পোড়াবাড়ি রহস্য

সরোজ আহমেদ | বুধবার , ২৯ ডিসেম্বর, ২০২১ at ৬:০৯ পূর্বাহ্ণ

সিয়ামদের গ্রামের নাম ডুমুরিয়া। ছোট্ট গ্রামটি ছবির মত সুন্দর। গ্রামের এক পাশে সাপের মত এঁকে বেঁকে বয়ে গেছে ইছামতি খাল। তিন পাশে বিস্তৃর্ণ সবুজ ফসলের ক্ষেত। যেদিকে চোখ যায় সবুজ আর সবুজ। গ্রামটি যেমন অপরূপ তেমনি ঐতিহ্যবাহীও বটে।
এক সময় এই গ্রামে ছিল বিখ্যাত এক জমিদার। তাঁর যেমন বিশাল জমিদারি ছিল, তেমন ছিল পরিচিতি। তবে এখন আর সেই জমিদারও নেই, জমিদারিও নেই। আছে কেবল পরিত্যক্ত বিশাল এক বাড়ি। যা পোড়াবাড়ি নামেই পরিচিত।
এই পোড়াবাড়ি নিয়ে রয়েছে অনেক কাহিনী। এক সময় এই বাড়িটিতে সারাবছর লেগে থাকতো নানা উৎসব আয়োজন। বিশেষ করে নাচ-গানের আসর বসতো প্রায়ই। আর এসব আসর জমাতে সুদূর কলকাতা থেকে নাচ-গানের শিল্পীরা আসতেন দলবেঁধে। তারা মাসের পর মাস জমিদার বাড়িতে থাকতেন। রাতভর নাচঘরে নাচতেন আর গাইতেন।
কোন এক সময় জমিদারের সঙ্গে জায়গা-জমি নিয়ে এলাকার সাধারণ লোকজনের বিরোধ বাঁধে। প্রতাপশালী জমিদার বলে কথা। নিজের কর্তৃত্ব বজায় রাখতে এলাকার নিরীহ লোকজনের ওপর শুরু হলো অত্যাচার, নির্যাতন। এমনকী বেশ কয়েকজনকে ধরে নিয়ে প্রকাশ্যে ফাঁসিতেও ঝুলানো হয়। দিন দিন জমিদারের অত্যাচারের মাত্রা যায় ছাড়িয়ে। অবশেষে গ্রামবাসী একাট্টা হয়ে হামলা চালায় জমিদার বাড়িতে। ব্যাপক ভাংচুর, লুটপাট শেষে বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। জনতার শক্তির কাছে ক্ষমতাধর জমিদার মুহূর্তেই অসহায় হয়ে পড়েন। কিন্তু এতদিন ক্ষমতার দম্ভে মানুষকে মানুষ বলেই মনে করেননি তিনি। অবস্থা বেগতিক দেখে বাড়ির গোপন পথ দিয়ে পালিয়ে বাঁচলেন দাম্ভিক জমিদার ও তাঁর পরিবারবর্গ।
লোকমুখে শোনা যায়, জমিদার সেসময় পালিয়ে বার্মায় চলে গিয়েছিলেন। এরপর আর কখনো এলাকায় ফিরে আসেন নি তিনি বা তাঁর বংশধররা।
সেদিনের আগুনে জমিদার বাড়ির বেশিরভাগ পুড়ে গেলেও কিছু অংশ অক্ষত ছিল। এক সময় পোড়াবাড়িতে ঘন জঙ্গলে ভূতুড়ে পরিবেশের সৃষ্টি হয়। প্রথম প্রথম ওই পোড়াবাড়িতে বেশ কয়েকজনের ছিন্ন ভিন্ন লাশ পাওয়া যায়। ফলে সবার মুখে মুখে রটে যায়, পোড়াবাড়িতে ভূতের দল আস্তানা গেড়েছে। মাঝে মাঝে গ্রামের কেউ না কেউ হারিয়ে যেত। পরে হারানো লোকজনের লাশ মিলতো পোড়াবাড়ির আশপাশে। তাই ভয়ে দিন দুপুরেও পোড়াবাড়ির দিকে যাওয়ার কেউ সাহস করে না।
