প্রবারণার ধর্মীয় ব্যাপ্তি ও তাৎপর্য

অধ্যক্ষ (অব:) তরুণ কান্তি বড়ুয়া | মঙ্গলবার , ১৯ অক্টোবর, ২০২১ at ৭:২১ পূর্বাহ্ণ

প্রবারণা পূর্ণিমা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে অন্যতম একটি ধর্মীয় উৎসব যা আশ্বিনী পূর্ণিমা নামে পরিচিত। এটি থেরবাদী বৌদ্ধদের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ পূর্ণিমা। বৌদ্ধ ইতিহাসে এ মহান পূর্ণিমার তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ও মাহাত্ম্য অপরিসীম। এটি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব। থেরবাদী বৌদ্ধ রাষ্ট্রসমূহে এ দিনটি অত্যন্ত ধর্মীয় আলোয় ও ভাবগাম্ভীর্যের মাধ্যমে পালন করা হয়। ‘প্রবারণা ‘ শব্দের পালি আভিধানিক অর্থ নিমন্ত্রণ, আহবান, মিনতি, অনুরোধ, নিষেধ, সমাপ্তি, ত্যাগ,ভিক্ষু সংঘের বর্ষাবাস পরিসমাপ্তি, বর্ষাবাস ত্যাগের কার্য অথবা শিষ্টাচার বিধি,তৃপ্তি বা সন্তুষ্টির বিষয়, ক্ষতিপূরণ, প্রায়শ্চিত্ত, ঋণ পরিশোধ ইত্যাদি বুঝানো হয়। ধর্মীয় আবহে উদ্ভাসিত ও সুষমা মন্ডিত এ পূর্ণিমা উৎসব অন্যান্য থেরবাদী দেশ সমূহের মতো বাংলাদেশেও মহা সাড়ম্বরে পালিত হয়ে থাকে। তথাগত বুদ্ধের ধর্ম ও দর্শন ভিত্তিক নানান বর্ণিল অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দিবসটি পালন করা হয়। তথাগত বুদ্ধ মৈত্রী, করুণা ও অহিংসা মন্ত্রে আত্মনিবেদিত থেকেভিক্ষু-ভিক্ষুনী সংঘকে নিজ নিজ মন্দিরে বা প্যাগোডায় অবস্থান করে ৩ মাস বর্ষাবাস অধিষ্ঠান করার জন্য বিধান প্রদান করেছিলেন। আষাঢ়ী পূর্ণিমা থেকে বর্ষাব্রত পালন শুরু হয়ে আশ্বিনী পূর্ণিমা বা প্রবারণা পূর্ণিমায় এ বর্ষাব্রত পালন অনুষ্টান শেষ হয়ে থাকে।বুদ্ধের নির্দেশনা মতে ভিক্ষু এবং ভিক্ষুণী সংঘ তিন মাস ধ্যান সমাধিতে মগ্ন থেকে নিজ নিজ চিত্তের উতকর্ষ সাধনের মাধ্যমে নিজেদের মনের পরিশুদ্ধি আনয়ন করেন।তাঁদের চলার পথে কোন ধরনের দোষ ত্রুটি করে থাকলে প্রতি অমাবস্যা ও পূর্ণিমা তিথিতে ভিক্ষু সীমায় উপস্থিত পারস্পরিক দোষ ত্রুটি স্বীকার করে ‘আপত্তি দেশনার’ মাধ্যমে নিজেদের চিত্তকে পরিশুদ্ধ করার ব্যাপারে অঙ্গীকারাবদ্ধ হবেন। তাঁরা ভিক্ষু সীমায় বসে ভিক্ষু প্রাতিমোক্ষ পাঠ করবেন। বয়োজ্যেষ্ঠ ভিক্ষুগণের কাছ থেকে ভিক্ষুর প্রতিপালনীয় শীলগুলোর গুরুত্ব ও তাৎপর্য সবিস্তারে বুঝে নেবেন। তাঁরা ৩ মাসব্যাপী বর্ষাবাস চলাকালে বুদ্ধের ধর্ম ও দর্শন তত্ব গবেষণা করে প্রত্যেক অমাবস্যা, পূর্ণিমা ও অষ্টমী তিথিতে বিহারে সমাগত অষ্টশীল-পঞ্চশীল পালনকারী