পারমাণবিক জ্বালানির যুগে বাংলাদেশ

রূপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার পদক্ষেপ : শেখ হাসিনা এটি দৃঢ় দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের প্রতীক : পুতিন

| শুক্রবার , ৬ অক্টোবর, ২০২৩ at ৫:০২ পূর্বাহ্ণ

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিটে ‘ফ্রেশ নিউক্লিয়ার ফুয়েলে’ বা ইউরেনিয়াম হস্তান্তর করা হয়ছে। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ভার্চুয়ালি উপস্থিতিতে রূপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্র এ পারমাণবিক জ্বালানি গ্রহণ করে। কর্তৃপক্ষের কাছে তেজস্ক্রিয় জ্বালানি হস্তান্তর করার ফলে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৩৩তম পারমাণবিক জ্বালানি ব্যবহারকারী ও দক্ষিণ এশিয়ায় তৃতীয় পারমাণবিক জ্বালানি ব্যবহারকারী রাষ্ট্র। রোসাটমের মহাপরিচালক অ্যালেক্সি লিখাচেভ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র (আরএনপিপি) সাইটে একটি অনুষ্ঠানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমানের কাছে জ্বালানি সরবরাহের সনদ ও জ্বালানি সমাবেশের মডেল হস্তান্তর করেন। এই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে ও রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন মস্কোর ক্রেমলিন থেকে ভার্চুয়ালি যোগদান করেন। এতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের আরেকটি পদক্ষেপ বলে উল্লেখ করেন। অন্যদিকে রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন বলেন, রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র দৃঢ় দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের প্রতীক।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ আগামীতে স্মার্ট বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে উঠবে। এই পারমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র সেই স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার আরেকটি পদক্ষেপ। তিনি বলেন, আমরা এটাই মনে করি, আজকের বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়েছে। আমরা নিউক্লিয়ার যুগে প্রবেশ করেছি।

তিনি বলেন, এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিচালনার জন্য আমরা পৃথক আইন প্রণয়নের মাধ্যমে ‘নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড’ নামে একটি কোম্পানি গঠন করেছি। যে কোনো ধরনের দুর্যোগে আমাদের এই পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সে দিকটা খেয়াল রেখে এই প্ল্যান্টের ডিজাইন প্রণয়ন এবং নির্মাণ কাজ পরিচালনা করা হচ্ছে। তাছাড়া, ব্যবহৃত জ্বালানি (স্পেন্ট ফুয়েল) ব্যবস্থাপনার জন্য আমরা রাশিয়ান ফেডারেশনের সঙ্গে চুক্তি সই করেছি। রাশিয়ান ফেডারেশন এসব স্পেন্ট ফুয়েল তাদের দেশে ফেরত নিয়ে যাবে বলে আমাদের কথা দিয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, পরমাণু শক্তি আমরা শান্তি রক্ষায় ব্যবহার করবো। আমরা বিশ্বব্যাপী পারমাণবিক অস্ত্রের সাধারণ ও সম্পূর্ণ নির্মূল এবং পারমাণবিক অস্ত্র নিষিদ্ধকরণ চুক্তির বাস্তবায়নের প্রতি দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছি। আমরা ‘বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ আইন’ প্রণয়ন করেছি এবং একটি স্বাধীন পরমাণু শক্তি নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করেছি। এই কর্তৃপক্ষ ‘আইএইএ’এর সাথে নিবিড় যোগাযোগ রক্ষা করে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রতিটি স্তরে নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

এদিকে পারমাণবিক শক্তি অর্জনে বাংলাদেশকে অভিনন্দন জানিয়ে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেন, এই প্রকল্পে উভয় দেশেরই স্বার্থ রয়েছে এবং এটি বাংলাদেশের জ্বালানি ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তায় বিরাট অবদান রাখবে। বাংলাদেশকে পরীক্ষিত বন্ধু ও উন্নয়ন সহযোগী উল্লেখ করে রুশ প্রেসিডেন্ট আরো বলেন, পারস্পরিক সমতা ও সম্মানের ভিত্তিতে দুই দেশের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পুতিন বলেন, ৫০ বছর আগে রাশিয়া ও বাংলাদেশ পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে তাদের সম্পর্ক স্থাপন করেছে।

রুশ প্রেসিডেন্ট আরো বলেন, ১৯৭০এর দশকের শুরুতে সোভিয়েত ইউনিয়ন পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার সংগ্রামে ও এরপর সদ্য স্বাধীন দেশ পুনর্গঠনে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেওয়া প্রথম দেশগুলোর মধ্যে রাশিয়া অন্যতম।

