পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রতিটি পর্যায়ে সতর্কতা জরুরি

রেজাউল করিম স্বপন | সোমবার , ২৭ ডিসেম্বর, ২০২১ at ৬:৩৫ পূর্বাহ্ণ

বিশ্বে পারমাণবিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয়েছে প্রায় অর্ধ শতাব্দী আগে ১৯৪৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের টেনেসি অঙ্গরাজ্যে ওকে ব্রিজের এঙ-১০ গ্রাফাইট চুল্লীতে। যেখানে প্রথম বারের মত পারমাণবিক শক্তি দ্বারা উৎপন্ন বিদ্যুৎ দিয়ে একটি বাল্ব জ্বালানো হয়। এরপর ১৯৫১ সালের ২০ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের আইডাহো অঙ্গরাজ্যের আর্কোর কাছাকাছি ইবিআর-১ পরীক্ষামূলক স্টেশনে বৃহৎ পরিসরে পরীক্ষা ঘটানো হয়। পরবর্তীতে ১৯৫৪ সালের ২৭ জুন বিশ্বের প্রথম পারমাণবিক শক্তিকেন্দ্র থেকে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের অবনিনিস্ক শহরে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে পারমাণবিক প্রযুক্তির আর্থিক, কারিগরি ও পরিবেশগত সুবিধাদি বিবেচনায়, এ প্রযুক্তি ব্যবহারের গ্রহণযোগ্যতা আজ সর্বজনবিদিত। বর্তমানে বিশ্বে ঘনবসতিপূর্ণ ও স্বল্প জ্বালানীর অধিকারী উন্নয়নশীল এবং অনুন্নত রাষ্ট্রসমূহ তাদের আর্থ সামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিতকল্পে পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কর্মসূচীকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের একটি অন্যতম বিকল্প হিসেবে গ্রহণ করেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে পারমাণবিক প্রযুক্তির নির্ভরতার ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ার মূল কারণসমূহ হল-পারমাণবিক প্রযুক্তি বিদ্যুৎ উৎপাদনের সর্বাধুনিক নিরাপদ প্রযুক্তি এবং টেকসই উৎস। এটা জ্বালানী শক্তি আমদানিতে নির্ভরতা হ্রাস করে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিভিন্ন পদ্ধতির মধ্যে পারমাণবিক প্রযুক্তি একটি উপায় যা বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থাকে নির্ভরযোগ্য ও উন্নততর করে।
নিউক্লীয়ার বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র বা পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র একটি তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র যার তাপ উৎস একটি পারমাণবিক চুল্লী। যেটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের হৃৎপিণ্ড হিসাবে পরিচিত, যাকে পরমানু চুল্লিপাত্র বলে। এটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মূল যন্ত্র। এর মধ্যে শক্তি উৎপাদন হয়, যা কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। এতে মডারেটর হিসেবে ব্যবহৃত হয় ‘বোরন বা ক্যাডমিয়াম দণ্ড’। আর মূল জ্বালানি ইউরেনিয়াম, যাকে বিভাজনের জন্য ফিশন পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। ইংরেজি ফিশনের শাব্দিক অর্থ বিভাজন। একটি ভারী পরমাণুকে দ্রুত গামী নিউট্রন দ্বারা ভেঙ্গে হালকা ভারের একাধিক পরমাণু ও শক্তি উৎপন্ন করার প্রক্রিয়াকে কাজে লাগানো হয় পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে। যে সকল তেজস্ক্রিয় পদার্থ এই ফিশন বিক্রিয়ায় অংশ নেয় তাদেরকে ফিসাইল পদার্থ বা পারমাণবিক জ্বালানী বলা হয়। এই পদ্ধতিতে ভারী পরমানু বিভাজনের ফলে প্রচুর তাপ উৎপন্ন হয়। অন্যসব প্রচলিত তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মত এর তাপ দিয়ে বাষ্প উৎপন্ন করা হয়। উৎপাদিত বাষ্প দিয়ে একটি বৈদ্যুতিক উৎপাদক বা