নিরাপদ বাহনে কেন এত দুর্ঘটনা

ঝুঁকিমুক্ত রেলযাত্রার জন্য যা করতে হবে

আজাদী প্রতিবেদন | রবিবার , ১৪ নভেম্বর, ২০২১ at ৬:২৬ পূর্বাহ্ণ

‘নিরাপদ বাহন’ রেল কেড়ে নিচ্ছে প্রাণ। পরিসংখ্যান বলছে, রেলে যত দুর্ঘটনা ঘটছে তার প্রধান কারণ অসচেতনতা। এর পরের কারণ হিসেবে আছে লেভেল ক্রসিং, ঝুঁকিপূর্ণ লাইন ও সেতু। প্রতিদিন তিনবার করে পুরো রেললাইন, সিগন্যাল ও সেতু পরিদর্শনের কথা থাকলেও অনেক সময় বছরে একবারও পরিদর্শনে যাওয়া হয় না। দুই ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ, লাইনচ্যুত ও লেভেল ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা ছাড়াও অবহেলায় ট্রেনে কাটা পড়ে লোকের মৃত্যু তো আছেই। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যুর ঘটনা পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, অধিকাংশই ঘটেছে অসচেতনতার কারণে।
চট্টগ্রাম রেলওয়ে পুলিশ সুপার মোহাম্মদ হাছান চৌধুরী আজাদীকে বলেন, ট্রেনে কাটা পড়ার প্রধান কারণ অসচেতনতা। দ্বিতীয়ত রেলের অভ্যন্তরীণ কিছু সংকট রয়েছে, যেগুলো সমাধানের চেষ্টা চলছে। কিন্তু মানুষ সচেতন হলে এ ধরনের দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যু অনেকাংশে রোধ করা সম্ভব হবে। আমরা বিট পুলিশিংয়ের মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। প্রতি মাসেই রেললাইন থেকে উদ্ধার হচ্ছে লাশ। কখনো ট্রেনে কাটা পড়ে মরছে মানুষ, কখনো ট্রেনের ধাক্কায় ছিটকে পড়ে হচ্ছে মৃত্যু। আবার কখনো মৃত্যুর কারণ থাকে অজ্ঞাত। রেললাইনের পাশে পড়ে থাকে মৃতদেহ। রেলওয়ে পুলিশের (জিআরপি) হিসেবে, বছরে তিন শতাধিক লাশ উদ্ধার হয় রেললাইন থেকে, যার বেশিরভাগই দুর্ঘটনা বলে প্রমাণিত হয়েছে। গত ৩১ অক্টোবর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) শাটল ট্রেনের নিচে কাটা পড়ে বালুছড়া এলাকায় ১০ বছরের এক শিশু মারা গেছে। ষোলশহর রেলস্টেশনের ইনচার্জ মো. ফখরুল বলেন, ট্রেনের ছাদে থাকা শিশুটি এক বগি থেকে অন্য বগিতে লাফিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করার সময় নিচে পড়ে কাটা পড়ে মারা যায়। ৩০ অক্টোবর নগরের কদমতলী রেলগেট এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয়গামী শাটল ট্রেনে কাটা পড়ে মনুজা বেগম (৭০) নামে এক ভিক্ষুকের মৃত্যু হয়। ৯ অক্টোবর জোরারগঞ্জে ট্রেনে কাটা পড়ে অজ্ঞাতনামা (২২) এক যুবকের মৃত্যু হয়। ৫ অক্টোবর হাটহাজারীর মীরেরহাট ইউনিয়নের আলমপুর এলাকায় ট্রেনের ধাক্কায় আব্দুস সোবহান (৭৫) নামে এক বৃদ্ধ মারা যান। বন্ধুদের সাথে ঘুরতে এসে সীতাকুণ্ড রেলস্টেশনে ট্রেনে কাটা পড়ে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। এ সময় আরও দুজন আহত হয়। ৯ সেপ্টেম্বর সকালে সীতাকুণ্ড রেলস্টেশনে ট্রেনের ধাক্কায় তিনি মারা যান।