সিয়াম, জুবেদ ভার্সিটি পড়ুয়া যুবক। তারা আবার এসব ভূত টূতে বিশ্বাস করে না। মুরুব্বীরা যখন পোড়াবাড়ির ভূত নিয়ে গল্প করে, তখন এসব শুনে ওরা হাসে।
কেউ কেউ বলে- গভীর রাতে পোড়াবাড়িতে ভূতরা দলবেঁধে নৃত্য করে। জোৎস্না রাতে দূর থেকে সেই নৃত্য তারা অনেকেই দেখেছে। আবার কেউ বলে- পোড়াবাড়ির আশপাশে কাউকে একা পেলে ভূতরা ঘাড় মটকে দেয়। গ্রামের কয়েকজন একত্রিত হলেই ব্যস, শুরু হয় পোড়াবাড়ির গল্প।
এসব আজগুবি গল্প-কাহিনী শুনতে শুনতে সিয়াম, জুবেদের মনে কৌতুহল জাগে। পোড়াবাড়ির রহস্য অনুসন্ধানে মাঠে নামে তারা। তবে বিষয়টি সিক্রেট রাখা হয়। কারণ ঘটনা ফাঁস হলে তাদের অনুসন্ধান মাঠে মারা যাবে। পরিবারের কেউ চাইবে না ভয়ানক কাজটি করতে গিয়ে ওদের কোনো ক্ষতি হোক।
দুই বন্ধু এ নিয়ে কখন কিভাবে, কী করবে তার একটা ছক তৈরি করল। এখন ভরা পূর্ণিমা। এসময় কাজে নামার উত্তম সময়। সুতরাং দেরি করে কাজ নেই। আজ রাত বারোটার পর শুরু হবে পোড়াবাড়ি রহস্য উদ ঘাটন অভিযান।
জুবেদ বলল, ‘তুই বর পুকুর ঘাটে অপেক্ষা করবি। আমি সেখানে সময় মতো চলে আসবো। তারপর একসঙ্গে শুরু হবে মিশন।’
‘ওকে দোস্ত, তাই হবে।’
এদিকে কথা মতো রাত বারোটায় ঘর থেকে বেরিয়ে বরপুকুর ঘাটে এসে জুবেদের জন্য অপেক্ষা করে সিয়াম। দেখতে দেখতে সময় পেরিয়ে যায়, কিন্তু জুবেদের পাত্তা নেই। খুব রাগ হচ্ছে সিয়ামের। ছেলেটা যে এমন করবে ভাবা যায় না। অথচ এ ব্যাপারে বেশি আগ্রহ দেখিয়েছে জুবেদ নিজেই। আর সেই কীনা শেষ পর্যন্ত ……।
রাগে সারারাত ঘুম হয়নি সিয়ামের। সকাল সকাল জুবেদের বাড়ি গিয়ে হাজির। জুবেদ সিয়ামের হাত ধরে ক্ষমা চায়, ‘দোস্ত তুই তো জানস, আমি একটু ঘুমকাতুরে। ভাত খেয়ে বিছানায় একটু গড়াগড়ি করতে গিয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি টের পাইনি।’
সিয়াম রাগে হাত ছাড়িয়ে নেয়। সিয়ামকে জড়িয়ে ধরে জুবেদ আবার বলল, ‘প্রমিজ। আজ আর মিস হবে না দোস্ত। তুই পুকুরঘাটে থাকবি, আমি সময় মতো পৌঁছে যাবো।’