জেনারেটরে সংযুক্ত স্টীম টারবাইন ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ তৈরি করা হয়। ২০১৮ সালে আইএইএ প্রতিবেদন মতে, বর্তমানে বিশ্বের ৩০ টি দেশে ৪৫০ টি পারমাণবিক বিদ্যুৎ চুল্লির কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে। পরমাণু শক্তি কেন্দ্রকে সাধারণত বেস লোড স্টেশন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এখানে জ্বালানি খরচ মোট উৎপাদন খরচের একটি ক্ষুদ্র অংশ। অপারেশন, রক্ষণাবেক্ষণ এবং জলবিদ্যুৎ স্টেশনসহ জ্বালানী খরচ তুলনামূলক ভাবে কম হওয়ায় বেস লোড ক্ষমতা সরবরাহকারী হিসেবে এটা উপযুক্ত। যদিও নিউক্লিয়ার জ্বালানীর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার খরচ অনির্ধারিত এবং এর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা হচ্ছে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ।বাংলাদেশের রূপপুরে স্থাপিত হচ্ছে দেশের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। যার নির্মাণ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে। রূপপুরে নির্মাণাধীন পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম ‘রিয়্যাক্টর প্রেসার ভেসেল’ বা চুল্লি স্থাপিত হয়েছে গত ১০ অক্টোবর ২০২১। ইউনিট ১ এর চুল্লিপাত্র স্থাপনের মধ্যে দিয়ে এই ইউনিটের কাজ প্রায় শেষ বলা যায়। এই যন্ত্রের মধ্যেই পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের জ্বালানি হিসাবে ইউরেনিয়াম লোড করা হবে। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু বা কমিশনিং প্রক্রিয়ায় এই চুল্লী স্থাপন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পরমাণু বিজ্ঞানীরা রিএ্যাক্টর প্রেসার ভেসেলকে পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ‘হৃৎপিণ্ড’ বলে থাকেন। এই চুল্লির মেয়াদ ৬০ বছর তবে এটির মেয়াদ আরো ২০ বছর বাড়ানো যাবে। রূপপুরে প্রথম ইউনিটে স্থাপিত এই পারমাণবিক চুল্লি নির্মিত হয়েছে রাশিয়ায়। ভিভিআর-১২০০ মডেলের এই রিয়্যাক্টরে পরমাণু জ্বালানি পুড়িয়ে মূল শক্তি উৎপাদন হবে এবং ১২শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হবে। প্রথম ইউনিট হতে ২০২৩ সালের এপ্রিলে জাতীয় গ্রিডে পরীক্ষামুলক বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে। আর ২০২৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারী বাণিজ্যিক ভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হবে। রূপপুর কেন্দ্রে দুটি ইউনিটে মোট ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে।এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে ১ লক্ষ ১৪ হাজার কোটি টাকা খরচ হবে। যার মধ্যে সরকার দিবে প্রায় ২২ হাজার ৫৩ কোটি টাকা ও বিদেশি ঋণ ৯১ হাজার ৪০ কোটি টাকা (যার সুদের হার ১.৭৫%)। আগামি ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রথম ইউনিটের জ্বালানি সংযুক্তি (ফুয়েল লোডিং) শেষ হবে। বাংলাদেশে একক প্রকল্প হিসেবে এটি সবচেয়ে বড় অবকাঠামো প্রকল্প। জলবায়ু পরিবর্তনের কথা চিন্তা করে বর্তমান বিশ্বে নবায়নযোগ্য শক্তির ওপরে যে জোর দেয়া হচ্ছে পারমাণবিক শক্তি তার অন্যতম একটি উৎস। তবে এইসব পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের চুল্লীর নিরাপত্তা নিয়ে সবসময় কিছুটা উদ্বেগ থেকেই যায়। কারণ অনেকের মধ্যে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দুর্ঘটনার ব্যাপারে একটা ভীতি কাজ করে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, এ ভয়ের প্রবণতা আছে বিশ্বব্যাপী। এই প্রবণতাটি আরো জোরদার হয়েছে ফুকুশিমায় দুর্ঘটনার পর। ফুকুশিমা বিদ্যুৎ কেন্দ্রে দুর্ঘটনাসহ বিশ্বে এ পর্যন্ত পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে তিনটি বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে। পারমাণবিক কেন্দ্রে দুর্ঘটনায় তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়লে দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাব থাকে বলেই বিশ্বব্যাপী পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে এতো ভয় এবং আতঙ্ক। তবে ফুকুশিমায় দুর্ঘটনার পর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে দুর্ঘটনা ঝুঁকি কমাতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা বাড়ানো হয়েছে। রাশিয়ার ভিভিআর ১২০০ মডেলের বিদ্যুৎ কেন্দ্রে দুর্ঘটনা রোধে ৫ স্তরে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা রয়েছে। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে অনেক মতবাদ আছে যেমন রিয়্যাক্টরকে কখনোই বিশ্বাস করা যাবে না। নিরাপত্তার বিষয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান বলেন, সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কোনো ছাড় দিচ্ছে না বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সুস্পষ্ট অবস্থান হলো অতিরিক্ত অর্থ খরচ করে হলেও নিরাপত্তার প্রশ্নে কোনো ছাড় দেয়া যাবে না। যে কারণে নিরাপত্তাকে আমরা সর্বোচ্চ গুরত্ব দিচ্ছি। মি.ওসমান বলেন, আমরা এখানে কো-ক্যাচার নামে একটি বাড়তি জিনিস লাগিয়েছি যেটা ফুকুশিমার দুর্ঘটনার পর আবিষ্কৃত হয়ে অলরেডি চালু হয়ে গেছে। ঐ দুর্ঘটনার পর বিশ্বে যে নতুন দুটো প্ল্যান্ট হয়েছে তাতে এই ব্যবস্থা লাগানো হয়েছে, আমাদেরটি তৃতীয়। কো-ক্যাচার ব্যবস্থা সম্পর্কে মি. ওসমান ব্যাখ্যা করে বলেন, কো-ক্যাচার ব্যবস্থা হলো-যদি কখনো দুর্ঘটনা ঘটে তাহলে দূষিত জিনিসটা গলে নিচে পড়ে যাবে একটা কুয়ার মতো জায়গায় এবং ওটা অটোমেটিকলি সিল হয়ে যাবে। অর্থাৎ তেজস্ক্রিয়তা বাহিরে ছড়াবে না এবং এটার স্লোগানই হলো মেইক মোর সেইফ, মোর সেইফ অ্যান্ড মোর সেইফ। তিনি আরো বলেন, আমরাতো একেবারে লেটেস্ট প্রযুক্তিটাই নিচ্ছি। তাই বর্তমান প্রযুক্তির পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে বিজ্ঞানীদের অনেকেই আশ্বস্ত। অন্যদিকে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের তৈরী পারমাণবিক বর্জ্য ফেরত নিবে রাশিয়া। এজন্য ২০১৯ সালের ৩০ অগাস্ট মস্কোতে দুই দেশের মধ্যে একটি চুক্তি সই হয়। এরপর ঐ বছরের অক্টোবরে আইইএর গাইডলাইন মেনে তৈরী ‘তেজস্ক্রিয় বর্জ্য এবং ব্যবহৃত পারমাণবিক জ্বালানি ব্যবস্থাপনা বিষয়ক জাতীয় নীতি ২০১৯’ এর খসড়া মন্ত্রীসভা অনুমোদন হয়। এই নীতির আওতায় বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন তেজস্ক্রিয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কোম্পানি গঠন করা হবে। যা বাংলাদেশের সব তেজস্ক্রিয় বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কাজ করবে। এরপরেও পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র উচ্চ ঝুঁকির একটি প্রকল্প বিধায় নির্মাণের প্রতিটি পর্যায়ে মান যাচাই, সতর্কতা এবং তদারকি করে এটাকে একটি নিরাপদ প্রকল্প হিসাবে গড়ে তোলা হবে সে প্রত্যাশায় রইলাম।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধসহজ-সরল জীবন নির্বাহই উত্তম পন্থা
পরবর্তী নিবন্ধকক্সবাজারের জন্য অশনি সংকেত!