পানিতে আগুন – ২

রেফায়েত ইবনে আমিন | সোমবার , ২৪ অক্টোবর, ২০২২ at ১১:৪০ পূর্বাহ্ণ

জাহাজে আগুন ধরে কীভাবে? গতসপ্তাহে বলেছিলাম, ফায়ার-ট্রায়াঙ্গেলের কথা অক্সিজেন + জ্বালানী + তাপ। এই তিনটা একসাথে পেলেই আগুন জ্বলবে। এর থেকে কোনোমতে একটাকে সরিয়ে ফেলতে পারলেই আগুন নিভে যাবে। বাতাসে অক্সিজেনের তো অভাব নাই। তাই অন্য দুইটা কীভাবে আসতে পারে? চিন্তা করি, তাহলেই বুঝবেন আগুন ধরে কীভাবে।

গ্যালী (বা কিচেনে), গরম তেল থাকে। আর সমুদ্রের মাঝে জাহাজ তো দুলবেই। সবসময়ে না হোক, গরম তেল জাহাজের দুলুনিতে ছিটকে হট-প্লেট বা চুলার উপরে পড়ে আগুনের শুরু হতে পারে। অসতর্কভাবে রাখা কাপড়ে আগুন ধরতে পারে। চুলার উপরের এক্সহোস্ট ফ্যান এবং গ্রিল পরিষ্কার না করলে, তেল জমে জমে সুন্দর একটা জ্বালানি হতে পারে। সেটা চুলার তাপ পেলেই যথেষ্ট, অক্সিজেন তো বাতাসে আছেই।

বিছানায় সিগারেট খাওয়া একটা বিপজ্জনক অভ্যাস; যেকোন মুহুর্তে ঘুমিয়ে পড়লে, সেই জ্বলন্ত সিগারেট ম্যাট্রেসে-কাপড়ে লেগে আগুন ছড়িয়ে দিবে। পোর্টেবল হিটার ঠিকমত না রাখলে, হঠাৎ উল্টে গিয়ে কাপড়ে, সোফাতে, কার্পেটে আগুন ছড়াবে। অনেকেই হিটারের উপরে কাপড় শুকাতে দেয়, সেই কাপড়েও আগুন ধরে যায়।

জাহাজে যেসব কার্গো বহন করা হয় সেগুলোও দাহ্য হতে পারে। প্রকৃষ্ট উদাহরণ তেলের ট্যাঙ্কার। এছাড়াও হতে পারে রিএক্টিভ কেমিক্যাল, সালফার, জমিতে দেওয়ার সার, কয়লা, তুলা, এমোনিয়া, আরও কতকিছু। বা নিরীহ কাপড়-চোপড়, কাঠের ফার্নিচার, বা কাঠের প্যাকিংবাক্স এগুলোই বা কম কিসে? কোনোটায় যদি কোনমতে একটু আগুন ধরে যায়, তাহলে হোল্ডের ভিতরের পাড়া-প্রতিবেশীসহ সকলকে নিয়ে জাহাজে আগুনের খেলা দেখিয়ে দিবে। কার-ক্যারিয়ার জাহাজে গাড়ির তেলের ট্যাঙ্ক থেকে ফিউম বের হয়ে আগুন ধরার উপযোগী আবহাওয়া তৈরি করতে পারে।

আর ইঞ্জিনরুম তো কী বিপজ্জনক তা বললে আঁৎকে উঠবেন। বিশাল মেইন-ইঞ্জিন জাহাজকে চালায়, আর কয়েকটা ইলেক্ট্রিক্যাল জেনারেটর (ছোট ইঞ্জিন আরকি)। অতি উচ্চচাপে, গরম-তেল পাইপ দিয়ে ইঞ্জিনে দেওয়া হয়। সেই পাইপ যদি বার্স্ট করে, তাহলে গিয়ে পড়বে গরম ইঞ্জিনের বডির উপরে, বা তার থেকেও গরম exhaust লাইন বা ম্যানিফোল্ডের উপরে। চোখের পলকে আগুনের ব্যবস্থা হয়ে যাবে। ইঞ্জিনের আরো অনেককিছু আছে, যেখান থেকে আগুন শুরু হতে পারে। তারপরে আছে বয়লার বুঝতেই পারছেন আগুন জ্বালিয়ে জ্বালিয়ে পানি গরম করে তাপ এবং চাপ দুইটাই বাড়ানো হয়। সেটার কোথায়ও যদি বার্স্ট করে তাহলে খবর আছে। বয়লারে ব্যাকফায়ার বলে একটা ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, যার ফলে, আগুন বের হয়ে এসে মানুষসহ সবকিছু পুড়িয়ে দিবে। জাহাজে দুইটা বোম্ব থাকে সত্যি সত্যি যুদ্ধের বোমা না। কিন্তু তার চাইতে কমও না। সেগুলো হলো কম্প্রেস্‌‌ড্‌‌ এয়ার-ট্যাঙ্ক। বেশ বড়সড় আকারের দুইটা ঢাউস ট্যাঙ্ক, মোটা-পুরু-শক্ত স্টিল দিয়ে মজবুত করে তৈরি। সেগুলোতে পাম্প করে করে বাতাস ভরা থাকে। মোটর-সাইকেল যেমন পায়ে কিক্‌‌ দিয়ে স্টার্ট দেয়, জাহাজের তিন-চারতলার সমান উঁচু ইঞ্জিন চালাতে আমাদের একটা দানব পুষতে হবে, যে কিক্‌‌ দিয়ে সেই ইঞ্জিন ঘুরিয়ে দিয়ে স্টার্ট দিবে। তার বদলে কম্প্রেস্‌‌ড্‌‌ এয়ার দিয়ে কিক্‌‌ দেওয়া হয়। কিন্তু কোনো কারণে যদি সেই ট্যাঙ্ক বার্স্ট করে নিশ্চিন্ত থাকতে পারবেন পুরা জাহাজ ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে।

