পান করি ধর্মের সুমিষ্ট জল

রীতু পারভী | শনিবার , ২৩ অক্টোবর, ২০২১ at ৯:০৭ পূর্বাহ্ণ

সময়টা এমন ছিল না। খুব কি বেশিদিন আগের কথা যখন কাকিমা আর চাচিরা পরস্পরের দাওয়ায় বসে নাড়ু, পিঠা, চা, পান দিয়ে মধুর আড্ডা দিয়েছেন! নির্মলা, শবনম, পলাশ আর রহমানরা একসাথে খেলায় মেতে উঠত, এইতো সেদিন! কে হিন্দু আর কে মুসলিম প্রশ্নটা কখনও কী মাথায় খেলতো তাদের! ঈদ কিংবা পূজা ছিল শুধুই উৎসব, ধর্মের বাড়াবাড়ি ছিল না। তা বলে কী আমাদের পূর্বপুরুষেরা ধার্মিক ছিলেন না! বাবা, চাচারা নিয়মিত মসজিদে যেতেন আবার মসজিদ থেকে ফেরার পথে সিধু কাকার চায়ের দোকানে চা খেতে খেতে আড্ডাও দিয়েছেন। ভোরে ঘুম ভাঙত কুরআন পাঠের শব্দে আবার পাশের পাড়ায় কাশির বাজনায় পুজোর শব্দও শোনা যেতো। কোনদিন এতে কারো ধর্ম পালনে ব্যত্যয় ঘটেনি। মসজিদের আজানের ধ্বনি শুনতে যেমন মধুর লাগতো, পুজোর উলুধ্বনিকেও স্বাভাবিক মনে হয়েছে, মনে বিন্দুমাত্র বিদ্বেষ জন্মেনি। ধর্ম নিয়ে কোন বাড়াবাড়ি ছিল না, ছিল না অশান্তি।
ধর্ম বিদ্বেষের বীজ কিন্তু ততদিনে রোপণ করে দিয়ে গেছে ব্রিটিশ বেনিয়ারা। শাসন আর শোষণের জন্য চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে ধর্মে ধর্মে পার্থক্য, ছড়িয়ে দিয়ে গেছে বিদ্বেষের বিষ। আমাদের পূর্ব পুরুষেরা নিজের চোখেই দেখেছে ঘৃণার আগুনে সম্পর্ক পুড়তে, বসত ভেঙে যেতে বা কাউকে সংখ্যালঘু হতে, কেউ হিন্দু কেউ বা মুসলিম, নিজ ভূমিতে হয়েছে পরাশ্রয়ী। বেশিরভাগ মানুষ কালরাত্রির কষ্ট ভুলে পরস্পরকে আগলে নতুন সম্পর্ক গড়ে তুলেছে, পাতের খাবার ভাগ করে খেয়েছে, প্রজ্ঞা দিয়ে সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে গেছে আবার আলোর অন্ধকার দিকের মত অনেকেই এই বিষাক্ত স্মৃতিকে মনে পুষে রেখেছে, তার বীজকে লালন করেছে যা পরবর্তীতে রোদ আলো হাওয়া পেয়ে বিষাক্ত মহীরুহের জন্ম দিয়েছে আর এটাই আজকের বাংলাদেশ।
বিগত দশকগুলোতে এদেশে বেড়েছে ধর্মপ্রাণ মানুষের সংখ্যা, দৃশ্যত পাল্টে গেছে সংস্কৃতির অনেকখানি। পরিবর্তনের বাতাস সর্বত্র রাজপথ থেকে গলির মোড়, ব্যক্তিজীবন থেকে জাতীয় জীবনে। পাল্টেছে প্রত্যহ জীবনের দিনপঞ্জি , পোশাক, সংস্কৃতি, চিন্তার ধারা। খোলা বাজারে পণ্য সাজানো, পছন্দ নিজ নিজ সবার। হাতের মুঠোর মধ্যে বিশ্বরাজনীতি, সমাজনীতি, সংস্কৃতি। গভীরে ঢোকার কষ্ট না করে সারফেসে যা পাওয়া যায় তাই নেয়া হয় কাড়াকাড়ি করে। ধর্মের ক্ষেত্রেও এর সুমিষ্ট নির্যাস টুকু ত্যাগ করে আবরণে লেগে থাকা দ্বেষটুকুর পরিচর্যায় ব্যস্ত রয়েছে আরও ব্যস্ত মনুষ্যকুল।
বাবা-কাকা বা মা-মাসিদের জমানো আড্ডার দিনগুলোর সাথে সাথে মুছে গেছে বা যাচ্ছে সৌহার্দের সম্পর্কগুলো। পরিচর্যা নেই আদর্শের, সুস্থ সংস্কৃতির, সু-সম্পর্কের। একটা প্রজন্ম আড়ালে আবডালে বড় হয়েছে বিদ্বেষ, হিংসা আর ক্রোধ নিয়ে যার প্রত্যক্ষফল ভোগ করছে সমাজ। পরবর্তী প্রজন্ম কীভাবে বড় হচ্ছে সেও এক চিন্তার বিষয় কারণ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে নাগিনীরা ফেলিছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস।
ধর্মকে একপাশে সরিয়ে রেখে আসলে আমরা কোন সমস্যার সমাধান করতে পারি না বা পারব না। অহেতুক ধর্ম বাদ দিয়ে, ধর্মই অধর্মের মূল বলে সমস্যাকে আরও জটিল না করে ধর্মপালনকারীর দিকে মনযোগ দিতে পারি। অসুস্থ মানসিকতার মানুষগুলো যখন ধার্মিক হয়ে উঠে তাদের হাতেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সমাজ আর মানুষের জীবন আর এরসাথে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ধর্ম নিজেও। ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করেই সমগ্র পৃথিবীতে অবসান হচ্ছে না হানাহানির। কিছু বিতর্ক ছাড়া সব ধর্মেই হিংসা, দ্বেষ, হানাহানির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের কথা বলা হয়েছে, সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে, ধৈর্যের কথা বলা হয়েছে। আমরা ন্যূনতম ধৈর্য, সহনশীলতার চর্চা করি না অথচ নিজেকে ধার্মিক বলে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই। অমানিশার দিনগুলোতে উদাত্ত আহ্‌বান, আসুন পান করি ধর্মের সুমিষ্ট জল, গড়ে তুলি সম্প্রীতির সম্পর্ক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশিক্ষা উপমন্ত্রীর সাথে ডা. আঞ্জুমান আরা-আরিফুল আমীন পরিষদের সাক্ষাৎ
পরবর্তী নিবন্ধকরোনাকালে বেড়েছে বাল্যবিবাহ