প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে স্মরণ : কিশোর টুআইসি জানে আলম

জাহেদুল আলম | মঙ্গলবার , ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৬:০২ পূর্বাহ্ণ


‘জানে আলম কিশোর বয়সে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে। গ্রুপ কমান্ডার ছিলেন পতেঙ্গার আবদুল গফুর। গফুর-গ্রুপের বিভিন্ন অপারেশনে সে অংশ নিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের আগে বা মুক্তিযুদ্ধের সময়ে জানে আলমের সাথে আমার পরিচয় ছিল না। তার সাথে আমার পরিচয় মুক্তিযুদ্ধের অনেক পরে। বেশ কয়েকটি সভায় তার সাথে ছিলাম। তার স্বাভাবিক সাহসী বক্তব্য আমাকে মুগ্ধ করতো। সে ছিল এক অনলবর্ষী বক্তা। কোনো বিষয়ের উপর বক্তব্য দিতে উঠলে, সে বিষয়ের চুলচেরা বিশ্লেষণ করতো এবং নির্ভীকভাবে তার মতামত প্রকাশ করতো। এই কারণে আমার থেকে বয়সে ছোট হলেও আমি তার একজন ভক্ত ছিলাম।’
উপর্যুক্ত কথাগুলো বীর মুক্তিযোদ্ধা, প্রখ্যাত শ্রমিক নেতা এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন কিশোর গেরিলা খ্যাত এডভোকেট জানে আলম সম্পর্কে। আর কথাগুলো বলেছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক একনিষ্ঠ গবেষক ডাক্তার মাহফুজুর রহমান ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা জানে আলমের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা’ শীর্ষক রচনায়।
মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে কিশোর জানে আলম মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তখন তিনি চট্টগ্রামের পতেঙ্গা উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। তাঁর জন্ম ১৯৫৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের দক্ষিণ পতেঙ্গার মাইজপাড়া এলাকার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে। পিতা শফিউর রহমান (মৃত্যু ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০০৩), মাতা সালেহা খাতুন (মৃত্যু ১৬ ডিসেম্বর ২০২০)। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এলএলবি ও মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। শৈশব আর কৈশোরের সন্ধিক্ষণে তিনি ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৬৯ সালে বৃহত্তর পতেঙ্গা ছাত্রলীগের সহ-সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) এর অংগসংগঠন জাতীয় শ্রমিক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম-সম্পাদক নির্বাচিত হন ১৯৮৪ সালে। ১৯৯১ সালে বাকশাল অবলুপ্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত ছিলেন চট্টগ্রাম মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক। পরবর্তীতে গণফোরামে যোগদান করেন এবং এই দল থেকে পতেঙ্গা- হালিশহর সংসদীয় এলাকায় তিনবার সংসদ সদস্য পদে নির্বাচন করেন। আমৃত্যু তিনি গণফোরামের চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সাধারণ সম্পাদক এবং কেন্দ্রীয় কমিটির প্রেসিডিয়াম মেম্বার ছিলেন।
