করোনাকালে বেড়েছে বাল্যবিবাহ

কাজী রুনু বিলকিস | শনিবার , ২৩ অক্টোবর, ২০২১ at ৯:০৮ পূর্বাহ্ণ

আমার সামনে ষোড়শী একটা মেয়ের ছবি। ঝলমল করছে আত্মবিশ্বাস। দরিদ্র পরিবারের মেয়েদের পারিবারিক সিদ্ধান্তের বাইরে এসে নিজের সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠা করা খুব সহজ কাজ নয়। দারিদ্র্যের কাছে তাদের যাবতীয় স্বপ্ন জলাঞ্জলি দিয়ে ভাগ্যকেই মেনে নিতে হয়। বর্ষা হার মানেনি। সে নিজের ভাগ্য নিজেই লিখতে চায়। বিয়ের দিন পালিয়ে থানায় হাজির হয় আইনী সহায়তা পাওয়ার জন্য। চুয়াডাঙ্গা সদরের কিশোরী মেয়ে বর্ষা এখন সাহসী মেয়ের খেতাব পেয়েছে। স্থানীয় ঝিনুক মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রীটি তার বাল্যবিবাহ রুখে দিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সে পাশে পেয়েছে স্থানীয় প্রশাসন ও স্কুল কর্তৃপক্ষকে।
করোনা মহামারির কারণে প্রায় দেড় বছর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার সুযোগে দেশের ৯টি জেলার ৭৬টি উপজেলার ৭ হাজার ৬৭৭টি বাল্যবিবাহ হয়েছে। দেড় বছর স্কুল বন্ধ থাকার পর ১২ সেপ্টেম্বর সারাদেশে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলেছে। খোলার পর অনেক শিক্ষার্থী স্কুলে নিয়মিত হচ্ছেনা। করোনাকালে তারা নিয়মিত অ্যাসাইনমেন্টও জমা দেয়নি। স্কুল কর্তৃপক্ষ খবর নিয়ে জেনেছেন অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেণির অনেক ছাত্রীর বিয়ে হয়ে গেছে। করোনাকালের অনিশ্চয়তা, দারিদ্রতা ও সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার কারণে অপ্রাপ্ত বয়স্ক মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন অনেক অভিভাবকেরা। দারিদ্রতা, নিরাপত্তাহীনতা,পারিবারিক সমস্যা, বয়স বাড়লে যৌতুকের অংক বেড়ে যাওয়া, ধর্মীয় বিশ্বাস এবং সামাজিক চাপের মতো বিষয়গুলোর কারণে বাল্যবিবাহের লাগাম টানা কঠিন হয়ে পড়েছে।তাছাড়া আইন প্রয়োগেও নেই কঠোরতা। বাল্যবিবাহের কারণেই মেয়েদের শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ার হার সবচেয়ে বেশি। ৭৭% শতাংশ। ইউনিসেফ বাংলাদেশের আর্লি চাইল্ডহুড স্পেশালিস্টের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায় শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়নি এমন ৩০ শতাংশ কন্যা শিশু ও ৪৫ শতাংশ নারী করোনা পরিস্থিতির কারণে নতুনভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অনেক পরিবার লেখাপড়া ছাড়িয়ে বাসবাড়ি ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজে দিয়েছে। কন্যা শিশু ও ছেলে শিশুদের বৈষম্য চিরকালের। কন্যা শিশুদের প্রতি বৈষম্যের কারণে সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়। বাল্যবিবাহের সবচেয়ে বড় সমস্যা স্বাস্থ্য ঝুঁকি। বাল্যবিবাহের সাথে প্রজনন স্বাস্থ্য ও বয়ঃসন্ধির সম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশ সহ ৫৭টি উন্নয়নশীল দেশের নারীরা জন্ম নিয়ন্ত্রণ ও মাতৃ স্বাস্থ্যসুরক্ষায় নিজেদের মতামত রাখতে পারে না। অন্যভাবে বলা যায় এব্যাপারে তাদের অভিজ্ঞতা কম। এমনিতেই দেশের নারীরা অপুষ্টিজনিতরোগে ভোগে করোনাকালে তা আরও বেড়েছে। কোভিড ১৯ এর মহামারিকালে সারা বিশ্বের মতো নারীর প্রতি সহিংসতা ও অপরিকল্পিত গর্ভধারণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বাল্যবিবাহের কারণে মেয়েদের অপ্রাপ্ত বয়সে গর্ভধারণ, গর্ভপাত ও অনিরাপদ সন্তান প্রসবের ঘটনা বাড়ছে। সন্তান ও মায়ের অপুষ্টিজনিত রোগ বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশের জনস্বাস্থ্য সুরক্ষাও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।
শিশুদের বিবাহ এক ধরনের যৌন নির্যাতন এই বিষয়টি বিশ্বাস করেনা বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ। সামাজিক আচরণ পরিবর্তনের বৃহৎ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে মেয়েদের বয়স বিলম্বিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। অ্যাডভোকেসি পর্যায়ে বাল্যবিবাহের বিষয়টিকে ধীরে ধীরে মূলধারার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি সুরক্ষা এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ কর্মসূচির সাথে একীভূত করা হচ্ছে।
শুধু ছেলে সন্তান নয় মেয়ে সন্তানও আপনার সম্পদ হয়ে উঠতে পারে। বিয়ে কোন সমস্যার সমাধান নয়। তাকে শিক্ষিত ও আত্মনির্ভরশীল হবার সুযোগ করে দিন। মেয়ে মানে অবনত মস্তক নয়,নিঃশব্দ পথচলা নয়।সব দুঃখ কষ্ট নীরবে মেনে নেওয়া নয়।প্রতিটি মেয়েই বিপ্লবী হয়ে উঠুক তার নিজের অবস্থানে। বর্ষার মতো সাহসী হয়ে উঠুক। ক্ষুদ্র গন্ডী থেকে বের হয়ে বিশাল আকাশ দেখুক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপান করি ধর্মের সুমিষ্ট জল
পরবর্তী নিবন্ধ‘রাসেলকে হত্যা ইতিহাসের নিষ্ঠুর উদাহরণ’