আর কতো রক্ত ঝরলে ডিভাইডার হবে

রুনা তাসমিনা | মঙ্গলবার , ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৬:০২ পূর্বাহ্ণ

সড়ক দুর্ঘটনা। আমাদের প্রতিদিনের নির্ধারিত কাজের মতো, নির্ধারিত ঘটনা। প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন জায়গায় সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছে অনেক মানুষ। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে সেসব খবর আমরা পাই। যখন এক, দু’জনের মৃত্য সংবাদ পাই তখন কষ্ট লাগাটা নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। যখন অনেক প্রাণ একসাথে যায় কিছুদিন খুব ঘটা করে হৈ চৈ হয়। তারপর সব থেমে যায়। ফটিকছড়ি যাওয়ার রাস্তাটা একসময় ছিলো অনেক ছোটো। গাড়ি চলতো অনেক সাবধানে। দুর্ঘটনা তখনও হতো। কিন্তু বর্তমানের মতো নয়। এখন রাস্তা হয়েছে অনেক প্রশস্ত। দৃষ্টিনন্দন ওই সড়ক উত্তর চট্টগ্রামের মানুষের জন্যে আশীর্বাদ স্বরূপ। কিন্তু এটি এখন হয়ে দাঁড়িয়েছে মরণফাঁদ। ওই সড়কে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানো মানুষের সঠিক সংখ্যা হয়তো খুঁজে পাওয়াও যাবে না। অনেক মৃত্যু সংবাদ চাপা পড়ে যায় আরও বড়ো কোনো সংবাদের ভীড়ে। কিছুদিন আগের ঘটনা।
গ্রামের বাড়ি ফটিকছড়ি থেকে ফিরছিলাম শহরে। ছোটো রাস্তাটি বিস্তৃত হয়ে এখন অনেক সুন্দর আর মসৃণ। বৈশাখী ফুল জারুল, সোনালু আর কৃষ্ণচূড়ার বেগুনি, হলুদ, লাল রঙ মাঝে মাঝে রূপের মাধুরি মেখে জানান দিচ্ছে সবুজের মাঝখানে তাদের অস্তিত্ব। রাস্তার পাশে গাছে গাছে দোল খাওয়া আমগুলো দেখে ইচ্ছে করছিলো শৈশবের মতো ঢিল ছুঁড়ে পেড়ে আনি। অনেকদিন পর পর বাড়িতে যাওয়া হয় বলে হয়তো এই রূপ আমার কাছে মোহনীয়। শুধু আমি নই, ওদিকে যারা হঠাৎ যান প্রত্যেককেই রাস্তার এই সৌন্দর্য চোখ জুড়িয়ে দেয় বলে আমার বিশ্বাস। কিন্তু যারা প্রতিদিন এই পথে যাতায়াত করেন তারা জীবন নিয়ে ঘরে ফিরতে পারলেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন কথাটির প্রমাণ পেলাম চলতি পথেই।
সময়টা সাড়ে তিনটা, চারটা হবে। স্কুল ছুটি হয়েছে তখন। কাটির হাটের ওদিকে একটা জটলা। সবাই ছাত্র। ঘটনা কী দেখার জন্যে দাঁড়িয়ে শুনলাম, একজন ছাত্রকে মোটর সাইকেল ধাক্কা দিয়েছে। ছাত্রটি বেশি আঘাত পায় নি। বললাম, এতো বড়ো রাস্তা। তবুও কেনো গাড়ি চালকরা এভাবে এলোপাতাড়ি গাড়ি চালায়? সিএনজি চালিক মিনহাজ বললেন, রাস্তা বড়ো হয়ে সমস্যা আরও বেড়েছে। যার যেমন খুশি গাড়ি চালায়। প্রতিদিন কোথাও না কোথাও এক্সিডেন্ট