উপাসক-উপাসিকাদের উদ্দেশ্যে ধর্ম দেশনা প্রদান করবেন এবং দায়ক-দায়িকাগনকে চিত্তের পরিশুদ্ধতা সহকারে আত্মকল্যান ও পরহিতকল্যাণে নিবেদিত থাকার ব্যাপারে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে পরামর্শ প্রদান করবেন। করুণা ঘন তথাগত সম্যক সম্বুদ্ধ বিধিসম্মত ভবে সত্য ধর্মকে গুরুত্ব সহকারে পালনের মাধ্যমে সুন্দর জীবন গঠনে বর্ষাব্রত অধিষ্ঠান বিধানের উদ্দেশ্য বর্ণনা করেছেন।
প্রথম বর্ষা বাস শেষে তথাগত বুদ্ধ সারানাথের মৃগদায়ে ধর্মচক্র প্রবত্তনের পর তাঁর পঞ্চবর্গীয় শিষ্য যথাক্রমে ভদ্দিয়, কোন্ডায়, মহানাম, বপ্প ও অশ্বজিতকে তাঁর নব আবিস্কৃত ধর্ম দর্শন সম্যকরূপে উপলব্ধির পর মানব কল্যানে প্রচার করার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি যশ ও তাঁর বন্ধুসহ ৬০ জন পারদর্শী ভিক্ষুকে এ মহান ধর্ম প্রচারের জন্য নির্বাচিত করেছিলেন। তিনি তাঁদেকে নির্দ্দেশ দিলেন ‘চরতে ভিকখবে চারিকং,বহুজন হিতায়, বহুজন সুখায়…’
‘হে ভিক্ষুগণ বহুজনের, বহুজনের কল্যাণের জন্য, বহুজনের সুখের জন্য,লোকের প্রতি অনুকম্পা পরবেশ হয়ে দিকে দিকে এ কল্যাণ ধর্ম প্রচার কর। তাঁর নির্দেশ মতে আদিতে কল্যাণ, মধ্যে কল্যাণ এবং অন্তে কল্যাণ যুক্ত ধর্ম প্রচার করার লক্ষ্যে ভিক্ষু সংঘ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিলেন। বুদ্ধ মতে ১০ ম বর্ষাবাসে এ পুণ্যম্যয় পূর্ণিমা তিথিতে গৌতম বুদ্ধ তাবতিংস স্বর্গে মাতৃদেবীকে অভিধর্ম দেশনার পর ভারতের সাংকাশ্য নগরে অবতরণ করেন এবং মানবজাতির সুখ,শান্তি ও কল্যানে দিকে দিকে সদ্ধর্ম প্রচারের জন্য ভিক্ষু সংঘকে নির্দ্দেশ প্রদান করেছিলেন এবং এদিনেই তাঁর ৩ মাসের বর্ষাবাসের পরিসমাপ্তি ঘটে।
এরই ধারাবাহিকতায় আজকের আশ্বিনী বা প্রবারণা পূর্ণিমার পর থেরবাদী বৌদ্ধ দেশে ভিক্ষুসংঘ প্রবারণার বর্ষাব্রত পরিসমাপ্তির পরপরই ধর্ম প্রচারে বের হবেন। বর্ষাব্রত অধিষ্ঠান পরিসমাপ্তির পরদিন থেকেই প্রতিটি মন্দির বা প্যাগোডায় দানোত্তম কঠিন চীবর দানানুষ্ঠান শুরু হয়। যেসব মন্দিরে বা প্যাগোডায় ভিক্ষু সংঘ সুষ্ঠুভাবে বর্ষাব্রত অনুষ্ঠান সমাপ্ত করেন কেবল সেসব মন্দিরে বা প্যাগোডায় কঠিন চীবর দান উদযাপন করার বিধান রয়েছে। আশ্বিনী পূর্ণিমা থেকে কার্ত্তিকী পূর্ণিমা পর্যন্ত ১ মাস ব্যাপী বিভিন্ন বিহারে কঠিন চীবর দান অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। একটি বিহারে বা প্যাগোডায় বছরে একবার এ পবিত্র দানানুষ্ঠানের আয়োজন করার বিনয় সম্মত বিধান রয়েছে। তথাগত বুদ্ধ শ্রাবস্তীর জেতবন বিহারে অবস্থান কালে কোশল হতে একদল ভিক্ষু বর্ষাব্রত সমাপন শেষে বুদ্ধের সান্নিধ্যে এসেছিলেন। বুদ্ধ তাঁদেরকে বললেন, ‘ভিক্ষু সংঘ দীর্ঘ সময় একস্থানে অবস্থান করলে তাঁদের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি, বিবাদ বিসম্বাদ ও কলহ সংঘটিত হওয়াটা স্বাভাবিক। বর্ষাবাস শেষ করে তোমরা একত্রিত হয়ে পরস্পর পরস্পরের দোষ ত্রুটির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করবে এবং একে অপরকে আন্তরিকভাবে বরণ করে নেবে’। বর্ষাবাস সমাপনান্তে ভিক্ষুগণ তাঁদের দোষ ত্রুটি অপর ভিক্ষুগণের নিকট স্বীকার করে তার প্রায়শ্চিত্ত বিধানের আহবান জানান, এমনকি অজ্ঞাতসারে কোন অপরাধ করে থাকলে তার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করাই হলো প্রবারণার মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। প্রবারণা পূর্ণিমায় বৌদ্ধরা আকাশ প্রদীপ(ফানুস) প্রজ্জ্বলন করে থাকেন।কথিত আছে সিদ্ধার্থ গৌতম গৃহ ত্যাগ করে অনোমা নদীর তীরে পৌঁছে সারথী ছন্দকে অশ্ব কন্থক ও শরীরের রাজকীয় পোশাকাদি দিয়ে বিদায় দেন।
সুবিন্যস্ত কেশকলাপ প্রব্রজিতের জন্য শোভনীয় নয় বিধায় তিনি কেশকলাপ কেটে রাজমুকুট সহ উর্ধদিকে উড়িয়ে দিলেন।সত্যক্রিয়ার প্রভাবে তাঁর কেশ রাশি উর্ধাকাশে উত্থিত হলো। তাবতিংস স্বর্গের দেবতারা তাঁর কেশ রাশি নিয়ে চুলামনি চৈত্য প্রতিষ্ঠা করে পূজা করতে লাগলেন। বাংলাদেশসহ বৌদ্ধ প্রধান দেশ সমূহে বৌদ্ধরা সেই কেশ রাশির পূজা ও সম্মানার্থে আশ্বিনী পূর্ণিমা বা প্রবারণা পূর্ণিমায় আকাশ প্রদীপ (ফানুস) উড়িয়ে থাকেন। প্রবারণা উৎসব ভিক্ষু সংঘের মাঝে মৈত্রী, সৌহার্দ্য ও সমপ্রীতির বন্ধন সৃষ্টি করে। অপরদিকে এ উৎসব বৌদ্ধসহ জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সবার মাঝে আনন্দের ভাবধারা ও অসামপ্রদায়িক চেতনার উন্মেষ ঘটায়। তাই আজকের প্রবারণা হোক হিংসার পরিবর্তে অহিংসা, ভোগের পরিবর্তে ত্যাগ, শত্রুতার পরিবর্তে মিত্রতা, অশান্তির পরিবর্তে শান্তি, সর্বোপরি প্রেম, করুণা, সৌভ্রাতৃত্ব, পারস্পরিক শ্রদ্ধা বোধ ও মৈত্রীর সেতুবন্ধন সৃষ্টির মহা সোপান ও প্রেরণা। স্বার্থদ্বন্দ্ব ও অশান্তির বিষবাষ্পে পূর্ণ বিশ্ব হোক কালিমা মুক্ত। বিশ্বে শান্তি বিরাজ করুক। বিশ্ব হোক করোনা মুক্ত। জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক।
তরুণ কান্তি বড়ুয়া : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, লেখক

পূর্ববর্তী নিবন্ধএ দায় কার?
পরবর্তী নিবন্ধভূগোলের গোল