পিরামিডের ভেতরে

রিয়াজুল হক | বুধবার , ২৩ নভেম্বর, ২০২২ at ১০:২২ পূর্বাহ্ণ

তোমাদের অনেকেই মিশরের পিরামিডের কথা শুনেছো। ফারাও খুফুর পিরামিড পৃথিবীর প্রাচীন সপ্তাশ্চর্যের একটি যা এখনও টিকে আছে। তোমরা কী ধারণা করতে পারো এটি কত বড় ছিল? হ্যাঁ, এটির উচ্চতা ছিল ১৪৬.৬ মিটার এবং এর ভিত্তির দৈর্ঘ্য ছিল ২৩০.৬ মিটার। পিরামিডটি তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছিল আনুমানিক ২৬ লক্ষ ঘন মিটার বড় বড় পাথরের খণ্ড এবং মোট ৬০ লক্ষ টন পাথর।

২,৫৭৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে খুফু সিংহাসনে আরোহণের সাথে সাথে তাঁর চূড়ান্ত বিশ্রামের স্থান নির্মাণের আদেশ দেন এবং হেমিয়ুনুকে স্থপতি হিসেবে নিয়োগ করেন। হেমিয়ুনু হিসাব করে দেখলেন যে কাজটি সম্পন্ন করতে ২০ বছর লাগবে যদি প্রতিটি পাথর খণ্ড প্রতি তিন মিনিটে উঠানো, পরিবহন এবং স্থাপন করা যায় এবং ৩৬৫ দিন ধরে কাজ করা যায়। তাই তিনি ২৫ হাজার শ্রমিক নিয়োগ করেছিলেন।

খুফু বা হেমিয়ুনু কী ধারণা করতে পেরেছিলেন যে তাদের নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভ ৩,৮০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বিশ্বের বৃহত্তম মানবসৃষ্ট কাঠামো হিসেবে টিকে থাকবে? সম্ভবত না।

কিছুদিন আগে প্রাচীন সেই সপ্তাশ্চর্যের একটি অর্থাৎ এই পিরামিড দেখতে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। কী আশ্চর্য সেই সৃষ্টি! বড় বড় পাথরের খণ্ড পেরিয়ে এবং একটি ছোট সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গিয়ে আমরা খুফুর রাজত্বকাল ২,৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ফিরে গিয়েছিলাম কিছুক্ষণের জন্য।

কল্পনা করলাম, আমাদের সামনে কয়েক হাজার শ্রমিক কাজ করছে। তারা নীল নদে নোঙ্গর করা বজরা থেকে দেবদারু গাছের গুঁড়ির তৈরি স্লেজ দিয়ে পাথরের খণ্ডগুলো টেনে আনছে। শ্লোগান দিয়ে নিজেদের উজ্জীবিত রাখছে। প্রকৌশলী এবং ফোরম্যান তাদের কাজ তদারকি করছে।

ইতিহাস থেকে আবার বর্তমান সময়ে ফিরে এসে আমরা নিজেদের পিরামিডের প্রবেশদ্বারের মুখে আবিষ্কার করলাম। এর কিছুটা উপরে অবস্থিত মূল প্রবেশদ্বারটি এখন বন্ধ আছে। তাই দর্শনার্থীরা পরে সংযোজিত অস্থায়ী প্রবেশদ্বার দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। দিনের আলোকে বিদায় জানিয়ে আমরা আবছা আলোয় গা ছম ছম করা পরিবেশে রুক্ষ একটি পথ অতিক্রম করে মূল প্রবেশ পথের সংযোগস্থলে পৌঁছালাম। এর পর মাথা নিচু করে আমরা প্রায় ৪০ মিটার লম্বা কাঠ বিছানো সিঁড়ি বেয়ে পৌঁছালাম গ্র্যান্ড গ্যালারির গোড়ায়। সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সুবিধার জন্য খাঁজযুক্ত কাঠ বিছানো ছিল। এছাড়াও দেওয়ালের সামনে কাঠের রেলিং যুক্ত করা ছিল। তবে এই সরু পথ দিয়ে উপরে ওঠা এবং নিচে নামা এত সহজ কাজ ছিল না।

