পছন্দের নম্বরের জন্য ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত বাড়তি ফি

গাড়ি থেকে রাজস্ব বাড়ানোর উদ্যোগ উন্নত বিশ্বে প্রচলিত থাকলেও দেশে প্রথম

আজাদী প্রতিবেদন | মঙ্গলবার , ১৭ নভেম্বর, ২০২০ at ৯:৪৭ পূর্বাহ্ণ

শুধু রেজিস্ট্রেশনই নয়; পছন্দের নম্বর ব্যবহার করতে চাইলে তা কিনতে হবে চড়া দামে। একেকটি পছন্দের নম্বরের জন্য এক লাখ টাকা থেকে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত বাড়তি ব্যয় করতে হবে গাড়ি ব্যবহারকারীদের। বিষয়টি গাড়ি ব্যবহারকারীদের ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। অগ্রিম আয়কর প্রদানের বিষয়টি নিয়ে দিশেহারা গাড়ি ব্যবহারকারীরা ‘পছন্দের নম্বর’ পেতে দুই থেকে সাতগুণ পর্যন্ত বাড়তি ফি আদায়কে ‘বিনে মেঘে বজ্রপাত’ বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। অবশ্যই নতুন এই নিয়মে সরকারের কয়েক কোটি টাকার রাজস্ব আয় বাড়বে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে। তবে ‘নম্বর বিক্রির’ বিষয়টি বাংলাদেশে নতুন হলেও উন্নত বিশ্বে তা বহু আগে থেকে প্রচলিত বলে জানা গেছে।
বিআরটিএর দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানিয়েছে, সরকার দেশের অভ্যন্তরীণ খাত থেকে রাজস্ব আয় বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে গাড়ি ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে বিভিন্নভাবে শুল্ক ও ট্যাক্স বাড়িয়ে আদায় করা হচ্ছে। গাড়ি রেজিস্ট্রেশনের পাশাপাশি অগ্রিম আয়কর এবং সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু এবার একেবারে নতুন ধাচের একটি ফি বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। রেজিস্ট্রেশনকালে পছন্দের নম্বর পেতে হলে নির্ধারিত রেজিস্ট্রেশন ফি’র দুই থেকে সাতগুণ পর্যন্ত বাড়তি পরিশোধ করতে হবে। রেজিস্ট্রেশনের সময় কোনো পছন্দের নম্বর নিতে চাইলে স্বাভাবিকভাবে একটি গাড়ির রেজিস্ট্রেশন ফি এক লাখ টাকা হলে নির্দিষ্ট কিছু নম্বরের ক্ষেত্রে তা ছয় লাখ টাকা পর্যন্ত দিতে হচ্ছে। যেই গাড়ির রেজিস্ট্রেশন ফি সাড়ে চার লাখ টাকা তাকে ওই নম্বরটি নিতে হলে পরিশোধ করতে হবে ২০ লাখ টাকা। আর একেবারে অস্বাভাবিক এই ‘ফি’ নিয়ে ইতোমধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের বিআরটিএ সংস্থাপন শাখা থেকে জারি করা বিশেষ প্রজ্ঞাপনে মোটরকার ও জিপ গাড়ির ক্ষেত্রে যে কোনো সিসির গাড়ি অর্থাৎ ক খ গ ঘ এবং ভ সিরিজের ১১ থেকে ৯৯ পর্যন্ত সিরিয়ালে পছন্দের নম্বর নিতে বাড়তি ফি পরিশোধ করতে হবে। প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী সবগুলো সিরিজের ৭৭-৭৭৭৭ নম্বরটি নিতে হলে রেজিস্ট্রেশন ফি সাতগুণ পরিশোধ করতে হবে। ১১ থেকে ৯৯ সিরিয়ালের মধ্যে ছয়টি ডিজিট একই নিতে হলে (যেমন ১১-১১১১, ২২-২২২২, ৩৩-৩৩৩৩) ছয়গুণ, ছয় ডিজিট জোড়া জোড়া হলে (যেমন-১২-১২১২, ১৩-১৩১৩, ১৪-১৪১৪) পাঁচগুণ, মোট ছয় ডিজিটের শেষ চারটি একই হলে যেমন ( ১১-৯৯৯৯, ১২-১১১১, ১৩-৩৩৩৩) চারগুণ, শেষ চার ডিজিট জোড়া জোড়া হলে যেমন ১১-১২১২, ১২-৩২৩২, ১৩-৪৫৪৫) তিনগুণ, শেষ চারটি ডিজিটের দুটি করে ডিজিট একই হলে যেমন ( ১১-১১২২, ১২-২২৩৩, ১৩-৯৯০০) দ্বিগুণ বাড়তি রেজিস্ট্রেশন ফি প্রদান করতে হবে। এক্ষেত্রে শুধু বিশেষ কোনো ফি’ই নয়, সংশ্লিষ্ট গাড়িটি রেজিস্ট্রেশন করতে বিভিন্ন ধরনের ফি মিলে যত টাকা পরিশোধ করতে হয় তারই দ্বিগুণ থেকে সাতগুণ পর্যন্ত অর্থ পরিশোধ করেই পছন্দের নম্বরটি নিতে হবে।