স্বাধীনতার পরপরই রাশিয়া বাংলাদেশে বড় বড় শিল্প ও বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়যা এখনো তার অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। পুতিন গত বছর দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন ও বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক মস্কো সফরের কথা স্মরণ করেন। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর মস্কো সফর ছিল দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক। রুশ প্রেসিডেন্ট আরো বলেন, শেখ হাসিনা সফলভাবে ও মর্যাদার সাথে তার বাবার কাজগুলো এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।

এর আগে অনুষ্ঠানের শুরুতে আরএনপিপিএর প্রথম ব্যাচের পারমাণবিক জ্বালানির উৎপাদন ও বিতরণের ওপর একটি অডিওভিডিও ডকুমেন্টারি প্রদর্শিত হয়যেখানে আরএনপিপি প্রকল্প পরিচালক এবং এনপিসিবিএলএর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মো. শওকত আকবর আরএনপিপি’র পরিচিতি তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সচিব মো. আলী হোসেন।

একটি বিশেষ ফ্লাইটে গত ২৮ সেপ্টেম্বর আরএনপিপির জন্য পারমাণবিক জ্বালানির প্রথম চালান (ইউরেনিয়াম রড) এখানে এসে পৌঁছায়। প্রকল্পের বিবরণ অনুযায়ী, সরকার আশা করছে যে, রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম ইউনিটটি ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে ও দ্বিতীয় ইউনিটটি ২০২৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে চালু করা যাবে।

প্রকল্পটিতে ৭,০০০ পেশাদারসহ ৩০,০০০ কর্মী কাজ করছে। এটি ৬০৮০ বছর ধরে সচল থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে। কর্মকর্তারা বলেছেন, এই আরএনপিপি পারমাণবিক ক্লাবে প্রবেশের মাধ্যমে বাংলাদেশকে অনন্য এক উচ্চতায় নিয়ে যেতে সক্ষম হবে। কারণ, এটি কার্বন নির্গমন হ্রাস লক্ষ্যমাত্রা পূরণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হওয়ার পাশাপাশি ফ্ল্যাশের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ কমিয়ে দেবে।

প্রকল্পের লেআউটে বলা হয়েছে, আরএনপিপি প্রতিদিন ২,৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে। রোসাটমের সহযোগী কোম্পানি টিভিইএল পারমাণবিক জ্বালানি তৈরি করছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তাদের কাছ থেকে পারমাণবিক জ্বালানি ক্রয় করে।

ওয়ার্ল্ড নিউক্লিয়ার এসোসিয়েশনের ওয়েবসাইট অনুসারে, পরমাণু শক্তি ব্যবহারকারী দেশগুলোর মধ্যে রয়েছেমার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ফ্রান্স, রাশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, কানাডা, ইউক্রেন, জার্মানি, জাপান, স্পেন, সুইডেন, বেলজিয়াম, যুক্তরাজ্য, ভারত, চেক প্রজাতন্ত্র, ফিনল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, বুলগেরিয়া, পাকিস্তান, হাঙ্গেরি, স্লোভাকিয়া, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা, মেঙিকো, রোমানিয়া, আর্জেন্টিনা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বেলারুশ, স্লোভেনিয়া, নেদারল্যান্ডস, ইরান ও আর্মেনিয়া।

একবার পারমাণবিক জ্বালানী বিদ্যুৎ প্ল্যান্টের চুল্লিতে লোড করা হলে, এক বছরের জন্য বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যেতে পারে। এর পরে, জ্বালানী চুল্লিতে পুনরায় লোড করতে হবে। ২০২১ সালের অক্টোবরে, ইউনিটের কাঠামোর মধ্যে চুল্লি স্থাপনের মাধ্যমে রূপপুর ইউনিট১ প্রায় সম্পন্ন হয়। এটি আইএইএ’র মান অনুযায়ী স্থাপন করা হয়েছে। চুল্লি একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রধান উপাদান। গত বছরের অক্টোবরে দ্বিতীয় ইউনিটের চুল্লি স্থাপন করা হয়।

আইএইএ’র নির্দেশিকা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় সকল প্রয়োজনীয়তা পূরণ করে রূপপুর প্রকল্পে পারমাণবিক জ্বালানি আমদানি ও স্টোরেজের লাইসেন্স পেয়েছে বাংলাদেশ। আইএইএ গত মাসে ভিয়েনায় তার সাধারণ সম্মেলনের সময় বাংলাদেশকে আইএইএ’র বোর্ড সদস্য করে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআমি তো অপরাধ করিনি, শঙ্কিত কেন হবো
পরবর্তী নিবন্ধপ্রথম অনলাইন চা নিলাম কেন্দ্রের যাত্রা শুরু