গ্র্যান্ড গ্যালারিকে স্থাপত্যকলার একটি অবিশ্বাস্য নিদর্শন হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। অনন্য খাঁজওয়ালা দেয়াল এবং এর সুন্দর কারুকার্য আমাদের সত্যিই মন্ত্রমুগ্ধ করেছে। গ্যালারিটি প্রায় ৪৬ মিটার দীর্ঘ এবং ৮.৬ মিটার উঁচু। এখানে আমরা সোজা হয়ে হাঁটতে পেরেছিলাম। গ্র্যান্ড গ্যালারি দিয়ে অ্যান্টিচেম্বারে যেতে বেশ সময় লেগেছিল। এখানে ছিল খুবই গরম এবং দমবন্ধকর অবস্থা কারণ প্রতিদিন এখানে অনেক দর্শনার্থী প্রবেশ করে।

দীর্ঘ এবং ঘর্মাক্ত আরোহণের পর আমরা অবশেষে পিরামিডের সর্বোচ্চ স্থানে পৌঁছাতে পারলাম। গ্র্যান্ড গ্যালারির শীর্ষে পৌঁছে অ্যান্টিচেম্বার থেকে আমরা গ্র্যান্ড গ্যালারির দিকে ফিরে তাকালাম। সেটা ছিল দেখে থাকার মতো একটা দৃশ্য।

তারপর প্রায় এক মিটার উঁচু একটি দরজার মধ্য দিয়ে একটি আয়তাকার কুঠুরিতে প্রবেশ করলাম আমরা। এটি ছিল রাজার কুঠরি। এই কুঠুরিতে শুধু একটি জিনিসই অবশিষ্ট ছিল এবং তা হলো কফিনটি। মজার বিষয় কী জানো? কফিনটির আকার রাজার কুঠুরিটির দরজার চেয়ে বড় ছিল। তার মানে হলো দরজাটি কাটার আগেই কফিনটি রাখা হয়েছিল কুঠুরিটিতে।

কাজ একবার সম্পন্ন হয়ে গেলে পিরামিডটি সাদা চুনাপাথর দিয়ে আস্তর দেওয়া হতো। এরপর বালি ও পাথর দিয়ে ঘষে পালিশ করা হতো যতক্ষণ না এটি জ্বলজ্বল করে। সবশেষে ইলেক্ট্রামের তৈরি একটি ক্যাপস্টোন চূড়ায় বসিয়ে দেয়া হতো। চূড়াটি পুরো মিশরের উপর দ্বিতীয় সূর্যের মতো জ্বলজ্বল করতো এবং ফেরাউনের মহিমা ঘোষণা করতো। তোমরা কি কখনও ভেবে দেখেছো পিরামিড নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার আগেই রাজা মারা গেলে কী হতো? তাই, সবসময়ই একাধিক সমাধি কুঠুরি তৈরি রাখা হতো। খুফুর পিরামিড নির্মাণের সময় তিনটি সমাধি কক্ষ তৈরি করা হয়েছিল। শেষটি হচ্ছে রাজার কুঠুরি।

এই রাজার কক্ষে কয়েক মিনিট থাকার পর আমরা ফিরতি যাত্রা শুরু করি। পিরামিড থেকে বেরিয়ে আসি একটি রহস্যময় অনুভূতি নিয়ে। বাইরে এসে বুক ভরে বিশুদ্ধ বাতাস নিলাম যা থেকে আমরা কিছুক্ষণের জন্য বঞ্চিত ছিলাম। তারপরও পিরামিডের ভেতরটা দেখে আসার মতো দারুণ এ অনুভূতি কখনও ভোলার নয়। পিরামিডের বাইরেরটা আমাদের মাঝে যতটা আশ্চর্য হওয়ার অনুভূতি জাগায় তার চেয়ে কম শিহরণ জাগায়নি এর ভেতরটা। তাই তোমাদেরও কখনও সুযোগ হলে অবশ্যই পিরামিড দেখে আসতে ভুলো না যেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদিনগুলি সেই
পরবর্তী নিবন্ধফটিকছড়ি হাইদচকিয়ায় শীতবস্ত্র বিতরণ