ.), তৎ পিতা ইমাম মুসা কাজিম (রহ.), তৎ পিতা ইমাম জাফর সাদেক (রহ.), তৎ পিতা ইমাম মুহাম্মদ বাকের (র.), তৎ পিতা ইমাম জয়নুল আবেদীন (র.), তৎ পিতা সৈয়দ্যুনা হযরত ইমাম হোসাইন (র.)।
মাতার দিক দিয়ে হযরত খাজা মঈন উদ্দিন চিশতি (রহ.)’র মাতা বিবি উম্মুল ওয়ারা (রহ.), তৎ পিতা হযরত সৈয়দ দাউদ (রহ.), তৎ পিতা হযরত আবদুল্লাহ হাসবলি (রহ.), তৎ পিতা হযরত মুহাম্মদ সুরস (রহ.), তৎ পিতা হযরদ দাউদ (রহ.) তৎ পিতা হযরত আবদুল মখফী (রহ.), তৎ পিতা হযরত হাসান মুসান্না (রহ.), তৎ পিতা সৈয়দ্যুনা হযরত ইমাম হাসান (র.)।
হযরত খাজা (রহ.) নিজের ঘরেই প্রাথমিক বিদ্যা অর্জন করেন। তাঁর পিতা খুব বড় দরজার আলেম ছিলেন। হযরত খাজা (রহ.) নয় বছর বয়সে কোরআন মজিদ মুখস্ত করে নেন। অতঃপর সঞ্জরের এক মাদ্‌রাসায় ভর্তি হয়ে অল্পদিনের মধ্যে তাফসীর, হাদীস, ফেকাহ ইত্যাদি শিক্ষা লাভে সক্ষম হন।
হযরত খাজা (রহ.)’র চৌদ্দবছর বয়সে পিতা ইন্তেকাল করেন। পিতার ওয়ারিশ হিসাবে একটি বাগান প্রাপ্ত হন। পিতা ইন্তেকালের কয়েক মাসের মাথায় তাঁর মাতাও ইন্তেকাল করায় পিতা-মাতা হারা এতিম হয়ে পড়েন। মাত্র ১৫ বছর বয়সে পিতা-মাতা হারিয়ে হযরত খাজা (রহ.) কিছুদিন বাগান দেখাশোনা করে কালাতিপাত করেন। এরিমধ্যে আধ্যাত্মিক জগৎ এর প্রকৃত ওলি দরবেশের সান্নিধ্য লাভ, খেদমত, সময় দেয়া ও ভালবাসতে লাগলেন।
একদিন তারই বাগানে সাক্ষাৎ মেলে তৎকালীন আধ্যাত্মিক জগতের খ্যাতিমান ওলি হযরত শেখ ইব্রাহীম কন্দোজী (রহ.) এর। বাগানে হযরত খাজা (রহ.), হযরত শেখ (রহ.) ইব্রাহীমের ফয়ুজাতে নিজেকে ভরপুর করে নেন। তাঁরই বদৌলতে হযরত খাজা (রহ.) আধ্যাত্মিক জগতের দিকে দ্রুত ধাবিত হতে লাগলেন। পরবর্তীতে হযরত খাজা (রহ.) নিজের জন্মভূমি ত্যাগ করে বোখারায় চলে যান এবং তথাকার বিখ্যাত বিখ্যাত মাদ্‌রাসায় আরও তাফসীর, হাদীস, ফিকাহসহ উচ্চ পর্যায়ে ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনে সক্ষম হন। তথা হতে তিনি সমরখন্দ চলে যান আরও শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে।