এদিকে রেলের দুরবস্থা নিয়ে সংসদে আলোচনা হয়েছে একাধিকবার। ব্রিটিশ আমলের রেলসেতু, মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন কোচ, জরাজীর্ণ রেললাইন ও লোকবলের ঘাটতি নিয়ে কথা হয়েছে। রেলওয়ের একাধিক প্রকৌশলী বলছেন, রেললাইনকে যত্ন করে রাখতে হয়। রেলপথে পর্যাপ্ত পাথর থাকবে এবং কোনো অবস্থাতে একটি স্লিপারও ক্লিপ কিংবা হুকবিহীন থাকবে না। কিন্তু স্বাধীনতার পর রেলপথ পাথরশূন্য হতে শুরু করে। স্লিপার নড়বড়ে, এর সঙ্গে ক্লিপ-হুক ও ফিশপ্লেট খোলার হার বাড়ছে। এখন যেসব পাথর দেয়া হয়, তা নিম্নমানের। প্রভাবশালী ঠিকাদারদের হস্তক্ষেপ থাকায় এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে কথা বলা যায় না। অপরদিকে ট্রেনের সিডিউল ঠিক রাখতে ‘নিয়ন্ত্রণাদেশ’ অমান্য করে ট্রেন চালানোর কারণেও ঘটছে দুর্ঘটনা।
জানা গেছে, দেশের প্রায় ৩ হাজার ৩৩২ কিলোমিটার রেলপথের বিভিন্ন স্থানে প্রায় সময় খোলা থাকে ফিশপ্লেট, ক্লিপ, হুক, নাট-বল্টুসহ অন্যান্য যন্ত্রাংশ। এমনকি রেললাইন মজবুত ও স্থিতিশীল রাখতে স্থাপিত স্লিপারগুলোর অবস্থাও নাজুক। আবার এসব স্লিপারকে যথাস্থানে রাখতে যে পরিমাণ পাথর থাকা প্রয়োজন অধিকাংশ স্থানে তা নেই। কোনো কোনো স্থানে পাথরশূন্য অবস্থায় আছে স্লিপারগুলো।
সারা দেশে আছে ৩ হাজার ৬টি রেল সেতু, যার ৯০ শতাংশ তৈরি হয়েছে ব্রিটিশ আমলে। জোড়াতালি দিয়ে সচল রাখা হয়েছে সেতুগুলো। এগুলোর উপর দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে চলছে বিভিন্ন রুটের ট্রেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, পুরো রেলপথে প্রতি বছর ২২ লাখ ঘনফুট পাথর প্রয়োজন হলেও দেয়া হচ্ছে ১০-১২ লাখ ঘনফুট। রেলপথে পূর্ণ মাত্রায় পাথর দিতে এক বছরে খরচ হয় ৩৩ কোটি টাকা। সেখানে রেলওয়ের লাইনচ্যুত বগি ও ইঞ্জিন উদ্ধার এবং লাইন মেরামতে প্রতি মাসে খরচ করছে ৮ কোটি টাকারও বেশি, যা বছরে দাঁড়ায় শত কোটি টাকা।
রেল দুর্ঘটনা নিয়ে কথা হয় রেলের চালক, গার্ড ও মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে। তারাও দুর্ঘটনার জন্য ব্রিটিশ আমলের ইঞ্জিন, বগি ও ব্রিজকে দায়ী করছেন। তারা বলছেন, রেললাইনে পাথর না থাকা, সিগন্যাল ব্যবস্থার ত্রুটি, লাইন ক্ষয়, স্লিপার নষ্ট, লাইন ও স্লিপার সংযোগস্থলে লোহার হুক না থাকার কারণে ঘটছে দুর্ঘটনা। লাইনে নির্ধারিত দূরত্বের মধ্যে (প্রায় ৪০-৫০ ফুট) পয়েন্ট রয়েছে। এসব পয়েন্টের মধ্যে দুই পাশে ৮টি করে মোট ১৬টি নাটবল্টুসহ ১৬টি হুক, ক্লিপ থাকার কথা। কিন্তু দেখা গেছে অধিকাংশ পয়েন্টের মধ্যে ১৬টির স্থলে ৫-৭টি রয়েছে।
তারা বলেন, প্রতিদিন ৩ বার করে লাইন, সিগন্যাল ও ব্রিজ পরিদর্শন করা ছাড়াও ট্রেন ছাড়ার পূর্বে ইঞ্জিন ও প্রতিটি বগির বিশেষ বিশেষ যন্ত্রাংশ ও চাকা চেক করার কথা। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। এদিকে প্রতি বছরই বিভিন্ন রুটে নামছে নতুন নতুন আন্তঃনগর ট্রেন। কিন্তু সবকিছু এক রকম নিস্ফল করে দিচ্ছে জরাজীর্ণ রেললাইন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅবশেষে বাংলাদেশের মালদ্বীপ জয় ফুরালো দেড় যুগের অপেক্ষা
পরবর্তী নিবন্ধপলাতক আসামি তারেকের চক্রান্ত শেষ হচ্ছে না : প্রধানমন্ত্রী