এডভোকেট জানে আলম ছিলেন শ্রমিক নেতা। পেশাগতভাবে তিনি ছিলেন ইস্টার্ন রিফাইনারিতে কর্মরত। ইস্টার্ন রিফাইনারি এমপ্লয়ীজ ইউনিয়ন এর প্রায় চব্বিশ বছর সভাপতির পদ অলংকৃত করেন। তিনি ছিলেন বাংলাদেশ অয়েল এ্যাণ্ড গ্যাস ওয়ার্কাস ফেডারেশনের সভাপতি এবং বাংলাদেশ কেমিক্যাল এনার্জি এ্যাণ্ড এলাইউ ওয়ার্কাস ফেডারেশনের সহ-সভাপতি। ইস্টার্ন রিফাইনারি থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি আবার এডভোকেসিতে মনোনিবেশ করেন। কিন্তু ক্ষেত্র একটাই। ছিলেন শ্রম আদালতের আইনজীবী।
কিন্তু এতকিছু ছাপিয়ে তিনি বিখ্যাত হয়ে আছেন ‘কিশোর গেরিলা’ হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে চট্টগ্রামের ১৫৭ নম্বর সিটি গেরিলা গ্রুপের সেকেন্ড ইন কমান্ড (টুআইসি) ছিলেন। এডভোকেট জানে আলমের রাজনৈতিক সহকর্মী এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা ফসিউল আলম রচিত ‘অদম্য জানে আলম’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধে আছে – ‘হরিণা ক্যাম্পে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ নিয়ে আমরা ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে উম্পি নগরে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিলাম। প্রশিক্ষণ শিবিরে জানে আলম থাকতো ডেল্টা কোম্পানিতে। আর আমি আলফা কোম্পানিতে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে গভীর রাত পর্যন্ত প্রশিক্ষণ চলতো। একসাথে প্রশিক্ষণ শেষে অপর্যাপ্ত অস্ত্র নিয়ে চট্টগ্রাম শহরে গেরিলা অপারেশনে অংশ নিয়েছিলাম।’ স্মর্তব্য, জানে আলম তখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। বয়স মাত্র চৌদ্দ।
স্বাধীন দেশেও আমৃত্যু তিনি অকুতোভয় অনেক ভূমিকা রেখেছেন। ১৯৭৫ সালের পনেরো আগস্ট জাতীয় জীবনে নেমে আসে ঘোর অমানিশা। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ হয়ে যায়। এমতাবস্থায় বীর মুক্তিযোদ্ধা এডভোকেট জানে আলম অত্যন্ত কৌশলের সাথে রাজনীতি চর্চা অব্যাহত রাখেন। সেই বৈরী সময়ে তিনি পতেঙ্গা কাঠগড় এলাকায় প্রতিষ্ঠা করেন ‘শেখ মুজিব গণ-পাঠাগার’। স্বৈরাচার এরশাদ সরকার-বিরোধী গণ-আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন এডভোকেট জানে আলমকে গ্রেফতার করার জন্য একাধিকবার তাঁর বাড়ি ঘেরাও করে স্বৈরাচারের লেলিয়ে দেয়া বাহিনি। শেষ পর্যন্ত ১৯৮৭ সালের ২৫ অক্টোবর তারিখে সফল হয় তারা। তাঁর স্ত্রীকে পুলিশ আশ্বস্ত করেছিল এক সপ্তাহ পরেই তারা জানে আলমকে ফেরত দিয়ে যাবেন। কিন্তু স্বৈরাচার তো স্বৈরাচারই। এডভোকেট জানে আলমকে কারাগারে আটকিয়ে রাখলেন টানা ছয় মাস। চলল নিপীড়ন ও প্রলোভন। এরশাদ সরকারের মন্ত্রীত্বের প্রলোভন। কিন্তু কোনো কিছুই টলাতে পারেনি জানে আলমকে। জেলে যাওয়ার সময় এডভোকেট জানে আলমের প্রথম সন্তানের (কন্যা) বয়স ছিল মাত্র পাঁচ বছর আর স্ত্রী ফরিদা খানম ছিলেন অন্ত:সত্ত্বা। জেল থেকে যখন ছাড়া পান, তখন পুত্রের বয়স চার মাস। তাঁর স্ত্রী কষ্ট-যন্ত্রণা সহ্য করে সেই পতেঙ্গা থেকে চট্টগ্রাম কারাগারে শিশু সন্তানকে নিয়ে আসতেন স্বামীকে সন্তানের মুখ দেখাবেন বলে।
কারাগারে থেকেও স্বৈরাচার পতন আন্দোলনে সফল হওয়ার প্রবল মনোভাবাপন্ন এডভোকেট জানে আলমের একটি চিঠির অংশবিশেষ এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও রাজনৈতিক সহযোদ্ধা বীর মুক্তিযোদ্ধা ফসিউল আলমকে ৯ এপ্রিল ১৯৮৮ সালে চট্টগ্রাম জেলা কারাগার থেকে চিঠিতে লেখেন, ‘আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছিস। দেশের রাজপথ থেকে আন্দোলন কেন হঠাৎ ওয়াশিংটনে চলে গেল, নিশ্চয়ই ঐসব কারণ উপলব্ধি করেছিস। এ আন্দোলন থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের এগুতে হবে। রোজার মধ্যেও আর কিছু হচ্ছে না। তথাপি ঐক্য বজায় রেখে, দোদুল্যমানতা পরিহার করে বৃহৎ দলগুলো যদি আবারও আন্দোলনে নামে, তাহলে বিজয়ের সম্ভাবনা এখনো বিদ্যমান। সাক্ষাতে ঐসব আলাপ করার আশা রাখি।’ এডভোকেট জানে আলম কারাগারে থেকেও স্বৈরাচার-বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং আন্দোলন সফল করেছিলেন। তাইতো আমরা ১৯৯১ সাল থেকে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার পাচ্ছি এবং সংসদীয় গণতন্ত্র অব্যাহত রাখতে পারছি।
বহুল আলোচিত ওয়ান ইলেভেন পরবর্তী সেনা শাসিত সরকারের সময় এডভোকেট জানে আলমকে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে তলব করা হয়। তাঁর অপরাধ, পতেঙ্গার মাইজপাড়া-চৌধুরীপাড়া-পূর্বকাঠগড় জনপদ অবরুদ্ধ করে বিমানবাহিনী যে দেয়াল তুলছিল, সেটার প্রতিবাদে ও প্রতিরোধে তিনি নেতৃত্ব দিয়ে এলাকাবাসীর বলিষ্ঠ আন্দোলন গড়ে তোলেন। এতে প্রশাসন পিছু হঠতে বাধ্য হয়। এলাকার সবাই উৎকণ্ঠিত ছিলেন, অক্ষত অবস্থায় এডভোকেট জানে আলম ক্যান্টনমেন্ট থেকে ফিরে আসতে পারবেন কিনা। নাকি আবারও অন্যায়ভাবে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হবেন? কিন্তু তিনি বীরোচিতভাবে সেনানিবাস থেকে নিজ এলাকায় ফিরে আসেন। সেনা কর্মকর্তারা তাঁকে উপর্যুপরি একই প্রশ্ন করে – আপনার এতো দায়িত্ব কেন? আপনাকে কে বলেছে এলাকাবাসীর পক্ষাবলম্বন করে প্রশাসনের বিপক্ষে যেতে। তিনি উত্তরে শুধু একটি কথাই বলেছেন- ১৯৭১ সালে মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে আমাকে যুদ্ধে যেতে কে বলেছে?
একাধারে শিক্ষক, রাজনীতিবিদ, সমাজসেবক, লেখক, নাট্যকার, অভিনেতা, সংগঠক ইত্যাদি গুণে গুণান্বিত এডভোকেট জানে আলম চৌষট্টি বছর বয়সে জন্মবার্ষিকীর মাত্র দুই দিন আগে ২০২১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর আমাদেরকে ছেড়ে সবকিছুর উর্ধ্বে চলে গিয়েছেন। কাল তাঁর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে এডভোকেট জানে আলমকে স্মরণ করছি। কারাগারে বসে ১৯৮৮ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি তাঁরই রচিত ‘ঘাতক তুমি পালাবে কোথায়’ কবিতাটি দিয়ে ;
‘আমার বোনের অতৃপ্ত হৃদয়ে / বৈধব্যের শোকাগ্নি জ্বেলে / ঘাতক তুমি পালাবে কোথায়? / সদ্য ফোটা কমলসম / নবজাতককে এতিম করে / ঘাতক তুমি পালাবে কোথায়? / মাতৃবক্ষ শূন্য করে / শোকসাগরে ভাসিয়ে দিয়ে / ঘাতক তুমি পালাবে কোথায়? / নিভন্ত চিতায় দাবাগ্নি জ্বেলে / শ’য়ে শ’য়ে দাপন সেরে / ঘাতক তুমি পালাবে কোথায়? / তরুণ ভায়ের ক্ষুব্ধ পাঁজরে / তপ্ত শীশার বুলেট বিঁধে / রক্ত নিয়ে হোলি খেলার / লাল ছোপ ছোপ দাগ লুকিয়ে / ঘাতক তুমি পালাবে কোথায়?’
সহায়ক গ্রন্থ :‘কিশোর গেরিলা’ বীর মুক্তিযোদ্ধা, প্রখ্যাত শ্রমিক নেতা এডভোকেট জানে আলম স্মারকগ্রন্থ- সম্পাদক, শিল্পী আবু নাসের রবি।
লেখক: নাট্যকর্মী ও শিক্ষক, সম্পাদক, নাট্যমঞ্চ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআর কতো রক্ত ঝরলে ডিভাইডার হবে
পরবর্তী নিবন্ধহৃদয়ের যত্নে হৃদয়বান হোন