হযরত শেখ ইব্রাহীম কন্দোজী (রহ.) যখন হতে হযরত খাজা (রহ.) কে আল্লাহর মহব্বতের ঝলক দেখিয়েছেন, সেই হতে তাঁর মন আল্লাহকে পাবার জন্য সর্বদা ব্যাকুল থাকত। তাই উচ্চতর ধর্মীয় শিক্ষার ঢেউ মনের আধ্যাত্মিক জ্বলন্ত কামনাকে উদ্বেলিত করে তোলে। এবার তিনি আল্লাহর নাম নিয়ে সমরখন্দ ত্যাগ করে পশ্চিমের দিকে ধাবিত হন। সমরখন্দ হতে তিনি নিশাপুর এসে পৌঁছলেন। নিশাপুর থেকে তিনি কিছুদূর যাবার পর হারুন নামক এক ছোট গ্রামে এসে পড়েন এবং সাক্ষাৎ মেলে আধ্যাত্মিক জগতের স্বনামধন্য ওলি হযরত খাজা শেখ ওসমান হারুনীর (রহ.)’র (মতান্তরে হারওয়ানী)। হযরত খাজা (রহ.)’র হযরত শেখ ওসমান হারুনী (রহ.) কে চিনতে বাকী রইল না। ফলে তিনি হযরত ওসমান হারুনী (রহ.)’র হাতে হাত রেখে বায়াত হন এবং হযরত হারুনী (রহ.)’র সান্নিধ্যে থেকে যান। হযরত খাজা (রহ.) প্রায় ২০ বছর নিজ পীর হযরত ওসমান হারুনী (রহ.)’র সান্নিধ্যে কাটিয়ে তাঁর অনুমতিক্রমে বাগদাদ গমন করেন।

বাগদাদ হতে হিজরি ৫৮৩ সনে হযরত খাজা (রহ.) মক্কা মোকাররমা গমন করেন। মক্কা মোকাররমায় আল্লাহ পাকের খাছ এলাকায় আল্লাহর ঘরে কাটিয়ে, আল্লাহর হাবিবের দরবারে হাজিরা দিতে মদিনা মুনাওয়ারায় রওনা হন। বিভিন্ন গ্রন্থে বর্ণিত আছে, মদিনা মুনাওয়ারায় অবস্থানকালে হযরত খাজা (রহ.) হিন্দে দ্বীনের তাবলীগে আত্মনিয়োগ করার জন্য আল্লাহর হাবিবের নির্দেশ লাভ করেন। সে অনুযায়ী তিনি মদিনা মুনাওয়ারা থেকে বিদায় নিয়ে হিন্দের (এ উপমহাদেশকে আরবীতে হিন্দ হিসেবে সম্বোধন করা হয়ে থাকে) উদ্দেশ্যে ধাবিত হন এবং মদিনা মুনাওয়ারা থেকে বাগদাদ পৌঁছেন। সে সময় তাঁর পীর হযরত খাজা ওসমান হারুনী (রহ.) বাগদাদে ছিলেন। নিজের পীরের খেদমতে মদিনা মুনাওয়ারায় আল্লাহর হাবিবের নিকট হতে প্রাপ্ত নির্দেশাবলি জানালেন।
হযরত ওসমান হারুনী (রহ.) খুশি মনে হযরত খাজা (রহ.) কে বিদায় দিলেন। অতঃপর তিনি বিভিন্ন গ্রাম জনপথ অতিক্রম করতে করতে হিন্দে প্রবেশ করেন। লাহোরে হযরত আলী ইবনে ওসমান হজবেরী প্রকাশ দাতা গঞ্জে বখ্‌স (রহ.) এর মাজারে উপস্থিত হয়ে কিছুদিন অবস্থান করেন। হযরত দাতাগঞ্জে বখ্‌স (রহ.) তখনকার অতুলনীয় আলেম, ফাজেল, আবেদ ও কামেল হিসাবে ব্যাপক পরিচিতি ছিলেন। হযরত খাজা সেখানে কিছুদিন অবস্থান করে বাতেনী ফয়েজ ও বরকত হাসেল করে হিন্দের আরও অভ্যন্তরের দিকে রওয়ানা হন। হযরত দাতাগঞ্জে বখসের মাজার ত্যাগের প্রাক্কালে একটি কবিতার ছন্দ আবৃত্তি করেন। যা হল : গঞ্জ বখশে ফয়েজে আলম মাজহারে নূরে খোদা/ নাকেসাঁরা পীরে কামেল কামেলারা রাহনুমা।
(অর্থাৎ তিনি দানের ভান্ডার, জগতের জ্যোতি, আল্লাহর নূরের বহিঃপ্রকাশ, (তরিকতে) অনভিজ্ঞদের জন্য পীরে কামেল, অভিজ্ঞদের জন্য পথ প্রদর্শক।
