পানামা ক্যানাল

রেফায়েত ইবনে আমিন | সোমবার , ২২ জানুয়ারি, ২০২৪ at ৯:২২ পূর্বাহ্ণ

মানুষের বুদ্ধিমত্তা ও কারিগরী দক্ষতার মাঝে পানামা ক্যানাল শীর্ষস্থানীয় সেজন্যই সপ্তমআশ্চর্যের মাঝে এটা একটা। আপাতদৃষ্টিতে ব্যাপারটা খুবই সাধারণ প্যাসিফিক আর আটলান্টিক মহাসাগরকে সংযোগ করে খাল খনন করা হয়েছে। ব্যাপারটা তাই না? তা বটে। কিন্তু, এটা তো যেই সেই ব্যাপার নয় যে, গ্রামের পাশের নদীর থেকে খাল কেটে ধানী জমিতে পানির ব্যবস্থা করা। তার থেকে একটু বেশী, অনেক বেশীই। ১৯৯২ সালে পাইয়োনীয়ার রীফার জাহাজে আমি সেটা পাড়ি দিই। চলুন আজ সকলে মিলে ক্যানালটা পার হই, আর সেইসঙ্গে কিছু তথ্যইতিহাসও জেনে নিই।

ওয়ার্ল্ডম্যাপে দেখলে মনে করবেন, ডানে (পূর্বে) আটলান্টিক, আর বাঁয়ে (পশ্চিমে) প্যাসিফিকতাহলে পূর্বপশ্চিম একটা খাল কাটলেই হলো। উঁহু, ভুল করলেন। যদি ম্যাপটা জুম করেন, দেখবেন যে সেটা প্রায় খাড়াখাড়ি উত্তরদক্ষিণ বরাবর চলে; (উত্তরে একটু তেরছাভাবে পশ্চিমঘেঁষা, আর দক্ষিণে পূর্বঘঁষা)। আমার চোখে “দ” অক্ষর বা চেয়ারে বসা মানুষের হাঁটুর মতো। হাঁটুটাকে কুপিয়ে দু’ভাগ করে লাগিয়ে রাখলে, ভাগ হওয়া লাইনটাই হবে পানামা ক্যানাল। উত্তরে আটলান্টিক, দক্ষিণে প্যাসিফিক। আমরা প্যাসিফিকের দিকে পৌঁছে সিরিয়ালে কয়েক ঘন্টা অপেক্ষার পরে জাহাজে পাইলট আসলো। এখানে একটা জিনিস বুঝিয়ে বলিক্যাপ্টেন, মাস্টার ও পাইলটের মাঝে পার্থক্য কি? জাহাজে দুইটা ডিপার্টমেন্টইঞ্জিনিয়ারিং এবং নটিক্যাল; আমি ইঞ্জিনিয়ার। নটিক্যালের সকলে জাহাজ চালনা, নেভিগেশান, কার্গো লোডিংআনলোডিং ইত্যাদির কাজ করে। ইঞ্জিনিয়ারদের সবচেয়ে উঁচু পোস্ট চিফইঞ্জিয়ার; নটিক্যালে সবচেয়ে উঁচু পোস্ট ক্যাপ্টেন। কিন্তু, জাহাজের সর্বোচ্চ দায়িত্ব একজনেরতিনি মাস্টার। ট্র্যাডিশানালি, ক্যাপ্টেনই মাস্টার হন এবং জাহাজের সর্বোপরি দায়দায়িত্ব, অধিকার সব তারই। নটিক্যালের সকলে নেভিগেশান করে, বা জাহাজ চালায়; তাহলে পাইলট কে? বা সে কী করে? অধিকাংশ পাইলটই প্রাক্তন ক্যাপ্টেন বা নেভিগেশানাল অফিসার; কিন্তু তারা তাদের নিজেদের স্থানীয় জলপথে অভিজ্ঞ এবং লাইসেন্সপ্রাপ্ত। জাহাজের অফিসারেরা ক্যাপ্টেনের কমান্ডে খোলা সমুদ্রে জাহাজ চালিয়ে বন্দরের কাছাকাছি আসলে, পাইলটকে ডাকে। সে ছোট বোট বা হেলিকপ্টারে করে আসে। ক্যাপ্টেন আর পাইলটের যৌথ কমান্ডে জাহাজ চালিয়ে বন্দরে ভিড়ায়, বা সরু চ্যানেলনদী পার করে দেয় কারণ পাইলট লোকাল বলে, জায়গাটা তার মুখস্থ। পতেঙ্গা থেকে দূরে সমুদ্রে আউটারএংকোরেজে যেই জাহাজগুলো দেখেন, সেগুলো হয় বন্দরে ভিড়ার জন্যে পাইলটের অপেক্ষায় থাকে, বা চলে যাওয়ার পথে সেখানে পাইলটকে নামিয়ে দেয়। সেরকমই, পানামা ক্যানেলের জন্যে বিশেষভাবে ট্রেনিংপ্রাপ্ত পাইলট থাকে, তাদেরকে নিয়েই জাহাজ চালাতে হবে। মাঝে মাঝে একের অধিকও পাইলট থাকতে পারে, যখন প্যাসেজওয়ে অনেক দীর্ঘ হয়, তখন পালা করে বিশ্রাম করে।