হয়। প্রতিদিন হাটহাজারি থেকে হেঁয়াকো পর্যন্ত রাস্তা ভেসে যায় কখনো একজন কখনো কয়েকজনের রক্তে। বললাম, এর সমাধান কী? মিনহাজ বললেন, ডিভাইডার আপা। বড়দিঘির পাড় পর্যন্ত যেরকম ডিভাইডার আছে, ওরকম ডিভাইডার হাটহাজারি থেকে হেঁয়াকো পর্যন্ত দিলে গাড়িগুলো আর এরকম বেপরোয়া গতিতে চলতে পারবে না। কথাটি সিএনজি চালক মিনহাজের একার নয়, ওই এলাকায় বসবাসকারী প্রত্যেক মানুষের। বিভিন্ন সময়ে পত্রিকায় পড়েছি এই পথের কোথাও না কোথাও দুর্ঘটনার খবর। সেদিন একেবারে নিজ চোখে দেখলাম। হাটহাজারী থেকে বেপরোয়া গতিতে চলা ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হচ্ছে মোটরসাইকেল আরোহী, সিএনজি চালক-যাত্রী। সেদিন আসার সময় আরও একটি ভয়ংকর দৃশ্য চোখে পড়লো। যেটিকে বলা যায় ভয়ংকর সুন্দর। চোখ জুড়ানো রাস্তার সৌন্দর্যকে নিজের স্মৃতিতে ধরে রাখতে গিয়ে তারা হয়তো এই কাজ করে। মোটরসাইকেলে বসে চলন্ত অবস্থায় ভিডিও করা। যা মৃত্যুর আরেকটি কারণ বলে আমার মনে হলো। বিস্তৃত রাস্তা হওয়ায় ওরা হয়তো মনে করে গাড়ি পাশ কাটিয়ে চলে যাবে। যাচ্ছেও অনেক গাড়ি। ওই পাশ কাটাতে গিয়েই ঘটছে দুর্ঘটনা। অপরদিক থেকে আসা গাড়ির সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হচ্ছে। কেউ শেষ নিঃশ্বাস ফেলছে স্পটেই। কেউ হাসপাতালে। শুধু গত একমাসের হিসেবে এই পথে প্রাণ হারিয়েছে ৩০ জনেরও বেশি মানুষ। একটি ব্যবস্থা অতিসত্ত্বর নেয়া না হলে এই পথে আরও প্রাণ ঝরবে। কিছুদিন আগে বিলে গরু চরাতে দিয়ে রাস্তার ধারে বিশ্রাম নিতে বসেন বৃদ্ধ আবুল কাসেম। সিমেন্ট বোঝাই বেপরোয়া গতিতে ছুটে আসা একটি ট্রাক একদম গায়ের উপর! গুরুতর আহত বৃদ্ধ আবুল কাসেমকে হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানেই তিনি মৃত্যু বরণ করেন। দৈনিক আজাদী সুত্রে এই খবর জানতে পেরেছি। তার মানে, শুধু রাস্তায় চলাচল করার সময়ে যে মানুষ দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন তা নয়। রাস্তার পাশেও তারা নিরাপদ নন। গত ছয় মাসে অন্তত ৭০/৮০ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন অত্যন্ত সুন্দর এই পথে। এসব মৃত্যুর প্রতিবাদে ফটিকছড়িসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রতিবাদ মিছিল, মানববন্ধন হলেও প্রশাসনের ভূমিকা নীরব। মৃত্যুর এই মিছিল ঠেকাতে ও গাড়ির গতিরোধ করতে এই পথে গতি নির্ধারক আইন খুবই জরুরি। জরুরি অতিদ্রুত একটি ডিভাইডার। প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় যতো মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে