পাহাড় রক্ষা করা খুবই দরকার সরকারকে কঠোর হতে হবে

| বুধবার , ৬ এপ্রিল, ২০২২ at ৬:১২ পূর্বাহ্ণ

নতুন কৌশলে পাহাড় কাটা হচ্ছে এখন চট্টগ্রামে। পাহাড়ের নিচে কিছুটা মাটি কাটা হয় বর্ষার শুরুতে, যাতে প্রবল বৃষ্টি হলে পাহাড় ধসে পড়ে। ফলে পুরো দোষটি প্রকৃতির উপর দিয়ে যায়। আবার খরচও বেঁচে যায়। তাছাড়া, পরিবেশ আইন না মেনে পাহাড় কাটা চলছে দেদারছে। বাড়ি নির্মাণ, রাস্তা সংস্কার এবং ইটভাটাসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহারের জন্যও পাহাড় কাটছে একটি চক্র। পাহাড়ের মাটি কেটে ট্রাকে করে নিয়ে যাচ্ছে পাহাড়খেকোরা। দিনের আলোয় পাহাড় কাটা চললেও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন পরিবেশকর্মীরা। গত ৪ এপ্রিল দৈনিক আজাদীতে ‘পাহাড়খেকোর দৌরাত্ম্যে ভরাট হচ্ছে নালা’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, নগরীর জিইসি মোড় সংলগ্ন গরিবুল্লাহ শাহ হাউজিংয়ের পাশ থেকে এমইএস কলেজের সামনে পর্যন্ত রাস্তার পাশে স্তূপাকারে জমা করা হয়েছে বালি। রাস্তার পাশের নালা থেকে পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা বালি তুলে জড়ো করছেন। নিকটস্থ একটি পাহাড় থেকে আসা বালিতে পুরো নালাটি ভরাট হয়ে রয়েছে। বিভিন্ন সময় নানা কৌশলে এই পাহাড় থেকে বালি ধসে পড়ে। পাহাড়টি ধসে পড়ার জন্যই নানা কৌশলের আশ্রয় নেয়ার অভিযোগ রয়েছে।
এতে আরো বলা হয়েছে, নগরীর বিভিন্ন স্থানে নানা কৌশলে পাহাড় কাটা চলছে। রাতে-দিনে চলছে কাটার কাজ। এসব পাহাড়ের মাটি ও বালি এসে পড়ছে নালায়। নালা থেকে যাচ্ছে খালে। এর সাথে বাসাবাড়ির আবর্জনায়ও নালা ভরাট হচ্ছে।… এভাবে নগরীর বেশিরভাগ নালা বালি ও মাটিতে ভরাট হয়ে রয়েছে। ভরাট রয়েছে নগরীর প্রায় প্রতিটি খাল। নানা কৌশলে পাহাড় কাটার কারণে নগরীর বেশিরভাগ নালা ভরাট হয়ে যায়। আর নালার বালি গিয়ে পড়ছে খালে। নগরীর প্রতিটি নালা যেভাবে বালিতে ভরে উঠছে তাতে আসন্ন বর্ষায় পানি নিষ্কাশনে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে।
চট্টগ্রামের পাহাড় কাটা নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশবিদ্যা ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যাপক এস এম সিরাজুল হক একটি বেসরকারি সংস্থার হয়ে ২০১১ সালে ‘হিল কাটিং ইন অ্যান্ড অ্যারাউন্ড চিটাগং সিটি’ শীর্ষক এক গবেষণা করেন। এতে বলা হয়, বেশির ভাগ পাহাড় কাটা হয় পাহাড়তলী, খুলশী, বায়েজিদ, লালখান বাজার মতিঝরনা, ষোলশহর এবং ফয়’স লেকে। ১৯৭৬ থেকে ৩২ বছরে চট্টগ্রাম নগর ও আশপাশের ৮৮টি পাহাড় সম্পূর্ণ এবং ৯৫টি আংশিক কেটে ফেলা হয় বলে গবেষণায় উল্লেখ করেন। ১৯৭৬ সালে নগরের পাঁচ থানা এলাকায় মোট পাহাড় ছিল ৩২ দশমিক ৩৭ বর্গকিলোমিটার। ২০০৮ সালে তা কমে হয় ১৪ দশমিক ০২ বর্গকিলোমিটার। এ সময়ে ১৮ দশমিক ৩৪৪ বর্গকিলোমিটার পাহাড় কাটা হয়। এটা মোট পাহাড়ের প্রায় ৫৭ শতাংশ। নগরের বায়েজিদ, খুলশী, পাঁচলাইশ, কোতোয়ালি ও পাহাড়তলী থানা এলাকায় এসব পাহাড় কাটা হয়। সবচেয়ে বেশি ৭৪ শতাংশ কাটা পড়ে পাঁচলাইশে।