চলুন এবারে লকগেইটে ঢুকি। নাহ্‌ ভাই, ডাইরেক্ট, গেইটলক বাসসার্ভিসের কথা বলছি না। লকগেইট হলো ওয়াটারটাইট দরজা, যেটা বন্ধ করে দিলে, পানি বের হবে না। ড্রাইডকে লকগেইট থাকে। নদীর পানির সমানে ড্রাইডক বানানো হয়; এরপরে নদীতে ভাসমান জাহাজকে সেখানে ঢুকিয়ে, পিছনে লকগেইট বন্ধ করে ভিতরের পানি পাম্প করে নদীতে ফেলে দিলে, জাহাজটা ড্রাইডকের শুকনা মেঝেতে কয়েকটা সাপোর্টিং ব্লকের উপরে দাঁড়িয়ে থাকে রিপেয়ারের জন্যে। কিন্তু পানি বের করার বদলে, লকগেইট বন্ধের পরে যদি আরো পানি ভরতে থাকি, তাহলে ভিতরের পানির উচ্চতা ক্রমাগত বাড়তে থাকবে, সেইসঙ্গে জাহাজটাও উপরে উঠতে থাকবে। এভাবে জাহাজকে বেশ অনেক ফুট উঁচুতে তুলে ফেলা সম্ভব। এখন চিন্তা করুন, পিছনেরটার মতোই সামনেও আরেকটা লকগেইট, যার অন্যপাশেও পানি। তাহলে সামনেরটা খুলে দিলে জাহাজ সামনের দিকে চলে যেতে পারবে। আর সামনের এলাকাটা যদি পিছনের থেকে উঁচুতে থাকে, তার মানে কী হলো? জাহাজটা দুই লক গেইটের সাহায্যে চড়াইতে উঠে গেলো। থিওরেটিক্যালি এভাবে কয়েক সেট লক গেইট দিয়ে একটা বিশাল জাহাজকে পাহাড়ের উপরে তুলে ফেলা সম্ভব। পানামার যেখানে ক্যানাল, সেখানে দুই মহাসাগরের মাঝের দূরত্ব খুবই কম, পঞ্চাশ মাইল। কিন্তু সেটা ভীষণ পাথুরে ও পাহাড়ি এলাকা। ১৮৮১ সালের দিকে ফ্রেঞ্চ ইঞ্জিনিয়াররা, যারা সুয়েজ ক্যানাল সফলভাবে বানিয়েছিলো, তারা ফ্রেঞ্চ সরকারকে দিয়ে পানামা সরকার থেকে সেই সরুচিপা স্থান কিনিয়ে নিয়ে, সেখানে খাল কাটা শুরু করেছিলো। প্ল্যান ছিলো ডিনামাইট দিয়ে দিয়ে পাহাড় উড়িয়ে খাল কাটবে, কিন্তু তারা মহাসাগর দুটাকে যুক্ত করতে তো পারেইনি বরং যেন কুমিরই ডেকে এনেছিলো। পুরা প্রজেক্ট ধসে গিয়েছিলো, ২২,০০০ কর্মী মারা গিয়েছিলো। সুয়েজ ক্যানালের ডিজাইনার/ইঞ্জিনিয়ার এবং এই কোম্পানির মালিক ও তার ছেলেসহ গুস্তাভ আইফেলেরও জেলজরিমানা হয়েছিলো। হ্যাঁ, আইফেল টাওয়ারের ডিজাইনার, তিনিও এ কোম্পানিতে যোগ দিয়ে ধরা খেয়েছিলেন। মশাম্যালেরিয়া, অন্যান্য অসুখবিসুখ, দুর্গমবিপজ্জনক এলাকা, অকল্পনীয় শক্ত পাথুরে পাহাড়সবকিছুই ছিলো তাদের বৈরি। ১৮৮৯ সালে তারা হাল ছেড়ে দেয়। এরপরে ১৯০১ সালে অ্যামেরিকা এগিয়ে আসে। তারা ফ্রেঞ্চদের ভুল থেকে অনেককিছু শিখে ও পুরা জায়গাটা গুড়িয়ে লেভেল করার বদলে, ঠিক করলো, চাগ্রী (বা চাগ্রেস, Chagres) নদীতে বাঁধ দিয়ে মাঝের পাহাড়ের উপরে একটা কৃত্রিম লেইক সৃষ্টি করবে। এরপরে দুইদিকে দুই মহাসাগরের সঙ্গে যোগ করার জন্যে কয়েক সেট করে লকগেইট বানাবে। একদিকের লকগেইট সিস্টেম দিয়ে দিয়ে জাহাজ পাহাড়ে উঠে সেই গাতুন লেইকে (Gatun Lake) পড়বে। কয়েক ঘন্টা গাতুন লেইক পাড়ি দিয়ে, অন্যদিকের সাগরের কাছে এসে, আবারো লকগেইট সিস্টেম ধরে ধরে নীচে নেমে ভেসে যাবে তার গন্তব্যে। রাস্তা পার হওয়ার ফুট ওভারব্রিজের মতই কিছু একটা কল্পনা করে নিতে পারেন। এখানে মানুষের বদলে জাহাজ; আর শুকনা ফুটপাথের বদলে দুই মহাসাগর; ওভারব্রিজটা হলো কৃত্রিম গাতুন লেইক। ব্যাপারটা খুবই সহজ তাই না? একটু দামী আরকী, সেযুগেই খরচ পড়েছিলো ৩৭৫ মিলিয়ন ডলার (বর্তমানের ১০১৫ বিলিয়ন ডলার মাত্র); সময় লেগেছিলো দশ বছর, আর প্রায় পাঁচ হাজার কর্মী মারা গিয়েছিলো।

