কক্সবাজারের জন্য অশনি সংকেত!

জসীম চৌধুরী সবুজ | সোমবার , ২৭ ডিসেম্বর, ২০২১ at ৬:৩৫ পূর্বাহ্ণ

কক্সবাজার নিয়ে লিখব ভাবছি আরও কয়েকদিন আগে। যখন তিনদিনের টানা ছুটিতে লাখ লাখ পর্যটকের সমাগম ঘটে এবং সে কারণে খাবার হোটেলে এক প্লেট ডাল-ভাতের দাম হয়ে যায় ৩’শ থেকে ৫’শ টাকা, আবাসিক হোটেলে ৮’শ থেকে ১ হাজার টাকার রুমের ভাড়া হয়ে যায় ৩ /৪ হাজার টাকায়। ঠাণ্ডাজনিত শারীরিক অসুস্থতা এবং আলস্যের কারণে তা আর হয়ে ওঠেনি। কিন্তু স্বামী-সন্তানকে জিম্মি করে নারী পর্যটককে অপহরণের পর গণধর্ষণের ঘটনাটির পর বিবেকের তাড়নায় কী-বোর্ডে হাত রাখলাম।
কক্সবাজারে বেড়াতে গিয়ে ধর্ষণের শিকার হওয়ার সংবাদটি দেশে-বিদেশে আলোচিত ঘটনা। ঢাকা থেকে স্বামী ও আট মাসের শিশু সন্তানসহ গৃহবধূ কক্সবাজার বেড়াতে এসেছিলেন। সৈকতের লাবনী পয়েন্টে সাগরের পানিতে নামতে গিয়ে অপরিচিত এক যুবকের সাথে স্বামীর সামান্য ধাক্কা লাগে এবং কথা কাটাকাটি হয়। এরপর সন্ধ্যায় যখন তারা হোটেলে ফিরছিলেন তখন মাঝপথে গতিরোধ করে স্বামী-সন্তানকে একটি সিএনজি অটোরিকশায় এবং ভিকটিম গৃহবধূককে আর একটি অটোরিকশায় তুলে অপহরণ করে নিয়ে যায় দুর্বৃত্তদল। নারী পর্যটককে প্রথমে সৈকতের একটি ঝুপড়ি ঘরের পিছনে নিয়ে গণধর্ষণ এবং পরে একটি হোটেলে নিয়ে আরেক দফা গণধর্ষণ করে।
গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী বিধ্বস্ত মহিলা তারপরও কৌশলে প্রথমে ৯৯৯ এ ফোন করেন। পুলিশ তাকে থানায় গিয়ে জিডি করার পরামর্শ দেন। পরে অন্যের সহায়তায় র‌্যাবকে খবরটি পৌঁছানো হলে তারা দ্রুত অ্যাকশনে যায়। হোটেল থেকে ভিকটিমকে উদ্ধার এবং ম্যানেজারকে গ্রেফতার করে। এরপর সিসিটিভি ফুটেজ দেখে ঘটনার সাথে সম্পৃক্তদের শনাক্ত করা হলেও তাদের এখনো গ্রেফতার করা যায়নি। প্রধান আসামি আশিকসহ গ্রেফতারকৃত সকলেই কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগ সভাপতির অনুসারী পরিচয় দিয়ে ইয়াবা বিকিকিনিসহ মাদক কারবার, ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও জায়গা-জমি দখলের মাধ্যমে হোটেল- মোটেল জোন এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। তার সাথে দুর্বৃত্তদের অনেক ঘনিষ্ট ছবি ঘটনার পর সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরালও হয়। ছাত্রলীগ সভাপতি অবশ্য দাবি করেছেন, তিনি সভাপতি হওয়ার পর অনেকেই তার সাথে ছবি তোলেন। তাই বলে সবাই তার ঘনিষ্ঠ হতে যাবে কেন? এই না হলে ছাত্রলীগ সভাপতি!- যার সাথে ছবি তুলতে পেরেও অনেকে ধন্য হয়।
কক্সবাজারে নিয়মিত পুলিশ বাহিনীর অতিরিক্ত রয়েছে পর্যটন পুলিশ। কোথাও কোনো নারী ধর্ষিত হলে তার চরিত্র বিশ্লেষণে নামে দায়িত্বশীলদের অনেকে। এভাবে বারে বারে লাঞ্চিত হতে হয় তাকে। কক্সবাজারের ঘটনায়ও এ রকমটি দেখা যাচ্ছে। টুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজারের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেছেন, ধর্ষিতা নারী পর্যটক কিনা সন্দেহ রয়েছে। তারা তিন মাস আগে কক্সবাজার আসেন। প্রধান আসামি আশিকের সাথে তাদের পূর্ব পরিচয় রয়েছে। ধরে নিলাম এসব সত্যি। তাহলে কি অপহরণ করে গণধর্ষণ জায়েজ হয়ে যায়?