সিয়াম আজও আগেভাগে পুকুরঘাটে গিয়ে অপেক্ষা করে জুবেদের জন্য। বসতে বসতে সময় পেরিয়ে যায়। কিন্তু জুবেদের দেখা নেই। তারমানে সে আজও আসবে না! তাই শুধু শুধু রাত জেগে কাজ নেই। সিয়াম বাড়ির দিকে রওনা দিবে এমন সময় জুবেদ এসে হাজির। যাক, এসেই যখন গেছে, আর কথা না বাড়িয়ে তারা রওনা দেয় পোড়াবাড়ির দিকে। গভীর রাতেও জ্যোস্নার আলোয় ভেসে যাচ্ছে চারদিক। পথ চলতে এতটুকু অসুবিধা হচ্ছে না তাদের। মাত্র কয়েক মিনিট হেঁটেই পৌঁছে গেল পোড়াবাড়িতে।
আগের থেকে বলা ছিল, প্রথম দিন পোড়াবাড়িতে ঢুকবে না তারা। বাড়ির পেছনে বড় কৃষ্ণচূড়া গাছটার আড়ালে বসে সব কিছু দেখার চেষ্টা করবে।
কথা মতো কৃষ্ণচূড়া গাছের আড়ালে অবস্থান নেয় তারা। চারদিকে সুনসান নীরবতা। একটা ঝিঁ পোকার শব্দও নেই কোথাও। হঠাৎ কানে ভেসে এলো ঝুম ঝুম নূপুরের শব্দ! পোড়াবাড়ির নাচঘরের দিকে চোখ ফেরাতেই দেখা গেল একসঙ্গে অনেকগুলো ছায়ামূর্তি নাচছে তালে তালে। সিয়াম, জুবেদ একে অপরের দিকে তাকায় আর ঢুক গিলে। দুজনের গলা শুকিয়ে কাঠ। কারও মুখে কোনো কথা নেই। সিয়াম ইশারা দিতেই জুবেদও সিয়ামের পেছন পেছন দ্রুত পা চালায় বাড়ির দিকে।
পরদিন ভোরে সিয়ামকে ঘুম থেকে ডেকে দিয়ে মা রাগিস্বরে বলেন, ‘আর কত ঘুমাবি! জুবেদ সেই কখন থেকে এসে বসে আছে।’ ‘আমার ঘুম পাচ্ছে। পরে আসতে বলো।’ বিরক্ত দেখিয়ে ওপাশ হয়ে শোয় সিয়াম। মা রুম থেকে বেরিয়ে যেতেই জুবেদ চলে আসে। ‘দোস্ত, আমি জানি তুই আমার ওপর রাগ করে আছিস। কিন্তু বিশ্বাস কর, আমি ইচ্ছে করেই এমনটি করিনি। কালকে হঠাৎ জ্বর আসছিল, তাই বেরুতে পারিনি।’
সিয়াম পাশ ফিরে চোখ কচলাতে কচলাতে বলল, ‘কী বলছিস তুই! রাতে ভূতের নাচ দেখে মাথা গুলিয়ে গেছে, না! আসতে পারিসনি মানে কি?’
‘আরে সেটাই তো বলতে এলাম তোকে। কাল সন্ধ্যায় হঠাৎ এমন জ্বর এলো, মাথা তুলতেই পারছিলাম না। তারপরও বেরুতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মা বেরুতে দেয়নি বিশ্বাস কর।’
জুবেদের কথা শুনে সিয়াম হুড়মুড় করে বিছানায় উঠে বসে। তারপর ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে জুবেদের মুখের দিকে। জুবেদ এসব কী বলে! রাতে দুজন একসঙ্গে পোড়াবাড়িতে যাওয়া, ভূতের নৃত্য দেখে ভয়ে পালিয়ে আসা-তাহলে এসব! আর সঙ্গেই বা ওটা কে ছিল? ভাবতেই মাথায় চক্কর দিয়ে ওঠে। এমন কনকনে শীতের সকালেও সিয়ামের শরীর ভিজে যায় ঘামে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকি ছু জা না কি ছু অ জা না
পরবর্তী নিবন্ধযাকে হত্যা, তার মায়ের কাছেই আশ্রয় নেয় খুনি