আমার বাসাটা বড্ড প্রিয় আমার…বহু বছর এই বাসায় আমি। মনে হয় না বাধ্য না হলে ছাড়বো কখনো এখানে একটা অদ্ভুত মানসিক প্রশান্তি আছে। মেডিটেশনের মধ্যে সকলের জন্য প্রার্থনা শেষ করে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি স্নিগ্ধ ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথেই আমার জানালার পাশের বিশালকার মহীরুহতে আরম্ভ হয় প্রাণের স্পন্দন। বৃক্ষরাজীর শাখাগুলো দুলুনিতে কেমন যেন মনের ভিতর আন্দোলিত হতে থাকে…চারদিক পিউ পিউ কোলাহল… জানালা দিয়ে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকি। ছোট চড়ুইগুলো কেমন নেচে নেচে কিচিরমিচির শব্দ করে গান গায়। পাশেই একটি কিঞ্চিৎ উঁচু ডালে বাসা বেঁধেছেন একজোড়া কাক দম্পতি। তাদের বাসায় চারটি নতুন অতিথি। বাবা কাক খাবার সংগ্রহ করে আনেন এবং মা কাক তাদের পরম যত্নে মুখে তুলে খাওয়ান। কমলা ঠোঁটের ময়নাগুলোর সুরেলা ডাকাডাকিতে মন চকিত হয়ে ওঠে…পাশের দালানের ছাদের উপর একটি টিনের চাল। ঠিক আমার জানালার সাথে লাগানো। ওরা অপেক্ষা করে। ওরা জানে ঠিক কখন সময় হবে…আমিও অপেক্ষা করে থাকি ঠিক এই সময়টার জন্য। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যাই জানালার ধারে..দৌড়ে যাই ডাইনিং টেবিলের কাছে। পাউরুটির প্যাকেট থেকে দুটো টুকরো তুলে নিয়ে সামনের টিনের চালে ছড়িয়ে দিই। বাবাইের হাতেও পিনাট বাটার মাখানো একটি পাউরুটির টুকরো..একটু পড়ে আবার স্কুলে যাওয়ার তাড়া আছে ওর। বাবাই আমাকে বলে মা, মা, আসছে ওরা। তারপর কয়েক সেকেন্ডের অপেক্ষা… প্রথমে ভিরু পায়ে এগিয়ে আসে চড়ুইগুলো। একটি–দুটি। এদিক–ওদিক তাকায়। আমার দিকে তাকিয়ে খানিক্ষণ চেয়ে থাকে। মনে হয় বোঝার চেষ্টা করে আমরা নিরাপদ কিনা তাদের জন্য। আমি তখন মনে মনে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি…আমায় যেন ভয় না পায় ওরা। বাবাইকে বলি চুপ করে থাক কথা বললে পালিয়ে যাবে। একটি চড়ুই এগিয়ে এসে একটি টুকরো মুখে নিয়ে খানিক দূরে সরে যায়। ওর দেখাদেখিতে আরেকটি চড়ুই। এরপর ঝাঁকে ঝাঁকে আমগাছের শাখা হতে নেমে আসে আমার জানালার পাশে টিনের চালে। কোলাহলে পূর্ণ হয়ে ওঠে আমার জানালার আঙ্গিনা.. হাজার ব্যস্ততার মাঝে এ যেন এক অদ্ভুত মানসিক প্রশান্তি…‘প্রকৃতি মাতা তো সবার জন্যই সমভাবে বণ্টন করেছেন’। ইদানীং কোথায় যেন এটা কোকিলের কুহুতান শোনা যায়। তবে তারে আমি চোখে দেখিনি। সকালের কাজ করতে করতে দেখি আজ আবার রং–বেরঙের কিছু পাখি। দুটো পাখি পাউরুটির একটা টুকরো নিয়ে ঝগড়া করছে। আর আমার ছেলেটা জানালার পাশে বসে বসে দেখে, আর হেসে কুটি–কুটি হয়ে যায়। আমি অবাক নয়নে ওই নিস্পাপ শিশুমুখটার দিকে তাকিয়ে থাকি খানিকক্ষণ। আর মনে মনে রবিঠাকুরের গান গুন গুন করি-‘পাখি আমার নীড়ের পাখি’।