কক্সবাজারের শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষ এখন নিজ দেশে পরবাসী হয়ে থাকার মত অবস্থায়। ১০/১১ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর পাশাপাশি আরও কয়েক লাখ রোহিঙ্গা যারা এদেশের নাগরিক হয়ে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সমাজে আধিপত্য বিস্তারের খেলায় নেমেছে তাতে কোনঠাসা স্থানীয়রা। রোহিঙ্গারা ইয়াবাসহ মাদকের কারবারের পাশাপাশি নানান অসামাজিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। কক্সবাজার নগরীসহ পুরো জেলাকে অরক্ষিত করে তুলেছে। এখানকার কিছু লোক এর সাথে জড়িত হলেও বদনামের ভাগীদার সবাইকে হতে হচ্ছে। এমনটা কেন হবে? কক্সবাজার কেন হয়ে উঠবে না একটি আদর্শ নগরী। যে নগরী রাতদিন ২৪ ঘণ্টা সরব-সচল থাকবে। পর্যটকরা সারারাত ঘুরে বেড়াবেন, আনন্দ- ফূর্তিতে কাটাবেন নিশ্চিন্তে সেই নিশ্চয়তা থাকবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেখা যায় গাড়ি নিয়ে দূরের পর্যটন স্পটে সপরিবারে গিয়ে হোটেলে না উঠে গাড়ির পাশে তাঁবু ফেলে রাত কাটাচ্ছে হাজার হাজার পর্যটক। কক্সবাজারে কেন সেই পরিবেশ থাকবে না। কয়েক বছর আগে এক বিদেশি নারী পর্যটক কক্সবাজারে ধর্ষিত হয়েছিল। কিছুদিন হৈ-চৈ হওয়ার পর তাও আড়ালে চলে যায়। কক্সবাজারে তিনদিনের টানা সরকারি ছুটিতে ধারণ ক্ষমতার বেশি পর্যটক সমবেত হবেন সেই আভাস আগেই ছিল। তাহলে কেন তাদের বরণের পূর্বপ্রস্তুতি ছিল না। স্থানীয় প্রশাসন নাগরিক সমাজকে সম্পৃক্ত করে আগামীতে বলতে হবে কক্সবাজারে এসে হোটেল- মোটেল না পেলেও নিরাপদ আশ্রয় কেন্দ্রে বা তাঁবু খাটিয়ে রাত কাটানোর ব্যবস্থা থাকবে। আলুভর্তা আর ভাতের জন্য জনপ্রতি ৩’শ থেকে ৫’শ টাকা আদায়ের মত জুলুমবাজি আর হবে না। প্রশাসন নাগরিক সমাজকে নিয়ে বিশেষ সময়ে বিকল্প ব্যবস্থা নেবেন।
নারী পর্যটককে অপহরণের পর ধর্ষণের ঘটনার পর কক্সবাজার জেলা প্রশাসন পর্যটকদের নিরাপত্তা ও সেবার মান বাড়াতে সাত দফা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। নারী পর্যটককে অপহরণের পর গণধর্ষণ এবং খাবারের গলাকাটা দাম আদায়ের দুটি ঘটনা পত্র-পত্রিকা ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচার পাওয়ার পর কক্সবাজার সম্পর্কে একটা নেতিবাচক ধারনা তৈরি হয়েছে। অনেকে ভ্রমণ সংক্ষিপ্ত করেছেন, অনেকে কক্সবাজার ভ্রমণ পরিকল্পনা বাতিল করেছেন। একে পর্যটন রাজধানী কক্সবাজারের জন্য আরেকটি অশনি সংকেত বলে ধরে নিয়ে আগামীর জন্যে আমাদের এখনই প্রস্তুতি নিতে হবে মোকাবেলার।
কক্সবাজার এখন সারাদেশের মধ্যে প্রধান পর্যটন কেন্দ্র। প্রতিবছর লাখ লাখ দেশি পর্যটক এই কক্সবাজার ভ্রমণে আসেন। অনেকে বছরে একাধিক বার, অনেকে ফি বছর কক্সবাজার ভ্রমণে গিয়ে বিশ্বের দীর্ঘতম সমূদ্র সৈকতের রূপসুধা উপভোগ করেন। দশ বছর আগেও সেখানে পর্যটন মৌসুম সীমাবব্ধ ছিল মূলত শীত মৌসুমে। সেই পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন হয়েছে। এখন গ্রীষ্ম-বর্ষাসহ সকল মৌসুমে পর্যটকের পদচারণা থাকে। পর্যটনের রাজধানী খ্যাত কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রূপান্তরের কাজ চলছে। মহেশখালী মাতারবাড়িতে নির্মাণাধীন তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র, গভীর সমূদ্র বন্দরসহ একাধিক মেগা প্রকল্পের নির্মাণযজ্ঞ চলছে। ফলে কক্সবাজারের চেহারা আগামীতে আরও বদলে যাবে। বাড়বে দেশি-বিদেশি পর্যটক আগমনের হার। সেসব চিন্তা মাথায় রেখেই কক্সবাজারকে একটি নিরাপদ নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে যা যা করা প্রয়োজন সবই করতে হবে। এসব কাজে নাগরিক সমাজকে সম্পৃক্ত করতে হবে। শুধু বিধি-নিষেধ নয়, অতিথি বরণে কক্সবাজারবাসীর শত বছরের ঐতিহ্যকে পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে আসতে হবে সবার সম্মিলিত উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায়।
লেখক : সাংবাদিক- প্রাবন্ধিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রতিটি পর্যায়ে সতর্কতা জরুরি
পরবর্তী নিবন্ধশীতার্তদের পাশে বিত্তবানদের এগিয়ে আসার আহ্বান