এছাড়াও ইঞ্জিনরুমে নানানধরনের পাম্প ও ইলেক্ট্রিক্যাল যন্ত্রপাতি থাকে, যার মধ্যে প্রায় সবগুলোই চলছে। কোথায়ও কোন ত্রুটি হলেই আগুনের সম্ভাবনা। অনেক পাম্প পানির জন্যে; কিন্তু বেশকিছু পাম্প আছে, যেগুলো তেল বা গরম তেল পাম্প করে। সুতরাং বুঝতেই পারছেন কত বিপজ্জনক ব্যাপার। এগুলোর আশেপাশে সিগারেট খাওয়াও বারণ। তেল নিজে কিন্তু জ্বলে না; তেল থেকে যেই বাষ্প বের হয়, সেটাই আসলে দাহ্য। ইলেক্ট্রিক্যাল শর্ট-সার্কিট হলে তো আর কথাই নেই। জ্বালানি তেল দিয়ে তো ইঞ্জিন-জেনারেটর চলে, কিন্তু যখন সেগুলো চলে তখন বন্‌‌বন্‌‌ করে ঘুরন্ত ইঞ্জিন-মেশিন বা পাম্পের মধ্যে স্টিলের সঙ্গে স্টিলের ঘর্ষণ যাতে না হয়, সেজন্য লুব্রিকেটিং অয়েল ব্যবহার করা হয়। এই লুব-অয়েল একটা পাতলা পিচ্ছিল ফিল্মের মত তৈরি করে স্টিলের দুই সারফেসকে রক্ষা করে। অয়েল না থাকলে লোহায়-লোহায় ঘর্ষণে আগুন লেগে যাবে। পর্যাপ্ত অয়েল যাতে থাকে সেজন্যে লুব-পাম্পের প্রেসার মনিটর করা হয়, কমতে থাকলেই এলার্ম বাজাবে, আর বেশি কমে গেলে, অটোমেটিক্যালি ইঞ্জিনই বন্ধ করে দিবে। আগুন লাগার থেকে, বন্ধ ইঞ্জিন ভালো।

এই কারণে, জাহাজের চারিদিকে Fire Detector এবং Fire Alarm থাকে। কোথায়ও আগুন লাগলে, ধোঁয়া বা আগুনের শিখা হবে, সেগুলোকে সেন্সর দিয়ে ডিটেক্ট করেই নিজের থেকেই এলার্ম বাজাতে পারে। অথবা, কেউ যদি আগুন দেখে, তাহলে নিজেই সঙ্গে সঙ্গে সবচেয়ে কাছের এলার্ম ধরে টান দিয়ে এলার্ম বাজাবে। জাহাজে পানির ফ্লাড বন্ধ করার জন্য ওয়াটার- রেজিস্ট্যান্ট ডোর থাকে; আর আগুন যাতে না ছড়ায়, সেজন্য থাকে ফায়ার- রেজিস্ট্যান্ট বা রিটার্ডেন্ট ডোর। মেরিনাররা সবাই ফায়ার-ফাইটিং-এ ট্রেইন্‌‌ড্‌‌; তারপরেও জাহাজে কিছুদিন পরপরই ফায়ার-ড্রিল করা হয়, সব যন্ত্রপাতি/এক্সটিংগুইশার চেক করে দেখা হয়। দুইটা গুরুত্বপূর্ণ সিস্টেমের কথা বলি। Water-mist Automatic Sprinkler System Ges CO2 Flooding System.

