পিতা-পুত্রীর এক সোনাঝরা বিকেল : ‘পেছনে তাকালে বুক হু হু করে ওঠে’

ববি বড়ুয়া | শনিবার , ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ at ৫:৪৬ পূর্বাহ্ণ

পিতা আর কন্যাকে নিয়ে ছোট্ট ম্যাচ বাক্সের মতো গাড়িটির পাইলট প্রদীপ বাবুর সুদক্ষ চালনায় চলেছি চিরচেনা কাপ্তাইয়ের পথ ধরে রাউজানের পাহাড়তলীর উদ্দেশে একটি সামাজিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। ‘চিরচেনা’ শব্দটি বলেছি এজন্য যে শ্বশুরবাড়ি, বাবার বাড়ি, বোনের বাড়ি, বাবার বোনের বাড়ি, মায়ের বোনের বাড়ি, মোটামুটি সবার শ্বশুরবাড়ি এই পথেই। আবার রাঙাামাটি-কাপ্তাই ঘুরতে যেতে এই পথকেই সঙ্গী করে নিতে হয়।
রাস্তার কিছু অংশে মেরামতের কাজ চলার কারণে রাউজানের এক জায়গায় সোজা পথে না গিয়ে হঠাৎ ডান দিকে মোড় নিতে শুরু করল অচেনা, অদেখা পথ ধরে। কেন যেন একটু বিস্মিত হলাম পথ ও পথের ধারের চারপাশটা দেখে। দক্ষিণ রাউজানের বাগোয়ান ইউনিয়নের কোল ঘেঁষে ‘লাম্বুর হাট’। নামটা দেখে আরও একটু চমকিত হলাম। ছোটবেলা থেকে শুনে আসা চট্টগ্রামের একটি বহুল প্রচলিত প্রবাদ, “শখের চেয়ে লাম্বুর হাট দূরে নয়।” এর অর্থ দাঁড়ায় শখ পূরণে অনেক দূরের লাম্বুরহাটকেও দূরে মনে হয় না। শখের প্রাধান্য দিতে হয় সর্বাগ্রে। সেই লাম্বুর হাট হয়ে গাড়ি ধীরে ধীরে সামনের দিকে এগিয়ে চলেছে চালকের সুনিপুণ কৌশলে। যেতে যেতেই মনটা কেমন যেন বিচলিত হয়ে উঠল। কিছুক্ষণ ডানে, কিছুক্ষণ বামে তাকিয়ে চলেছি অবিরাম। গ্রামের বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ। শীতের মৌসুমে ধান গাছের দেখা না মিললেও তার অভাব পূরণ করেছে রকমারি শাক ও সবজি বাগানে। তাতে ধরে আছে থোকা থোকা শিম, সবুজ বা বেগুনি রঙের ভিন্ন আকারের কিংবা ভিন্ন গড়নের বেগুন। যতই গাড়ি সামনে এগোচ্ছে ততই চোখে পড়তে শুরু করল ভরা যৌবনা কর্ণফুলী। যৌবনের বাঁধ ভাঙা তরঙ্গ ক্রমেই মনকে আকৃষ্ট করে চলেছে। আর সেই কর্ণফুলীর বুক চিরে বয়ে চলেছে ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকা।
পথে যেতে যেতে পিতা তার কন্যাকে বর্ণনা করে চলেছেন একের পর এক পথের নাম, নামকরণ এবং একই সাথে তাদের ঘিরে নানা গল্প। গল্পগুলো শুনতে শুনতে কন্যাও ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে তার শৈশবের পিতার কাছে। সেই ছোটবেলাতেও এভাবেই তাঁর কন্যাটি তার পিতার সঙ্গে সঙ্গে চলে যেত শহর হতে গ্রাম, গ্রাম হতে গ্রামান্তরে বিভিন্ন ধর্মীয় কিংবা সামাজিক অনুষ্ঠানে। যেতে যেতে এভাবেই তাকে বর্ণনা করে চলত। যেন এক অভাবনীয় চলমান বিদ্যাপীঠ। কন্যাটির হয়ত কিছু মনে আছে, তো কিছু নেই। কন্যাটি যখন তার পিতার সাথে অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছাত তখন গণমানুষের ভালোবাসায় সিক্ত অভ্যর্থনা, মঞ্চে অন্যান্য আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের সাথে বসা, দাঁড়িয়ে সগর্বে বক্তব্য রাখা। আর বক্তব্যে অন্তর্ভুক্ত হতো কখনো সামাজিক উন্নয়ন, কখনো মানুষের পাশে থাকার