‘পারস্যের পাঁচ গোলাপ’নতুনের মতো ঘ্রাণময়

মোহছেনা ঝর্ণা | সোমবার , ১৪ ডিসেম্বর, ২০২০ at ৬:১১ পূর্বাহ্ণ

‘পারস্যের পাঁচ গোলাপ’ নামটাই টেনেছে আমাকে। জগদ্বিখ্যাত পারস্যের পাঁচ কবি সম্পর্কে জানতে খুব কৌতূহল হলো। কারণ তাদের সম্পর্কে প্রচলিত কিছু গল্প ছাড়া আর তেমন কিছুই জানা ছিল না আমার। আর তাই রকমারি থেকে বই আসার পর প্রথমেই হাতে তুলে নেই মোস্তাক শরীফের ‘পারস্যের পাঁচ গোলাপ”।
বই পড়তে গিয়ে দেখি টুকরো টুকরো অসংখ্য কৌতূহলদীপ্ত অংশ।
সেরকম কিছু অংশ টুকে রাখি নিজের জন্য। পারস্যের কবি সাহিত্যিকদের নাম এত লম্বা যে মনে হয় পুরা এক একজন গোষ্ঠীর নাম ধারণ করে আছে।
‘ফাতাহ বিন আলি বন্দারি, যিনি ১২২৩ সালে আরবিতে শাহনামা অনুবাদ করেছিলেন, ফেরদৌসির নাম লিখেছিলেন এভাবে – আল আমির আল হাকিম আবুল কাসেম মনসুর বিন আল হাসান আল ফেরদৌসি আল তুসি। কবি নাম হিসেবে ‘ফেরদৌসি’কে কেন বেছে নিয়েছিলেন তা বলা কঠিন। একটি সূত্রে জানা যায়, তিনি যখন গজনির সুলতান মাহমুদের দরবারে গিয়েছিলেন মাহমুদ তখন ফেরদৌসির প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে তাঁকে ফেরদৌসি উপাধি দেন, যার অর্থ হলো ‘স্বর্গীয় মানব।’
কবি সাহিত্যিকদের আর্থিক দুঃখদশা নিয়ে মাঝেমধ্যেই মনটা অনেক খারাপ হয়। কিন্তু পারস্যের পাঁচ গোলাপে মহাকাব্য শাহনামা’র রচয়িতা ফেরদৌসির কথা পড়ে বুঝলাম এই দুঃখ দুর্দশা নতুন কিছু নয়, বরং সহস্র বছরের চলমান ধারামাত্র।
‘শাহনামার শেষ অংশে কবি দুঃখ করে বলেছেন, ক্ষমতাবানরা তাঁর কবিতা থেকে টুকে নিজেদের নামে চালায়, আর তাদের কাছ থেকে তাঁর প্রাপ্তি কেবল ‘আশ্বস্ত’, অর্থাৎ – ভালো লিখেছ! কেবল দু’জন ব্যক্তির নাম উল্লেখ করেছেন তিনি, যারা তাঁকে সাহায্য করেছেন। এদের নাম দেইলাম এবং বু দোলাফ।’ পৃষ্ঠা -২৫
‘রুবাইয়াত শব্দটির উৎপত্তি আরবি শব্দ ‘আরবা’ থেকে, যার অর্থ চার। ‘রুবাই’ হচ্ছে চার লাইনের কবিতা আর রুবাই শব্দটির বহুবচন হচ্ছে রুবাইয়াত। তার মানে রুবাইয়াত মানে চার লাইনের কবিতা সংগ্রহ।’
গিয়াসুদ্দিন আবুল ফাতাহ ওমর বিন ইব্রাহিম আল নিশাবুরি আল খৈয়ামি, ওরফে ওমর খৈয়াম জগদ্বিখ্যাত তার রুবাইয়াত এর জন্য এটা কম বেশি সবাই জানলেও রুবাইয়াত এর অর্থটা হয়তো আমার মতো অনেকেই জানে না।
তবে ওমর খৈয়াম নিয়ে সবচেয়ে বিস্ময় হচ্ছে, ‘বিজ্ঞানী হিসেবে প্রাচ্যে যেমন তেমনি পাশ্চাত্যেও ওমর খৈয়াম এর খ্যাতি সুপ্রতিষ্ঠিত, তবে ওমর খৈয়াম নামটি বিশ্ববিশ্রুত তাঁর কবিতার জন্য। অথচ ওমর যে কবিতা লিখেছেন সেটি তার সমসাময়িকদের কারও জবানিতেই আসেনি। বরং তিনি যে জীবনকালে একটি কবিতাও আদৌ লিখেছেন সে ব্যাপারে সন্দেহ করার কারণ আছে বিস্তর। মধ্যযুগে পূর্ব ইরানে একের পর এক যুদ্ধ বিগ্রহের কারণে বহু নথিপত্র ধ্বংস হয়ে গেছে। এ কারণে ওমরের সময়কাল অর্থাৎ একাদশ ও দ্বাদশ শতকের ঐতিহাসিক দলিলপত্র খুব কমই পাওয়া গেছে। এ সময়ের ছিঁটেফোঁটা দলিলপত্র যা পাওয়া গেছে সেগুলোরও প্রামাণ্যতা নিশ্চিত করা যায়নি। খৈয়ামকে কেউ কবিতা লিখতে দেখেছেন বা কবিতা নিয়ে কারো সাথে তিনি আলাপ করেছেন – এর সপক্ষে কোনো দালিলিক প্রমাণ আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। ইরানের কবি- সাহিত্যিকদের নিয়ে লেখা দ্বাদশ শতকে নিজামি আরুজির ‘চাহার মাকালা’ নামের এক লেখায় ওমর খৈয়াম এর নাম উল্লেখ করা আছে কবিদের অধ্যায়ে নয়, বরং জ্যোতিষী ও জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের অংশে।’ পৃষ্ঠা- ৩৮
শেখ সাদির পুরো নাম আবু মোহাম্মদ মোশাররফউদ্দিন মুসলেহ বিন আব্দুল্লাহ মোশাররফ সিরাজী। সাদির শ্রেষ্ঠ দুই রচনাকর্ম হলো বোঁস্তা আর গুলিস্তাঁ। বোস্তাঁ শব্দের অর্থ ফলের বাগান আর গুলিস্তাঁ শব্দের অর্থ গোলাপ বাগান।
কবি হাফিজ এর পুরো নাম খাজা শামসুদ্দিন মুহাম্মদ সিরাজি। ধারণা করা হয়, কবি পবিত্র কুরআন শরীফ মুখস্থ (হিফজ) করেছিলেন এবং এ থেকেই তাঁর হাফিজ নামের উৎপত্তি।
হাফিজ বিখ্যাত তাঁর কাব্যসংকলন ‘দিওয়ান’ এর জন্য।
হাফিজের কবিতা ইউরোপীয়দের কাছে পরিচিত করে তোলেন ব্র্রিটিশ পন্ডিত ও ভাষাবিদ স্যার উইলিয়াম জোন্স। আবার পশ্চিমাদের কাছে হাফিজের কবিতা পরিচিত করে তোলেন জার্মান মহাকবি জোহান উলফগ্যাং গ্যেটে।
আবার ওমর খৈয়াম এর ‘রুবাইয়াত’ বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিত হয়ে ওঠে মূলত ইংরেজ কবি ও লেখক এডওয়ার্ড ফিটজেরাল্ড এর কল্যাণে।
এ প্রসংগে একটা কথা মনে পড়ল। সব বড় কাজেরই নেপথ্যের কিছু গল্প থাকে। সেই গল্পগুলো অদ্ভুতভাবে কারো না কারো হাতে ধরা পড়ে কোনো না কোনো সময়। যেমন আমাদের রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের কথা। প্রথম জীবনে বুদ্ধদেব বসু আর পরবর্তীতে ভূমেন্দ্র গুহর কারণে এই মহামূল্যবান সাহিত্য ভান্ডার পাঠকের সামনে উন্মোচিত হয়েছে। আগামী দিনগুলোতে এরকম আরও অনেক গল্পের নেপথ্য গল্প হয়তো আমাদের জানা হবে।
বইয়ের শেষ অংশে এসে দেখি তথ্যসূত্রে ১৮ টি বইয়ের নাম। বোঝাই যাচ্ছে লেখক মোস্তাক শরীফের বেশ পরিশ্রমলব্ধ রচনা পারস্যের পাঁচ গোলাপ। আমার নিজের মনের একটি প্র্রশ্নর জবাব লেখক বইয়ের ভূমিকাতেই দিয়ে দিয়েছেন।
‘গোলাপ পাঁচটি কেন? বইয়ের সীমিত গন্ডি একটি কারণ, দ্বিতীয় কারণ এই পাঁচজনের বাইরে যাঁরা আছেন তাদের সম্বন্ধে আমার জ্ঞানের স্বল্পতা।’ দ্বিতীয় কারণটি লেখকের বিনয় তা সহজেই অনুমেয়।
ইতিহাস পড়ার একটা মজা হচ্ছে এখানে কোনো বিষয়ে উপসংহারে পৌঁছানোর উপায় নেই। কারণ প্রতিদিনই ইতিহাসের অনেক প্রাচীন তথ্য নতুন করে উন্মোচিত হওয়ার সুযোগ থাকে। আর তাই ইতিহাস কখনো পুরনো হয় না। ‘পারস্যের পাঁচ গোলাপ’ও তাই নতুনের মতোই ঘ্রাণময়। লেখকের প্রতি শুভকামনা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধু ও সলিল চৌধুরী
পরবর্তী নিবন্ধনুর জাহান বেগম