বিআরটিএর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, ১৫শ’ সিসির একটি সাধারণ প্রাইভেট কার রেজিস্ট্রেশন করতে বর্তমানে ১ লাখ আড়াই হাজার টাকার মতো খরচ হয়। পছন্দের নম্বর নিতে হলে এই টাকারই দ্বিগুণ থেকে সাতগুণ পর্যন্ত বাড়তি জমা দিতে হবে। অপরদিকে চার হাজার সিসির একটি জীপ গাড়ি রেজিস্ট্রেশন করতে সর্বমোট খরচ হয় সাড়ে চার লাখ টাকারও বেশি। দুই হাজার সিসির বেশি কার বা জীপের জন্য পছন্দের নম্বর নিতে হলে এখন এই টাকার দুই থেকে সাতগুণ পর্যন্ত বেশি পরিশোধ করতে হবে। যার অংক প্রায় ২০ লাখ টাকার কাছাকাছি।
বিআরটিএর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, উন্নত বিশ্বে বহু আগ থেকেই পছন্দের নম্বরের জন্য বাড়তি ফি নেয়ার রেওয়াজ রয়েছে। এমনকি নিজের নাম দিয়েও গাড়ি রেজিস্ট্রেশন করানো যায়। সেক্ষেত্রে ওভাবেই ফি পরিশোধ করতে হয়। আবার ব্যক্তিগত পর্যায়েও নম্বর বিকিকিনি চলে। পছন্দের কোনো নম্বর অন্য কারো কাছ থেকে চড়া দামে কিনে নিজের নামে করার ব্যবস্থাও রয়েছে উন্নত বিশ্বে। কিন্তু বাংলাদেশে ব্যাপারটি একেবারেই প্রথম। এর আগে কোনো দিন এদেশে ‘পছন্দের নম্বর’ বিক্রি হয়নি।
গতকাল একাধিক গাড়ি ব্যবহারকারী দৈনিক আজাদীকে জানান, গাড়ির অগ্রিম আয়কর নিয়ে আমাদের দিশেহারা হওয়ার উপক্রম। পছন্দের একটি নম্বর নেয়ার ক্ষেত্রে এভাবে লাখ লাখ টাকা আদায়ের ব্যাপারটি অচিন্তনীয়। বিষয়টি নতুন করে ভাবা দরকার বলেও তারা মন্তব্য করেন।
নাসিরাবাদ আবাসিক এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ হামিদুল ইসলাম গতকাল দৈনিক আজাদীর সাথে আলাপকালে জানান, ১৯৯৬ মডেলের একটি করোনা বঙ এবং ১৯৯৫ মডেলের একটি স্টারলেট গাড়ি রয়েছে আমার। দুইটি গাড়ি বর্তমানে বিক্রি করলে কোনো অবস্থাতেই পাঁচ লাখ টাকার বেশি হবে না। অথচ গাড়ি দুটির জন্য আমাকে ৭৫ হাজার টাকা ইনকাম ট্যাঙ পরিশোধ করতে হয়েছে। এই টাকা আমার বার্ষিক ইনকাম ট্যাঙের সাথে সমন্বয় করা হবে। কিন্তু আমার ব্যবসা বাণিজ্য কিংবা চাকরিতে কোনো অবস্থাতেই ৭৫ হাজার টাকা ট্যাঙ আসবে না। অথচ আমাকে অগ্রিম ট্যাঙ পরিশোধ করতে হয়েছে।
বিআরটিএ সূত্রে বলা হয়েছে যে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে অগ্রিম আয়কর বাড়িয়ে গাড়ির সিসি ভেদে নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। আগে ১৫০০ সিসির একটি প্রাইভেট কারের বিপরীতে অগ্রিম আয়কর হিসেবে ১৫ হাজার টাকা, ট্যাঙ টোকেন নবায়ন ফি ৫ হাজার ৮০২ টাকা, ফিটনেস সনদ নবায়ন ফি ১০৮৭ টাকা মিলিয়ে সর্বমোট ২১ হাজার ৯৮৯ টাকা আদায় করা হতো। কিন্তু গত পহেলা জুলাই থেকে অগ্রিম আয়কর ১৫ হাজার টাকার স্থলে দশ হাজার টাকা বাড়িয়ে ২৫ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। একই সাথে বিআরটিএর বিভিন্ন সেবায় সম্পূরক শুল্ক ১০ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার ফলে শুল্কের ক্ষেত্রেও ৫শ’ টাকা থেকে এক হাজার টাকা বাড়তি গুণতে হচ্ছে। এতে করে বর্তমানে ১৫শ’ সিসির একটি সাধারণ প্রাইভেট কার পুষতে বছরে শুধু ট্যাঙই পরিশোধ করতে হচ্ছে ৩৩ হাজার টাকার বেশি। একই সাথে ১৫০০ সিসির বেশি কিন্তু ২০০০ সিসির কম এমন প্রাইভেট কার ও জিপ গাড়িতে আয়কর আগে ছিল ৩০ হাজার টাকা। বর্তমানে তা বাড়িয়ে করা হয়েছে ৫০ হাজার টাকা। ২০০০ সিসি থেকে ২৫০০ সিসির কম গাড়ির আয়কর ৭৫ হাজার টাকা ২৫০০ থেকে ৩০০০ সিসির কম পর্যন্ত প্রাইভেট কার ও জীপের অগ্রিম আয়কর ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা, ৩০০০ সিসি থেকে ৩৫০০ সিসি পর্যন্ত গাড়ির জন্য ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং ৩৫০০ সিসির বেশি গাড়ির জন্য বছরে ২ লাখ টাকা অগ্রিম আয়কর হিসেবে নেয়া হচ্ছে। বিলাসবহুল গাড়িগুলোর ক্ষেত্রে এক লাফে অগ্রিম আয়কর পঞ্চাশ হাজার টাকা থেকে ৭৫ হাজার টাকা পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। মাইক্রোবাসের ক্ষেত্রে বছরে ৩০ হাজার টাকা অগ্রিম আয়কর নির্ধারণ করে আদায় করা হচ্ছে। আগে শুধু ফিটনেস করানোর সময়ই অগ্রিম আয়কর নেয়া হতো। গত পহেলা জুলাই থেকে ফিটনেস কিংবা ট্যাঙ টোকেন যেটির মেয়াদ আগে ফুরোবে সেটি করানোর সময়ই অগ্রিম আয়কর প্রদান করতে হচ্ছে।
অগ্রিম আয়করের বিষয়টি নিয়ে হামিদুল ইসলামের মতো ক্ষোভ বহু মানুষের। যাদের অনেকেই পারিবারিক প্রয়োজনে এক বা দুটি পুরাতন গাড়ি রেখেছেন। এখন এই গাড়ি তাদের গলার কাঁটা হয়ে উঠেছে।
পুরাতন গাড়ি মালিকদের এই আক্ষেপের কোনো সুরাহা হওয়ার আগে নতুন গাড়ির রেজিস্ট্রেশনের ফি নিয়ে সরকারি নির্দেশনা অনেককেই হতাশ করেছে। সরকারি কর্মকর্তাদের অনেকেই বিশেষ ঋণ সুবিধায় গাড়ি কিনছেন। শত শত গাড়ি বিক্রি এবং রেজিস্ট্রেশন হচ্ছে। কিন্তু পছন্দের নম্বর নিতে গিয়ে প্রতিদিনই বিআরটিএতে হতাশ মানুষের সংখ্যা বাড়ছে।
বিষয়টি নিয়ে গতকাল বিআরটিএর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বলেছেন, ব্যাপারটি আমাদের হাতে নেই। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। ওই ফি ব্যাংকের মাধ্যমে আদায় করা হয়। রেজিস্ট্রেশনের নম্বর ঢাকা থেকে দেয়া হয়। পছন্দের নম্বরের বিপরীতে বাড়তি ফি জমা না হলে রেজিস্ট্রেশনই হবে না। ঢাকায় কম্পিউটার লকড করা নম্বরগুলো বাড়তি ফি ছাড়া খুলবে না বলেও তিনি উল্লেখ করেন। বিআরটিএর সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম পছন্দের নম্বরের জন্য বাড়তি ফি’র বিষয়টি স্বীকার করলেও কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ‘বিজ্ঞানের হঠাৎ আবিষ্কার’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন
পরবর্তী নিবন্ধসংক্রমণে এশিয়ার শীর্ষ পাঁচে বাংলাদেশ