তা অতিমারি করোনাকেও হার মানিয়েছে। আমরা একটি মানুষের মৃত্যু হিসাব রাখি। কিন্তু যদি মানুষটির পেছনে তাকাই, দেখা যাবে একটি পরিবারের মৃত্যু হয়েছে। অনেক সময় এলাকাবাসী কিংবা সরকারের পক্ষ থেকে সাহায্য সহযোগিতা আসে। কিন্তু এই সাময়িক সাহায্য সহযোগিতায় একটি পরিবারের জীবন চলে না। তাই উচিত পরিবারটির সেই জীবনকে রক্ষা করা। হাটহাজারি থেকে হেঁয়াকো পর্যন্ত নবনির্মিত অপূর্ব সুন্দর এই রাস্তা দিন দিন রঞ্জিত হচ্ছে তরতাজা রক্তে। প্রত্যেক সুন্দর তখনই প্রকৃত সুন্দর হয়ে ওঠে যদি সেই সৌন্দর্য গোছানো থাকে। আমরা নিজেকে যেমন পরিপাটি করে রাখতে পছন্দ করি, তেমনি আমাদের কাজগুলোও তেমন হোক। আমাদের দায়িত্বগুলোও যেনো সমালোচিত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা খুবই জরুরি।
একসময় গ্রামগঞ্জের রাস্তাঘাট ছিলো অনুন্নত। যাতায়াত ব্যবস্থার অসুবিধার কারণে অনেক মানুষ গ্রাম ছেড়ে শহরে এসেছেন সন্তানের পড়ালেখা, পেশাগত কারণ কিংবা অসুস্থতায় দ্রুত চিকিৎসা সেবা পাওয়ার জন্যে। কিন্তু অতিমারি করোনার প্রভাবে অনেকেই হারিয়েছেন আর্থিক সচ্ছলতা। যার জন্যে আবারও তাঁদের ফিরে যেতে হয়েছে গ্রামে। এই দুই আড়াই বছরে যাতায়াত ব্যবস্থায় এসেছে বিরাট পরিবর্তন। অনুন্নত রাস্তা হয়েছে মসৃণ, প্রসারিত। শহরে যাওয়া-আসার সুব্যবস্থা। যার জন্যে অনেকেই আর শহরে ফেরেননি। তারা গ্রাম থেকেই তাদের কর্মস্থলে আসা-যাওয়া করেন। মোটরসাইকেল, লোকাল সিএনজি, মাইক্রোবাস, কার, বাস এসব যানবাহনে তারা যাতায়াত করেন। কিন্তু গাড়ির অনিয়ন্ত্রিত গতির কারণে ঘটছে সড়ক দুর্ঘটনা। প্রাণ হারাচ্ছে অনেক মানুষ। উন্নয়ের জোয়ার আমাদের দেশে। কিন্তু উন্নত কিংবা কঠোর বিধিনিষেধ আসছে না কিছু কিছু ব্যবস্থাপনায়। হাটহাজারি থেকে হেঁয়াকো পর্যন্ত সড়কে ডিভাইডার খুবই জরুরি। এই ডিভাইডারের দাবীতে অনেক মানববন্ধন, প্রতিবাদ সভা হয়েছে। কিন্তু প্রশাসনের নীরব ভূমিকার কাছে ওই প্রান্তের মানুষ হার মানতে বাধ্য হয়েছে অনেকটা। তবুও অপেক্ষা একটি ডিভাড়ারের। শুধু উত্তর চট্টগ্রামের এই সড়কের জন্যে নয়, আমরা চাই এদেশের প্রত্যেক সড়ক নিয়ন্ত্রণে আসুক কঠিন নীতিমালা। যা প্রত্যেককে অনুসরণ করতে বাধ্য করা হবে। সে পদযাত্রী হোক কিংবা গাড়ির চালক। সড়কে রক্তপাতহীন একটি দেশ চাই আমরা সবাই।
লেখক: শিক্ষক, গল্পকার, সম্পাদক, অনন্য ধারা

পূর্ববর্তী নিবন্ধময়নাতদন্ত
পরবর্তী নিবন্ধপ্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে স্মরণ : কিশোর টুআইসি জানে আলম