পাবলো পিকাসো এবং তার বিষাক্ত পুরুষতান্ত্রিকতার পুনঃমূল্যায়ন

সাদিয়া মেহজাবিন | শনিবার , ৮ জুলাই, ২০২৩ at ১০:৩৮ পূর্বাহ্ণ

(‘ডি ডব্লিউ’/ ডয়চে ভেলের প্রতিবেদনে সাবিনে ওয়েলজের লেখার ভাবানুবাদ)

পাবলো পিকাসো একই সময়ে আলোচিত ও সমালোচিত তার ‘স্ত্রী’, ‘দাসী’, ‘বান্ধবী’দের প্রতি আচরণের কারণে। পাবলো পিকাসো তাদের দেখেছেন হয় ‘ঈশ্বরী’ নয় তো ঘরের দুয়ারে পড়ে থাকা ‘পাপোষ’ রূপে। তবে কি কড়া নেড়ে দেখা উচিত স্প্যানিশ এই ‘আর্ট আইকন’র অন্দরমহল?

‘কেবল দু ধরনেরই নারী রয়েছে- হয় ঈশ্বরী নয়তো ঘরের দুয়ারের তলাচি’- পাবলো পিকাসোর এই বিখ্যাত উক্তি এখনো উচ্চৈঃস্বরে ব্যক্ত করে অনেক কিছু। এমন কি তার ১১টিরও বেশি সম্পর্কের বেশিরভাগেরই একই ধরন। প্রথমে সে তাদের দেবী বানায় পরবর্তীতে ময়লার মত ছুঁড়ে ফেলে। তাদের মধ্যে দুজন মেরি থেরেস ওয়াল্টার এবং জ্যাকলিন রোক পাবলো পিকাসোর মৃত্যুর পরেই আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।

বিংশ শতাব্দীর শিল্পের সেরা নায়কের এসব বিতর্ক ক্রমশ স্পটলাইটে চলে আসে। জার্মান শহরের মুন স্টারে অবস্থিত পিকাসো মিউজিয়ামের কিউরেটর অ্যান ক্যাটরিন হান বলেন, নিজের স্বার্থে নারীদের সাথে দ্বি-চারিতা করে, ভালোবাসার প্রকাশ করে, একপ্রকার নির্যাতন করে কেবল আনন্দ উপভোগ-অর্জন করেছেন পাবলো পিকাসো। তিনি আরো বলেন, একটি জাদুঘর কিভাবে এতদিন এধরনের একজন শিল্পীর সমালোচনার বদলে তার শিল্পের পূজা করে গেলো এটিই এখন প্রশ্ন।

পিকাসো : একজন দ্বিধাহীন, ক্ষমতার জন্যে ক্ষুধার্থ শিল্পী

পাবলো পিকাসো ১৮১৮ সনে স্পেনে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৭৩ সালে ফ্রান্সে মারা যান। যার মৃত্যুর আগ অব্দি অসাধারণ প্রতিভা ছিলো। যেখানে ক্যারিয়ারের জন্যে নিজের মৃত দেহের উপর হাঁটতেও প্রস্তুত ছিলেন বলে জানা যায় তার প্রাক্তন প্রেমিকাদের স্মৃতিকথায়। নিজের করা ভাস্কর্য, ছবি, সিরামিকের কাজ সব কিছুতেই নিজেকে অমর করার নিজস্ব প্রয়াস দেখা যায়। প্রথমে থাকতেন প্রচণ্ড উৎসাহী এরপর ক্রমশ ঠান্ডা হয়ে যেতেন। আকর্ষণ আর বিকর্ষণের এই যোগসূত্রে নিজের বুননের ছাপ তৈরি করেছেন সর্বদা।

ফার্নান্দেজ অলিভিয়ার প্রথম প্রেমিকা যিনি ১৯৩৩ সালে তার বই ‘পিকাসো অ্যান্ড হিজ ফ্রেন্ডস’ এ পিকাসোর সাথে তার সম্পর্কের গল্প প্রকাশ করেছিলেন। তিনি ১৯০৫ থেকে ১৯১৩ সাল পর্যন্ত প্যারিসে একসাথে কাটানো বছরগুলির কথা তুলে আনেন। পিকাসো এবং ফার্নান্দেজের যখন দেখা হয়েছিল, তখন তিনি শক্তিশালী-স্পষ্টভাষী একজন অজানা, দরিদ্র স্প্যানিশ শিল্পী ছিলেন।

