নীলকণ্ঠী কবি জীবনানন্দ দাশ

কাজী রুনু বিলকিস | সোমবার , ৯ নভেম্বর, ২০২০ at ৫:৩৫ পূর্বাহ্ণ

স্বপ্ন নয়- শান্তি নয়- ভালবাসা নয়,
হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়;
আমি তারে পারি না এড়াতে,
সে আমার হাত রাখে হাতে

সব কাজ তুচ্ছ মনে হয়- পণ্ড মনে হয়
সব চিন্তা-প্রার্থনার সকল সময়
শূন্য মনে হয়
শূন্য মনে হয়।

সেই ‘বোধ’ কবিকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে আজীবন। জীবনানন্দ নাম হলেও কবির জীবন পাঠে আনন্দের কোন খোঁজ পাওয়া যায় না। এমনিতে নিভৃতচারী তার উপর বহুমাত্রিক জটিলতায় কবি আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলেন। জীবনানন্দ দাশ আমার প্রিয় কবিদের তালিকার শীর্ষে। তাঁকে জানার আগ্রহ আমার বরাবরই। স্কুল থেকে জেঁকে বসেছে। সদ্য স্বাধীন দেশে তাঁর মনের ভেতর গুনগুনিয়ে চলতো, “বাংলার মুখ, আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ/ খুঁজিতে যাই না আর… কিংবা তোমারা যেখানে সাধ চলে যাও- আমি এই বাংলার পারে/ র’য়ে যাব; দেখিব কাঁঠালপাতা ঝরিতেছে ভোরের বাতাসে;
ত্রিশের দশকে রবীন্দ্র বলয় ভেঙে অন্য পথের সন্ধান করা বা বেরিয়ে আসা প্রায় অসম্ভব নয় দুঃসাহসও বটে। এই গতানুগতিকতা থেকে বেরিয়ে এসে বাংলা কাব্যের নতুন গতিমুখ দেওয়াটা যেন কবির অপরাধ হয়ে উঠেছিল।
এক শ্রেণির শিক্ষিত নাক উঁচু আঁতেলের নীচতা, শঠতা, সংকীর্ণতা কবিকে করেছিল ক্ষত বিক্ষত। তাঁর কবিতা নিয়ে ক্রমাগত অভিযোগ কবিকে মানসিকভাবে অস্থির করে তুলেছিল। অথচ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বুদ্ধদেব বসুকে লেখা এক চিঠিতে জীবনানন্দ দাশের লেখার খুব প্রশংসা করেন এবং তাঁর কবিতা চিত্র রূপময় বলে মন্তব্য করেন। এই চিত্র রূপময়তার কারণে পাঠক সহজে কবিতায় একাত্ম হতে পারে আগাগোড়া।
জীবনানন্দ দাশের কবিতার মূল সুর বিষণ্নতা, প্রকৃতি, দেশপ্রেম,নগর জীবনের অবক্ষয়, হতাশা নিঃসঙ্গতা সব মিলিয়ে জীবনানন্দ দাশ এক ব্যতিক্রমী কবি হিসেবে পাঠকের হৃদয় ছুঁয়ে গেছেন। ২২অক্টোবর ছিল জীবনানন্দ দাশের প্রয়াণ দিবস। কুসুমকুমারী দেবীর অন্তর্মুখী ছেলে মিলু শৈশবে মাকে বলতে শুনেছেন “আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে কথায় না বড় হয়ে কাজে বড় হবে” সত্যিই তাঁর সন্তান অনেক বড় হয়েছিলেন কাজে কিন্তু নিজেকে প্রকাশ করেননি জীবদ্দশায়। ট্রাংক ভর্তি করে তাঁর অমূল্য রচনা তালাবন্ধ করে আটকিয়ে রেখেছিলেন, কোন ভীতিতে? কোন আতঙ্ক কবিকে পেয়ে বসেছিল?
জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুর পরে উদ্ধার হয় সেই অতুলনীয় ও অপ্রকাশিত রচনার বিপুল সম্ভার। জীবদ্দশায় তাঁর প্রকাশনা বলতে ৫টি কাব্যগ্রন্থ এবং শ্রেষ্ঠ কবিতায় অন্তর্ভুক্ত ১৬২টি কবিতা এবং বিভিন্ন সাময়িকপত্রে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা আরও শ’খানেক কবিতা ও প্রবন্ধ নিবন্ধ। ২১টি উপন্যাস এবং শতাধিক ছোটগল্প রচনা করলেও একটিও ছাপতে দেননি কোথাও, ট্রাংকে তালা চাবি এঁটে সযত্নে লুকিয়ে রেখেছিলেন হাজার-হাজার পাতার অপ্রকাশিত গল্প উপন্যাসের খাতা ও ডায়েরি। মূলত কবি ভুমেন্দ্র গুহই জীবনানন্দের অপ্রকাশিত লেখাগুলো প্রকাশ করেছিলেন।
মৌলিক ও ভিন্ন পথের অনুসন্ধানী এই কবি মৃত্যুর পরই পাঠকপ্রিয়তা লাভ করেন। ১৯৯৯ সালে তাঁর জন্মশতবার্ষিকী পালন করা হয়। দুর্ভাগ্য কবিকে তাড়া করে ফিরেছে। একাকীত্ব আর নিঃসঙ্গতার কাছেই কবি বরাবরই সমর্পিত হয়েছেন। ঘরে-বাইরে কোথাও তিনি স্বস্তি খুঁজে পাননি। ঘর ছিল, মগ্ন চৈতন্যে-প্রেম ছিল, ভালবাসা ছিল তবুও গৃহী হয়ে উঠতে পারেন নি। আর্থিক অসচ্ছলতা, আধুনিক, শিক্ষিত, উচ্চাভিলাষী লাবণ্য দাশ কবিকে কখনই মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেননি।
তাঁর কাছে কতটা অবজ্ঞার ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় ভুমেন্দ্র গুহের লেখায়। এ-বিষয়ে ভুমেন্দ্র গুহের ভাষ্যে,“স্বামীর শোকাবহ মৃত্যুর পর তাঁর ছবির সন্ধানে ভুমেন্দ্র গুহের প্রশ্নের জবাবে কিছুটা অবজ্ঞার সুরে বলেছিলেন লাবণ্য দাশ “ছবি আমার কাছে নেই… তাছাড়া ওই ছবি-টবি তোলনো-টোলানো নিয়ে আমার কোন মাথাব্যথা কোনদিন ছিল না, তোমাদের দাদা দেখতেও তো এমন রাজপুত্তুর ছিলেন না।”
বিয়ের পর থেকে লাবণ্য দাশের বিরূপ মনোভাব ছিল কবির প্রতি। তার প্রধান কারণ কবির বেকারত্ব ও অসচ্ছলতা। ব্রজমোহন কলেজ ছাড়া কবি কোথায়ও স্থির হতে পারেন নি। ব্রজমোহন কলেজে কয়েক বছর কবিকে স্থির মনে হয়। তাঁর সেরা কাব্যগুলো এখানেই রচিত হয়। লাবণ্য দাশের আর্থিক অসচ্ছলতার জন্য যে ক্ষোভ, বিতৃষ্ণা কবির প্রতি ছিল তা আরও স্পষ্ট হয় ১৯৫৪ সালে ট্রাম দুর্ঘটনার পর ৮ দিন হাসপাতালে শয্যাশায়ী হলেও কবিপত্নি তাঁর পাশে ছিলেন না, সেটা স্বাভাবিক ঘটনা বলে ধরে নেওয়া যায় না।
ভুমেন্দ্র গুহ লিখেছেন কোলকাতার একশো বছরের ইতিহাসে জীবনানন্দ দাশই একমাত্র ব্যক্তি যিনি ট্রাম দুর্ঘটনায় মারা গেছেন। কবির জীবনের প্রতি এক ধরনের বিতৃষ্ণা, আত্মহত্যা স্পৃহা, জাগতিক অসহায়ত্ব এই দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে বলা যায়।
জীবনানন্দ দাশের মৃত্যু নিয়ে অনেক সন্দেহ পোষণ করেন এটা দুর্ঘটনা না আত্মহত্যা। কবির জীবন জুড়ে কেবল আলো আঁধারের খেলা!
কেবল অপ্রেমের গল্প!

পূর্ববর্তী নিবন্ধবৃষ্টিতে আর জল নেই
পরবর্তী নিবন্ধ৮ জনের নামে মামলা, গ্রেপ্তার আরও ৩