আজকাল স্প্রিঙ্কলার-সিস্টেম বড় বড় অফিস-আদালত, হোটেল, বিল্ডিং সবজায়গাতেই থাকে। ছাদে লালচে ধরনের একটা মরিচ-বাতির মত জিনিস থাকে (লাল ছাড়া অন্য রঙ্গেরও দেখবেন রঙ দিয়ে তাদের রেটিং বুঝানো হয়)। সেটাই সেন্সর এবং ডিটেক্ট করতে পারবে তার আশেপাশের জায়গায় আগুন লেগেছে কিনা। আগুনের আঁচে গরম হয়ে হয়ে সেই মরিচ বাতির মত জিনিসটা ঠুস্‌‌ করে ফেটে যাবে, আর সেটার মধ্যের পানি ঝরতে থাকবে। এর ফলে মেইন লাইনে পানি কমে গেলেই, সিস্টেমের কন্ট্রোলার টের পাবে একটা সেন্সর ফেটেছে, সঙ্গে সঙ্গে পাম্প শুরু হয়ে সেই জায়গায় পানি দিবে আগুন নিভানোর জন্যে। অটোমেটিক্যালি পাম্প শুরু হবে ও ছাদ থেকে চারিদিকে পানি ঝরতে শুরু করবে, আগুন নিভানোর জন্য। এই মরিচ-বাতির মতো সেন্সরগুলো হিসাবমত, স্ট্র্যাটেজিক্যালি একটু পরপর লাগানো যাতে সব জায়গাই কভার হয়। এদের মধ্যে জোন ভাগ করা থাকে, তার ফলে আগুন কন্ট্রোল করতে সুবিধা হয়। আর অতিরিক্ত পানি যেখানে দরকার নাই, সেখানে ছিটানো হয় না। আধুনিক সিস্টেমে সরং-এর বদলে Hi-Fog water, বা কুয়াশার মত করে পানি ছিটানো হয়। দুই সিস্টেমেই কিন্তু পানি ঢেলে দেওয়া হয় না। খুবই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মিহি পানির কণা ছিটানো হয়। এর ফলে আগুনের উপরে পানির একটা আস্তর সৃষ্টি হয়ে বাতাসের অক্সিজেন থেকে আলাদা করে ফেলার চেষ্টা করে। আর ছোট্ট পানির কণা খুব দ্রুত তাপ কমিয়ে আনতে পারে। খুবই কার্যকরী সিস্টেম এগুলো।

আর কার্বন-ডাই-অক্সাইড সিস্টেম শুধুমাত্র ইঞ্জিনরুমকে ফ্লাড করার জন্য। সেখানে যদি এমনই বড় আগুন ধরে যে, একদমই আয়ত্তে আনা যাচ্ছে না, কোনোকিছুই সম্ভব নয়, তাহলে শেষ উপায় হিসাবে সারা ইঞ্জিনরুম এই গ্যাস দিয়ে ভরিয়ে দিতে হবে তাহলে আগুন নিভে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আগে হ্যালন নামে এক নিষ্ক্রিয় গ্যাস ব্যবহার হতো, কিন্তু সেটা পরিবেশের জন্য ভালো নয়। তাই CO2 ব্যবহার শুরু হয়েছে। একদম এক্সট্রিম কেইসে এইটা ব্যবহার হবে। শুধুমাত্র চিফ-ইঞ্জিনিয়ারের কাছে এর চাবি থাকে। প্রথমেই গণনা করে নিশ্চিত করা হয় সব মানুষ ইঞ্জিনরুম থেকে বের হয়েছে কিনা। এরপরে সব মেশিনারিজ বন্ধ করার চেষ্টা করা হয়, ও সব দরজা জানালা, ভেন্টিলেটর বন্ধ করে দিয়ে CO2 রিলিজ করা হয়। সেটা একটা কম্বলের আচ্ছাদনের মত আগুনকে বাতাস থেকে আলাদা করে নিভিয়ে দিবে; আর সব দরজা-জানালা বন্ধ থাকায় নতুন বাতাসও ঢুকতে পারবে না। একবার CO2 ছাড়া হলে, এরপরে ইঞ্জিনরুমে আবার প্রবেশের আগে অনেকভাবে পরীক্ষা করে নিতে হবে ভিতরে ঢুকা নিরাপদ কিনা আগুনও থাকতে পারে, আর বেশীক্ষণ এই CO2 গ্যাস নিঃশ্বাসে ঢুকলেও মানুষেরও ক্ষতি হবে।
বুঝতেই পারছেন, জাহাজে আগুন লাগা একটা চরম রিস্কের ব্যাপার। এনিয়ে খুঁটিনাটি অনেক প্রসঙ্গ লেখা যায়, কিন্তু অহেতুক লম্বা ও বোরিং হয়ে যাবে। তবে মনে রাখবেন জাহাজেই হোক বা ডাঙ্গাতেই হোক, আগুন সর্বনাশা। যে যেভাবে পারেন, চেষ্টা করবেন আগুন যাতে শুরুই না হয় সেরকম পদক্ষেপ নিতে ও সতর্ক থাকতে।
টলিডো, ওহাইও, ২০২২
ৎবভধুবঃ@ুধযড়ড়.পড়স

পূর্ববর্তী নিবন্ধচীনের কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষ পর্যায়ে নেই কোনো নারী
পরবর্তী নিবন্ধঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’: চট্টগ্রাম বন্দরে সব কার্যক্রম বন্ধ