অ্যামেরিকা প্রথমদিকে তাদের তৎকালীন বন্ধুদেশ নিকারাগুয়াতে এরকম ক্যানাল করবে বলে প্ল্যান করেছিলো। সেখানের খালের দৈর্ঘ্য এখানের তুলনায় দ্বিগুনেরও বেশী হলেও, অপেক্ষাকৃত সমতল ভূমিতে, কাজটা হয়তো সহজ হতো। কিন্তু ফ্রেঞ্চদের ফেলে যাওয়া কাজ থেকে শুরু করায়, পানামার প্রজেক্টে খরচ অনেক কম পড়েছিলো। স্পেন থেকে স্বাধীন হলেও, ১৯০১ সালে পানামা ছিলো গ্র্যান্ডকলম্বিয়ার অন্তর্গত টেরিটোরি। গ্র্যান্ডকলম্বিয়া এই ক্যানাল করতে দিতে অস্বীকৃতি জানালে, অ্যামেরিকা পানামাবাসীকে বিদ্রোহ করতে সাহায্য করে; এবং কলম্বিয়া থেকে পানামাকে সম্পূর্ণ স্বাধীন করে। যার পুরস্কারস্বরূপ সদ্যস্বাধীন দেশ পানামা, অ্যামেরিকাকে ক্যানাল করতে শুধু পারমিশানই দিলো না; সেটার আজীবন মালিকানা দিয়ে দিয়েছিলো। পরে অবশ্য, ১৯৬০৭০ এর দিকে এ নিয়ে বচ্‌সা শুরু হয়। ১৯৯৯ সালে পানামা পুরা মালিকানাই বুঝে পায়।