অলিভিয়ার পিকাসোর ক্যারিয়ারের প্রথম দিকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মডেল ছিলেন। পিকাসো তার ছবিকে জ্যামিতিক মাত্রায় ভেঙে দিয়েছিল; নাক, চোখ এবং মুখ। যা তার কিউবিস্ট শিল্পকর্মগুলিতে খুব কমই শনাক্তযোগ্য। পিকাসো একই সময়ে অলিভিয়ার সম্মুখ এবং পশ্চাৎ চিত্রকে ফুটিয়ে বিমূর্ত এক দৃশ্যের জন্ম দিয়েছিলো।

নারীবিদ্বেষের এক অভিব্যক্তি : ‘ডেমোইসেলস ডি’ অ্যাভিগন’

ফার্নান্দেজের অবয়ব পিকাসো আধুনিক শিল্পের ইতিহাসে মাইলফলক তৈরি করেছিলো। কিন্তু বাস্তব জীবনে পিকাসো তার সাথে খারাপ আচরণ করেন, এমন কি তাকে অন্যান্য শিল্পীদের মডেল হওয়া থেকে বিরত রাখতে, স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্টে আটকও করেছিলেন। নতুন প্রেমিকা ইভা গুয়েলের জন্যে যখন ফার্নান্দেজকে পিকাসো ছেড়ে দেন, চরম দারিদ্রতার শিকার হতে হয় তাকে।

২০২৩ সালের বই ‘গোডেস অ্যান্ড ডোরম্যাটস- ওমেন এন্ড পিকাসো’র জন্য

রোজ-মারিয়া গ্রোপ পিকাসোর ব্যক্তিগত ডায়েরি এবং অপ্রকাশিত ইতিহাস নিয়ে গবেষণা করেছেন। পিকাসোর কিউবিস্ট পর্বের একটি প্রধান চিত্রকর্ম ‘ডেমোইসেলস ডি’অ্যাভিগন’ কে নারীদের প্রতি তার ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখছেন এই আর্ট জার্নালিস্ট। আরো বলেন, সর্বোপরি, ১৯০৭ সালের ‘ডেমোইসেলস ডি ‘অ্যাভিগন’ এর মতো বিপর্যয়কর চিত্রকর্মের নির্মাতার আগ্রাসন ছাড়া এটি কল্পনা করা অকল্পনীয় অথবা অসম্ভব। পিকাসো নারীর শক্তি সম্পর্কে সচেতন ছিলেন বলে দাবি মারিয়ার।

পিকাসোর পাকাপোক্ত আসনের বিরুদ্ধে …

প্যারিসে অবস্থিত মার্কিন শিল্প পণ্ডিত আবিগেইল সলোমন-গোদেউ বলেন, পিকাসো নারীদের ঘৃণা করতেন। নারীবাদী দৃষ্টকোণ থেকে, মানুষের এই ধরনের শিল্পী থেকে নিজেকে দূরে রাখা উচিত। পিকাসো সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিভঙ্গির সময় এসেছে।

‘আমি শিল্পের ইতিহাস, পিকাসো বা যেকোনো মহান প্রতিভা সম্পর্কে আলোচনা কিংবা মাস্টারদের সম্পর্কে আলোচনা করতে আগ্রহী, কারণ এটি যেকোনো চিত্রকর্মের ব্যাখ্যার জন্য উন্মুক্ত।’- গোদেউ

‘ডেমোইসেলস ডি‘অ্যাভিগন’ চিত্রকর্ম সম্পর্কে আমাদের ধারণা ১৯০৭ সালের মতো আর নেই। আমাদের দেখার দৃষ্টি এখন বদলেছে। তিনি আরও বলেন, আজকাল কি আমরা ১১৫ বছরের পূর্বের চিত্রকর্ম নিয়ে কথা তুলতে পারি না?

সলোমন-গোডেউ পিকাসোকে তার মেকি-বহাল আসন থেকে নাড়া দিতে চান। উলটো বলেন, পিকাসো মহৎ কেউ ছিলেন না, তার মহান চরিত্রের কথা ভেবে বিষাক্ত পুরুষত্বকে ক্ষমা করা উচিত নয়।

পিকাসোর প্রথম স্ত্রী ওলগা খোখলোভার সাথে বিচ্ছেদের পরে, ১৯১৭ থেকে ১৯৩৫ সালের দিকে আঁকা তার প্রতিকৃতিগুলোকে বিকৃত করেছিলেন পিকাসো। একটি চিত্রকর্মে ওলগাকে দোলনায় ঘুমিয়ে থাকতে দেখা যায়। যেখানে তার বিস্তৃত খোলা ‘স্নাউটে’র মতো মুখ অবয়ব।