লাহোর থেকে হযরত খাজা (রহ.) দিল্লিতে আগমন করেন এবং দ্বীনের তাবলীগে আত্মনিয়োগ করেন। দিল্লিতে তাঁর প্রধান খলিফা হযরত খাজা কুতুব উদ্দিন বখতিয়ার কাকী (রহ.) কে দিল্লিতে তাবলীগের কাজে সমর্পন করেন। দিল্লি থেকে আজমীর যেতে হযরত খাজা তাঁর প্রধান খলিফা হযরত খাজা কুতুব উদ্দিন বখতিয়ার কাকী (রহ.)কে আজমীর নিয়ে যাচ্ছিলেন। এতে দিল্লির জনগণ হযরত খাজার নিকট বাঁধ সাজে। তারপরও হযরত খাজা কাকীকে আজমীরে নিয়ে যেতে অনড়। কিছুদূর নিয়েও গিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত দিল্লির জনগণের দাবীর সাথে সুলতান ইলতুতমিসও একাত্ম হয়ে যান। এতে হযরত খাজা গরীবে নওয়াজ অনন্য উপায় হয়ে তাঁর প্রধান খলিফা হযরত খাজা কুতুব উদ্দিন বখতিয়ার কাকীকে দিল্লিতে তাবলীগের কাজে সমর্পণ করেন।
হযরত খাজা কুতুব উদ্দিন বখতিয়ার কাকী (রহ.) দিল্লিতে অবস্থান করতেছিলেন। ঐ সময়কার সুলতান ইলতুতমিস হযরত খাজা কাকীর মুরিদ ছিলেন। সুলতান ইলতুত্‌মিস-ই হযরত খাজা কাকীর জানাযা পড়ান। সুলতান ইলতুত্‌মিস নিজেই একজন আল্লাহওয়ালা ব্যক্তিত্ব ছিলেন। দিল্লি কুতুব মিনার কম্পাউন্ডে সুলতান ইলতুতমিস শায়িত।
হযরত খাজা চল্লিশ জন মুরিদ নিয়ে আজমীরের উদ্দেশ্যে গমন করেন। আজমীরে অবস্থান করে দ্বীনের তাবলীগের প্রতি আত্মনিয়োগ করেন। ফলশ্রুতিতে বহু ঘাত প্রতিঘাতে বিজয় অর্জন করতে করতে ইসলামের ঝান্ডা উড়াতে উড়াতে হিজরি ৬৩৩ সনে ১২৩৫ খ্রিস্টাব্দে ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৭ বছর। হযরত খাজার রয়েছে বহু বহু কারামত/কেরামত। যা বৃহদাকারের গ্রন্থ লিখেও শেষ হবে না। প্রতি বছর ৬ রজব শান শওকতের সাথে তাঁর ইছালে ছওয়াব মাহফিল পালিত হয়। হযরত খাজা মঈন চিশতি (রহ.)’র মাজার কমপ্লেক্সের কারণে আজমীর বিশ্বে একটি প্রসিদ্ধ নাম। যেহেতু রাজস্থান প্রদেশের এই আজমীরেই হযরত খাজা শায়িত। পবিত্র মক্কা ও পবিত্র মদিনার পর সম্ভবত যেয়ারতের উদ্দেশ্যে এখানেই মানবের অত্যধিক সমাগম হয়।
বছরের বিভিন্ন সময় মাহফিল বাদেও প্রতিনিয়ত হাজার হাজার যেয়ারতকারীর এখানে সমাগম থাকে। ভারতের পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকে প্রতিনিয়ত আজমীরে যেয়ারতকারী যাতায়াত করে থাকে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধলিজার ভ্যালেন্টাইন চমক