পাহাড়ি এলাকা খাস জমি হলেও, বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো পাহাড় দখল করে গড়ে তোলে ভারী শিল্প কারখানা। পাহাড় দখলকারীদেরকে সাধারণত জরিমানার চাইতে বেশি শাস্তি পেতে দেখা যায় না। পরিবেশ আইনে জরিমানা ছাড়াও দুটি পৃথক শাস্তির বিধান আছে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অনুমতি সাপেক্ষে ভ্রাম্যমাণ আদালত নিয়ে অভিযান পরিচালনা এবং অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে পরিবেশ আদালতে মামলা করা। পাহাড় কাটার অভিযোগ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ সময় দেখা যায় অভিযোগ প্রমাণ করার জন্য যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করতে পারে না পরিবেশ অধিদপ্তর। তখন অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠান স্বাভাবিকভাবেই অভিযোগ অস্বীকার করে। এছাড়া, প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রভাব-প্রতিপত্তির একটা দাপট তো আছেই।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি এন্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স ইন্সটিটিউটের এক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বলেছেন, বাংলাদেশের ভূভাগের মাত্র ১২ শতাংশ জুড়ে আছে পাহাড়। পরিবেশের জন্য পাহাড় অনেক গুরুত্বপূর্ণ। জীববৈচিত্র্যের শতকরা ৮০ ভাগ বেঁচে থাকে পাহাড়ের উপর নির্ভর করে। নির্বিচারে পাহাড় কেটে চললে পরিবেশগত ভারসাম্য আর কোনভাবেই বজায় থাকবে না। দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় ভারী শিল্প-কারখানা স্থাপনের ফলে পাহাড়ের অনেক স্থানে পানির প্রবাহ বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। এতে করে সেখানকার আদিবাসীরা ভয়াবহ বিপর্যয়ের মধ্যে পতিত হচ্ছে। তাঁর মতে, চট্টগ্রাম অঞ্চলে পাহাড় কাটা বেড়ে চলার সঙ্গে সঙ্গে পাহাড়ি এলাকায় ভূমিধসের মাত্রাও ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশের পাহাড়গুলো অধিকাংশই বেলেমাটির। পাহাড় কাটার ফলে সেখানে বৃষ্টির পানি প্রবাহে বাধা পড়ে। তার ফলে চট্টগ্রাম শহরে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, পাহাড়গ্রাসী লোভাতুর দখলদারদের মোকাবেলা করতে হবে শক্ত হাতে। কেননা তাদের শিকড় গভীর ও শক্তিশালী। এ সমাজে তাদের অবস্থান অত্যন্ত মজবুত। এই জন্যই সচেতন মানুষ, সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান-সংগঠন যতই উচ্চকণ্ঠ থাকুক না কেন, প্রতিদিন রাতের আঁধারে, প্রকাশ্য দিনের আলোয় নানাভাবে, নানা জায়গায় পাহাড় কাটা চলছেই। এ জন্য প্রশাসন তথা সরকারকে শক্ত হতে হবে। পাহাড় রক্ষা করা খুবই দরকার।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে