নির্যাতনের পর শিশু খুনের ঘটনা বাড়ছে

‘সামাজিক অবক্ষয় থেকেই এ ধরনের ঘটনা’ পাড়াভিত্তিক কমিটি ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বাড়ানোর পরামর্শ

ঋত্বিক নয়ন | শনিবার , ১ এপ্রিল, ২০২৩ at ৪:৪৭ পূর্বাহ্ণ

শিশু নির্যাতন ও খুনের ঘটনা নগরীতেই শুধু নয়, ছড়িয়ে পড়েছে জেলার বিভিন্ন এলাকায়। গত দশ মাসে চট্টগ্রামে শিশুদের ওপর নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে শতাধিক। এর মধ্যে নির্যাতনের পর শিশু খুনের ঘটনাও ঘটেছে, যার মধ্যে কয়েকটি মধ্যযুগীয় বর্বরতাকেও হার মানিয়েছে। অপরাধ বিজ্ঞানীরা বলছেন,

 

সামাজিক অবক্ষয় থেকেই এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। তাঁদের মতে সাম্প্রতিক সময়ে কন্যা শিশুরা এক ধরনের বিকারগ্রস্ত মানসিকতার বলি হচ্ছে। এসব প্রতিরোধে পাড়াভিত্তিক সচেতন কমিটি ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন তারা। সর্বশেষ গত বুধবার ভোরে পাহাড়তলী থানা এলাকায় দশ

বছরের শিশু নিখোঁজ আয়নীর বস্তবন্দি লাশ উদ্ধারের পর আতঙ্কিত নগরবাসী। কারণ আয়নী নিখোঁজ হওয়ার পরপরই তার পরিবারের সদস্যরা পাহাড়তলী থানা পুলিশকে অবহিত করে সিসিটিভি ফুটেজ দেখায়, সন্দেহভাজন আসামির নামও বলে। কিন্তু পুলিশ তাদের অভিযোগ আমলে না নিয়ে উল্টো অবোধ শিশু

আয়নী প্রেম করে পালিয়ে গেছে বলে মন্তব্য করে বলে অভিযোগ করছে তার পরিবার। পাহাড়তলী থানা পুলিশ ব্যর্থ হলেও আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার পরদিনই পিবিআই, চট্টগ্রাম মেট্রো একমাত্র আসামি রুবেলকে মঙ্গলবার রাতে গ্রেপ্তার করে বুধবার ভোরেই লাশ উদ্ধার করে। প্রসঙ্গত, এর আগে আয়াতের ঘটনার ক্ষেত্রেও ইপিজেড থানা পুলিশের ব্যর্থতা পরিলক্ষিত হয়।

বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. অনুপম সেন আজাদীকে বলেন, প্রযুক্তিগত সুবিধার প্রয়োজন অস্বীকার করা যাবে না। ইন্টারনেটের প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু এর অপব্যবহার বন্ধ করতে প্রচলিত আইন সংশোধনের যেমন প্রয়োজন রয়েছে; একই ভাবে আইনের যথাযথ প্রয়োগও নিশ্চিত করতে হবে। তিনি বলেন,

বিভিন্ন উন্নত দেশে শিশুদের স্কুলে এ বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হয়। ফলে তারা কখনো অপরিচিত কারো সাথে কোথাও যায় না। এমনকি কোন পরিস্থিতিতে যাবে সেটিও স্কুল থেকেই শিক্ষা দেওয়া হয়। কিন্তু আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় এ শিক্ষাটি শিশুদের দেওয়া হয় না। একইভাবে সেই দেশগুলোতে বিকারগ্রস্ত ব্যক্তিদের সরকারি বা বেসরকারি পর্যায়ে কাউন্সেলিং ও চিকিৎসার ব্যবস্থা রয়েছে।

আমাদের দেশে এমন ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন। শিশু নির্যাতন, অপহরণ এবং হত্যার প্রবণতা বৃদ্ধির নেপথ্য কারণ চিহ্নিত করে সে অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণের তাগিদ দিয়েছেন তিনি।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, অপরাধীরা সব সময় দুর্বলতাকে টার্গেট করে কাজ করে। শিশুরা দুর্বল হওয়ায় লোভ ও স্বার্থের জন্য তাদের হত্যা করা হয়। আগে মুক্তিপণের জন্য অপহরণ ও প্রতিশোধ নিতে শিশুদের খুন করা হতো। ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনাও ছিল। কয়েক বছর ধরে পারিবারিক কলহের

জেরে স্বামীস্ত্রীর হাতে সন্তানদের খুনের ঘটনা বাড়ছে। পারিবারিক অস্থিরতা ও অসততার কারণে শিশু খুনের ঘটনা বাড়ছে। তবে এসব ঘটনা গুরুত্ব দিয়ে তদন্তও করা হচ্ছে। গ্রেপ্তার হচ্ছে অপরাধীরা।

অনুসন্ধানে জানা যায়, কোনো কিছুর প্রলোভন দেখিয়ে কন্যা শিশুর প্রতি যৌন হয়রানিসহ নানা ধরনের বর্বরতা বাড়ছে চট্টগ্রামে। একের পর এক শিশু ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় তাই আতঙ্কিত অভিভাবকরা। চট্টগ্রামে যে দশ শিশুকে হত্যার ঘটনা ঘটেছে, তার মধ্যে সাতটি ঘটনাতেই টোপ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে

শিশুটির কোন জিনিসের ওপর আসক্তি রয়েছে। সর্বশেষ পাহাড়তলীর ঘটনাটিতেও দেখা যায়, আসামি রুবেল আগে থেকেই জানতো বিড়ালছানার প্রতি আয়নীর দুর্বলতা আছে। সেই দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়েই রুবেল যৌন নির্যাতনের জন্য ফাঁদ পাতে। বিড়াল ছানা দেওয়ার কথা বলে গত ২১ মার্চ একটি ফাঁকা

ভবনে নিয়ে গিয়ে তাকে যৌন নির্যাতন ও হত্যা করে। যেখান থেকে লাশ উদ্ধার করা হয়েছে, সেখান থেকে দুই কিলোমিটার দূরে শিশুটির পোশাক ফেলে রাখা হয়, যাতে ক্লু না পায় কেউ।

চলতি বছরের ২৭ জানুয়ারি রাঙ্গুনিয়া পোমরা ইউনিয়নে ছয় বছরের একটি শিশুকে বাড়ির পাশের পেয়ারা বাগানে নিয়ে ধর্ষণ করে জাহেদুল ইসলাম নামে এক তরুণ। শিশুটির চিৎকারে মা ছুটে এলে পালিয়ে যায় জাহেদ। পরে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

গত বছর ২৪ ডিসেম্বর বোয়ালখালী শাকপুরা চৌমুহনী এলাকায় পাঁচ বছর বয়সী একটি শিশু অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে খেলা করার সময় তাকে প্রলোভন দেখিয়ে নিজ বাড়িতে নিয়ে যায় প্রতিবেশী জাহাঙ্গীর (৪৫)। সেখানে তাকে ধর্ষণ করা হয়। বোয়ালখালী থানায় মামলা হলে পুলিশ জাহাঙ্গীরকে গ্রেপ্তার করে।

৪ ডিসেম্বর মহেশখালীতে সাত বছরের শিশু মাহিয়া মাহিকে অপহরণের পর হত্যা করে কঙবাজারের পেকুয়া উপজেলার উজানটিয়া ইউনিয়নের করিয়ারদিয়া এলাকার একটি লবণমাঠে ফেলে যায় অজ্ঞাতনামারা।

২ নভেম্বর আকবরশাহ থানার উত্তর কাট্টলীর কর্নেল হাট জোন্স রোডের কবরস্থানের পাশে পাঁচ বছরের কন্যা শিশুকে ধর্ষণ করে ৪৫ বছর বয়সী রিকশাচালক আলমগীর খান। চিপসের প্রলোভন দেখিয়ে শিশুটির ওপর যৌন নির্যাতন করা হয়। ২৫ নভেম্বর আয়াতের লাশের খন্ডাংশ উদ্ধার করে পিবিআই। ১৫ নভেম্বর শিশুটি নিখোঁজ হয়েছিল। আবির নামের এক প্রতিবেশীই তাকে মুক্তিপণ আদায় করতে অপহরণের পর হত্যা করে।

২৪ অক্টোবর জামালখানের বর্ষা নামের প্রথম শ্রেণির এক ছাত্রী নিখোঁজ হয়। তিনদিন পর নালা থেকে বস্তাবন্দি লাশ উদ্ধার করা হয়। এক দোকান কর্মচারী ধর্ষণের পর তাকে শ্বাসরোধে হত্যা করে। লাশ বস্তা বন্দি করে ফেলে দেয় নালায়।

১৮ সেপ্টেম্বর বন্দর থানার আবাসিক পোর্ট কলোনির একটি পরিত্যক্ত ভবন থেকে সাত বছর বয়সী শিশু সুরমার মরদেহ উদ্ধার হয়। বিরিয়ানির লোভ দেখিয়ে তাকে নিয়ে গিয়েছিল আসামি হারুন মিন্টু। স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে সে জানায়, চিৎকারচেঁচামেচি করায় গলায় গামছা পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করে লাশ ফেলে রেখে যায় সে।

১৬ জুন হাটহাজারীতে সাড়ে তিন বছরের ওয়ালিদকে সারা শরীরে ছুরি চালিয়ে নৃশংসভাবে খুন করে দুর্বৃত্তরা। কেন এমন নৃশংসতার শিকার হলো শিশু ওয়ালিদ, সেটা কেউ বলতে পারছেন না।

গত ১৩ মার্চ হালিশহর থানা এলাকার এক ছাত্রীকে ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনায় প্রতিবেশীকে গ্রেপ্তার করেছিল র‌্যাব।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশিপিং এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচন কাল
পরবর্তী নিবন্ধমার্কেটে মার্কেটে বর্ণিল সাজ