প্রতিযোগিতায় নারী…

পিকাসোর দুই সন্তান পালোমা ও ক্লডের মা ফ্রাঙ্কোইস গিলোট ১৯৪৩ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত তার বই ‘মাই লাইফ উইথ পিকাসোর’ গ্রন্থে লিখেছেন,

বিচ্ছেদের পরে ফার্নান্দেজের আর্থিক টানাপোড়ন ছিলো, গিলোট আর্থিকভাবে স্বাধীন ছিলেন এবং সচ্ছল পরিবার থেকে এসেছিলেন। পিকাসোকে দেখিয়েছেন গিলোট কি ছিলেন আর এখন কেমন আছেন।

‘পিকাসো সর্বদা তার চারপাশের লোকদের প্রতিযোগিতায় ফেলতে ভালোবাসতেন। একজন নারীকে অন্য নারীর বিরুদ্ধে, একজন শিল্প ব্যবসায়ীকে অপর ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে, এক বন্ধুকে অন্য বন্ধুর বিরুদ্ধে। পিকাসো নিজেকে ষাঁড় লড়াইর লাল কাপড় হিসাবে এবং অন্যজনকে ষাঁড় হিসাবে ব্যবহার করতে পারদর্শী ছিলেন। ষাঁড়টি যখন লাল কাপড়ের পেছনে ছুটছে ঠিক তখনই পেছন থেকে চরম বেদনা দেন পিকাসো।

পিকাসোকে ছেড়ে গেলেন গিলোট …

গিলোটই একমাত্র নারী যিনি পিকাসোকে ছেড়ে গিয়েছিলেন এবং এর জন্যে পিকাসো তাকে কখনোই ক্ষমা করেননি। এমনকি দীর্ঘসময় ধরে নিজের সন্তানদের পিতৃত্ব স্বীকার করেননি পিকাসো।

যেভাবেই সম্ভব, পিকাসো তার স্ত্রীদের অপমান করে গেছেন, বরং শিল্পেও।

ডোরা মার পিকাসোর রোমান্টিকতার মধ্যে একজন ছিলেন। মানসিকভাবে অস্থিতিশীল এবং বিশেষত পিকাসোর ছুঁড়ে দেওয়া ক্ষতিকারক শব্দে ভুগছিলেন। ডোরা সম্ভবত চিরকাল ‘কাঁদুনে নারী’ হিসাবে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন কেননা পিকাসো তার চিত্রগুলিতে তাকে এভাবেই চিত্রিত করেছিল।

মুনস্টার পিকাসো মিউজিয়ামের পরিচালক মার্কাস মুলার বলেন, পিকাসোর সঙ্গে তার প্রেমিক-প্রেমিকাদের সম্পর্ক প্রায় সবসময়ই চিরাচরিত প্যাটার্ন অনুসরণ করে। তিনি এবং মেরিলিন ম্যাককুলি ২০২২ সালে “পিকাসো, ওমেন অফ হিজ লাইফ। অ্যা হোমেজ” বইটি প্রকাশ করেছিলেন।

পিকাসোর মেয়েমায়া একদা বলেছিলেন, পিকাসো তার স্ত্রীদের এমনভাবে রেখে গেছেন, যিনি সন্ধ্যায় বিস্ট্রোতে সিগারেট আনতে আরও একবার বাইরে যান।

নারীদের প্রতি পিকাসোর ঘৃণাও ছিল সময়ের বহিঃপ্রকাশ এবং এক্ষেত্রে পিকাসো-ই একমাত্র ছিলেন না। মুলার বলেন, তার বন্ধু অ্যাপোলিনায়ার এবং পল এলুয়ার্ডও যৌনতায় আসক্ত। পিকাসোর সাথে যখন তার স্ত্রীদের দেখা হয় তখন কেউ ত্রিশ বছরের ছিলো আবার কেউ তো নাবালিকাই ছিলো।

#গবঞড়ড় আন্দোলনের উত্থানের পর থেকেই শিল্প জগতে বহুল আলোচিত বিষয় হয়ে উঠেছেন পিকাসো। আজ, লোকেরা সম্ভবত তাকে বিষাক্ত পুরুষতন্ত্রেও একটি প্রধান উদাহরণ হিসাবে বর্ণনা করছেন।

সূত্র : https://www.dw.com/en/pablo-picasso-reassessing-the-artists-toxic-masculinity/a-65190110

পূর্ববর্তী নিবন্ধডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব কমাতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান
পরবর্তী নিবন্ধস্বপ্ন দেখে মন