লকগুলো খুবই সরু, জাহাজ একদম লকের দেওয়ালে লেগে যায় প্রায়। ক্যানাল পার হতে হলে জাহাজের দৈর্ঘ্যপ্রস্থগভীরতার সার্টিফিকেট থাকতেই হবেআগে বলতো পানাম্যাক্স (Panamex); কয়েক বছর আগে লকের সাইজ বড় করেছে, তাই বলে নিওপানাম্যাক্স (Neo-Panamex)। সামনেপিছে টাগবোট বেঁধে ঢুকতে হয়; তারা জাহাজকে টেনে ঠিক রাখে; আরো আছে ‘খচ্চর’! দেশে মাঝিদের সাহায্যকারীদের নৌকায় গুন টানতে দেখেছেন? জয়নাল আবেদীনের একটা বিখ্যাত ছবিও আছে। অ্যামেরিকাইউরোপের ক্যানালগুলোতেও নৌকায় এককালে গুন টানতো তবে, সেখানে এই পরিশ্রমটা করতো ঘোড়া বা খচ্চর (mule)। পানামা ক্যানালের প্রথম লক গেইটে ঢুকার মুখে চারদিকে চারটা মিউল শক্ত কাছি দিয়ে জাহাজের সঙ্গে বেঁধে দেয়, তারাই জাহাজকে দ’ুদিক থেকে টেনে রেখে লকের দেওয়াল আর জাহাজের বডিকে রক্ষা করে। তা না হলে কয়েকটা জাহাজ পার হওয়ার পরেই সেই দেওয়াল ভেঙ্গে যেতো আর জাহাজগুলোর বডিও ড্যামেজ হতো। যদিও রাবারের ফেন্ডার দিয়ে মোড়া থাকে, তারপরেও। ওহ্‌ বলতে ভুলে গেছি, এখন আর জ্যান্ত পশু ব্যবহার করে না এগুলো ইলেক্ট্রিকের শক্তিশালী বাগীকার, লকের দুইপাশের দেওয়ালের রেইলে চলে চলে জাহাজকে সমান্তরালভাবে গাইড করে টেনে নিয়ে চলে।

আমরা দক্ষিণে পানামাসিটির পাশে বাল্বোয়া দিয়ে ঢুকে সুন্দর ব্রিজ অফ আমেরিকাসএর নীচ দিয়ে এলাম মিরাফ্লোরেস লকে। সেটা দিয়ে উপরে উঠে মিরাফ্লোরেস লেইকএর সমান হলাম। তারপরে পেদ্রো মিগুয়েল লক দিয়ে আরো উপরে উঠে চাগ্রি নদী ধরে পেয়ে গেলাম গাতুন লেইক। অনেকক্ষণ লেইকে উত্তর বরাবর চালিয়ে গাতুন লকে এসে নীচে নামা শুরু করলাম। সব মিলিয়ে প্রায় এগারোবারো ঘন্টায় পুরা ক্যানাল পার হয়ে, আমরা আটলান্টিকের দিকে ক্যারিবিয়ান সীর সমতলে এসে কোলোনের পাশ দিয়ে সাগরে নেমে চললাম আমাদের গন্তব্য ইংল্যান্ডে, এবারে টানা চৌদ্দ দিনের ভয়েজ। কেমন অভিজ্ঞতা হলো ক্যানাল পার হতে? ইউটিউবে সুন্দর ভিডিও দেখতে পারেন এর উপরে।

মরিনো ভ্যালি, ক্যালিফোর্নিয়া

refayet@yahoo.com

পূর্ববর্তী নিবন্ধচা বাগানের কড়চা
পরবর্তী নিবন্ধসানোয়ারা ইসলাম বালক উচ্চ বিদ্যালয়ে সেমিনার