অঙ্গীকার। কন্যাটি শুধু তাকিয়ে থাকত আর মনে মনে হয়ত ভাবত-পারবতো এভাবে বলতে? মানুষের এত সম্মান আর ভালোবাসার কারণ হতে? স্মৃতির তোড়ে ভেসে যাওয়াতো মূলত বয়স্ক মানুষের কাজ। তবে আমি কেন আমার অবচেতন মনে হারিয়ে যাচ্ছি স্মৃতির অতল গহ্বরে? যতদূর গিয়েছি বামে সবুজ বনানীতে ঘেরা গ্রাম আর ডানে ভরা উত্তাল ঢেউ বুকে নেয়া কর্ণফুলী। কী চমৎকার! আবারো বলতে শুরু করলেন, সামনেই কিন্তু ‘খেলার ঘাট’। আমরা আসার পথে নামব।
মনে পড়ছে সেই ছেলেবেলায়, পাহাড়তলীর স্বনামধন্য পরিবারে বিয়ে হওয়া মাসীর ঘরে বেড়াতে এসে থেকে গিয়েছি কয়েক দিন। বয়স কী এমন বেশি? স্মৃতিরা কেন এসে এভাবে ভিড় করছে মনের আঙ্গিনায়? কেন ঘরের ভেতরে, বাইরে, রান্নাঘর কিংবা পাহাড়ের পাদদেশে থাকা বালির পুকুরের দিকে তাকিয়ে কী হাতড়ে ফিরছি? এদিক- সেদিক ঘুরে বেড়াচ্ছি আর কী যেন খুঁজছি? আবার একই সাথে আমার মাসতুতো ভাই- বোনগুলোর চোখের নিচে ভাঁজ। বুড়িয়ে যাওয়া মুখমণ্ডল কেন জানি কষ্টের কারণ হচ্ছে বুঝতে পারছি না। যথারীতি সামাজিক কাজ শেষ করে বেরিয়ে পড়লাম দু’জন।
ফেরার পথে পিতার শিশুসুলভ উৎকন্ঠা, উত্তেজনা। তাঁর ছোটবেলায় দেখা ‘খেলার ঘাট’ দেখার কৌতূহল। যেতে যেতে বিকেল গড়ানোর পথে। অলস বিকেলে শূন্য ফসলের মাঠে মা গরু যার কাঁধে অবলীলায় বসে কী যেন খুটখুট করে খেয়ে চলেছে একটি বড় মুরগী। তবে মা গরুটি শুয়ে শুয়ে জাবর কাটলেও সজাগ দৃষ্টি রেখেছে খেলতে থাকা বাবু গরুগুলোর দিকে। তাদের তাড়াহীন, নিশ্চিত, অলস জীবনযাপন যান্ত্রিকতায় জেঁকে বসা এই মনটিতে কিঞ্চিৎ হিংসার উদ্রেক করল বৈকি।
অবশেষে তারা এসে পৌঁছাল কাঙ্ক্ষিত ‘খেলার ঘাট’। পিতা-কন্যার ইচ্ছে খেলার ঘাটে বসে টং দোকানের গরুর দুধের চা খাবে। যেমনি ইচ্ছে তেমনি কাজ। অমনি ঝটপট নেমে দোকানীকে চায়ের কথা বলেই কিছুদূর হেঁটে বসে পড়লো কর্ণফুলীর পাড়ে। কী অনন্য সুন্দরী সে! তার বুক জুড়ে থৈ থৈ করতে থাকা জলরাশি জানান দিচ্ছে তার রূপ রসে ভরা যৌবনের অস্তিত্ব। আর ক্রমেই অদ্ভুত মাদকতায় যেন ডাকছে, “এসো এসো, আমার বুকে এসো।” পড়ন্ত বিকেলে ক্রমেই হেলে পড়তে থাকা গাঢ় কমলা সূর্যটির আভা তার বুকে আছড়ে পড়ছে। সূর্য ও কর্ণফুলীর মহামিলনের সন্ধিক্ষণে যেন তার রূপ আরও অধিক কামুক হয়ে উঠেছে। আর তাদের মহামিলনের মহাসুখ অন্তর দিয়ে অনুভব করতে করতে হাতে তুলে দেওয়া হলো গরুর খাঁটি দুধের ঘন মালাইয়ের চা। আর তার সাথে সূর্যের উন্মত্ত মিলনে উত্তাল ঢেউ। এ যেন কল্পলোকে গমন করে চলেছি অবিরাম। এত বছরের অদৃশ্য এক দূরত্ব ঘুচিয়ে যেন শৈশবের পিতার বুকে সেঁটে থাকা সেই অবুঝ কন্যায় ফিরে গেলাম। ক্যামেরায় বন্দী করে নিলাম কিছু স্মৃতি কখনো পিতার বুকে মাথা রেখে, কখনো হাত জড়িয়ে অপূর্ব এই নৈসর্গিক সৌন্দর্যকে পাশে রেখে। হে পরমপিতা, পৃথিবীর সকল পিতা আর পুত্রীকে এভাবেই ভালোবাসার আবিলতায় আবিষ্ট করে রেখো।
লেখক : প্রভাষক, ওমর গণি এমইএস কলেজ, চট্টগ্রাম

পূর্ববর্তী নিবন্ধএক রহস্যের নাম মৃত্যু
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে