নিরাপদ ও বিষমুক্ত খাদ্যের ব্যবস্থা চাই : চাই সচেতনতা

রেজাউল করিম স্বপন | বৃহস্পতিবার , ১১ নভেম্বর, ২০২১ at ৮:১৬ পূর্বাহ্ণ

সমপ্রতি আমার পরিচিত একজন ক্যানসার চিকিৎসার জন্য ভারতের টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতালে গিয়েছিলেন। সেখানে বাংলাদেশী রোগীর আধিক্য দেখে ভারতীয় এক ডাক্তার তাঁকে জিজ্ঞেস করেছেন, আচ্ছা বলুনতো আপনাদের দেশের মানুষ কী খায়? এতো ক্যানসার রোগী কেন? উনি কোনো উত্তর দিতে পারেন নি। তবে আমি হলে বলতাম, খাদ্য হিসাবে আমরা প্রতিদিন যা খাই তার প্রায় সবটাই বিষ। বিশ্বে আমরাই একমাত্র দেশ যারা ভাল ও নিরাপদ খাদ্যকে বিষে রূপান্তর করে খাই। সেটা চাল, ডাল, তেল, নুন, মাছ, মাংশ, শাকসব্জি থেকে শুরু করে সবকিছু। এর প্রমাণ পাওয়া যায় সমপ্রতি ‘বারি’ পরিচালিত চারটি গবেষণায়। আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকীতে ডিসেম্বর’ ২০-অগাস্ট’ ২১ এর মধ্যে এই গবেষণার ফলগুলো প্রকাশিত হয়। এ সাময়িকী গুলো হলো ‘জার্নাল অব ফুড কম্পোজিশন এন্ড এনালাইসিস, ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব এনভায়রনমেন্টাল এন্ড এনালিটিক্যাল কেমিস্ট্রি এবং জার্নাল অব দ্য সায়েন্স অব ফুড এন্ড এগ্রিকালচার। গবেষণায় দেখা যায়, প্রতিদিন আমরা যেসব সব্জি খাই যেমন বেগুন, ফুলকপি, শিম ও বরবটির নমুনার ১১-১৪ শতাংশের মধ্যে মানব দেহের জন্য ক্ষতিকর মাত্রায় রাসায়নিক কীটনাশকের উপস্থিতি রয়েছে। এছাড়া আম, পেয়ারা, পানেও ক্ষতিকর মাত্রায় কীটনাশকের উপস্থিতি পাওয়া যায়। অর্থাৎ প্রতিদিন আমরা ক্ষতিকর মাত্রার কীটনাশক ও রাসায়নিক সমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণ করছি। রাসায়নিক কীটনাশক প্রয়োগের নিয়ম হলো এটি প্রয়োগের পর একটি নিদিষ্ট সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।
এর আগে খেলে মানব দেহে নানা রোগব্যাধি সৃষ্টি করে। কিন্তু আমরা সকালে কীটনাশক প্রয়োগ করে বিকালে বাজারজাত করি। কারণ কীটনাশক প্রয়োগ করে সাথে সাথে বাজারজাত করলে তা দীর্ঘক্ষণ সতেজ ও তরতাজা থাকে। বর্তমানে ব্যবহৃত বেশির ভাগ জনপ্রিয় রাসায়নিক কীটনাশক উন্নত বিশ্বে পর্যায়ক্রমে নিষিদ্ধ করা হচ্ছে মানবদেহে দীর্ঘ মেয়াদি ক্ষতির জন্য। অন্যদিকে ভেজাল ও পচা বাসি খাবার, অতিরিক্ত সার, কীটনাশক ব্যবহারে উৎপাদিত কৃষিজাত খাবার, কৃত্রিম রংসহ নানা ধরনের রাসায়নিক মিশ্রিত ফলমূলসহ নানা ধরনের খাবার স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর জেনেও এগুলোর উৎপাদন, বিপণন ও গ্রহণের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেই। ফলে জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি দিনদিন বেড়ে চলেছে। এছাড়া শিল্পজাত খাদ্যদ্রব্যে ক্ষতিকর রং, রাসায়নিক, ফল পাকানোর জন্য কার্বাইড এবং ফলমূল, শাকসবজি, মাছ প্রভৃতি পচনশীল খাবারের পচন ঠেকানোর জন্য ফরমালিনের ব্যাপক ব্যবহার জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকির সৃষ্টি করছে।এর ফলে ফুসফুসের কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়ে শ্বাসকষ্ট, হাঁচি, অ্যাজমা, ক্ষুধামন্দা, অরুচি, বদহজম, ডায়রিয়া, চর্মরোগ, আলসার, লিভার সিরোসিস, অন্ধত্ব,ত্বক-চোখের জ্বালাপোড়া ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দিচ্ছে। রাসায়নিক পদার্থ লিভার, কিডনি, হার্ট, ব্রেন সব কিছুকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। ফলে স্মৃতিশক্তি লোপ পাচ্ছে ও রক্তশূন্যতা, পাকস্থলী, ফুসফুস, শ্বাসনালিতে ক্যান্সার ও রক্তে ক্যান্সার হচ্ছে। রক্তের এসিডিটি বাড়ছে, কিডনি, লিভার ও বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নষ্ট ও বিকলাঙ্গ হচ্ছে। শিশুদের শারীরিক বৃদ্ধিসহ মস্তিষ্কের বিকাশও থেমে যাচ্ছে। এমনকি মস্তিষ্ক সম্পূর্ণ নষ্ট হওয়ার আশষ্কাও থাকে। অন্য দিকে পোলট্রি ও মৎস্যশিল্পের প্রসারে জন স্বাস্থ্যের ঝুঁকি বেড়ে গেছে। এই দুটি শিল্পে ব্যবহারের জন্য যেসব খাদ্য উৎপাদন করা হচ্ছে, সেগুলোতে স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর কাঁচামাল ও উপাদান ব্যবহার করা হচ্ছে। শুটকিকে পোকার আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য শক্তিশালী কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। অন্যদিকে চামড়াশিল্পে প্রায় ২০ ধরনের রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়। যেগুলো মাটি ও পানিকে বিষাক্ত করে তোলে। সেসব বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থমিশ্রিত ট্যানারি ও শুটকি বর্জ্যে তৈরি খাবার দেওয়া হচ্ছে মাছ ও মুরগিকে। অন্যদিকে দ্রুত বর্ধনের জন্য পোল্ট্রিশিল্পে ব্যবহার করা হয় বলবর্ধক স্ট্ররয়েড, যার ফলে বয়লার মুরগী সবসময় ঝিমাতে থাকে, ঠিক মত দাঁড়াতে ও হাঁটতে পারে না। এসব মুরগী খেলে স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। শুধু মাছ, মুরগী, শাক সব্জি, ফল মূল নয় আমাদের খাদ্য তালিকায় থাকা সব পণ্যেই ক্ষতিকর উপাদান ব্যবহার করা হয়। মাছকে টাটকা ও অধিক সময় প্রিজার্ভ করার জন্য দেওয়া হয় ফরমালিন। মুড়িকে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশী ফুলার জন্য দেওয়া হয় ইউরিয়া। চানাচুর ও জিলাপিকে ভাজা হয় পোড়া তেল, পোড়া মবিল দিয়ে, যেন বেশী ক্রিসপি ও দীর্ঘ সময় মচমচে থাকে। গরুর দুধে মিশানো হয় পানি, গুঁড়া দুধ, ময়দা, পামওয়েল ইত্যাদি ও বেশীক্ষণ সংরক্ষণ করার জন্য দেওয়া হয় ফরমালিন। ঘি, মাখন তৈরীতে ব্যবহার করা ডালডা, বনস্পতি, একধরনের আইকা ও এসেন্স। মিষ্টি তৈরীতে ব্যবহার করা হয় ফরমালিন যাতে মাছি না বসে ও স্বাভাবিক পরিবেশে রাখার পরেও টক না হয়। আখের গুড় তৈরীতে দেওয়া হয় হাইড্রোজ যাতে গুড় স্বাভাবিক রঙের চেয়ে বেশি সাদা ও পরিষ্কার হয়। কলা পাকাতে দেওয়া হয় কার্বাইড ও কৃত্রিম হরমোন। বিভিন্ন ফলে দেওয়া হয় ফরমালিন ও হরমোন, যাতে স্বাভাবিক তাপমাত্রায় অনেকদিন সতেজ, তরতাজা থাকে ও না পঁচে। আপেল আংগুরে দেওয়া হয় ফরমালিন যাতে মাছি না বসে ও আপেল কাটার পর খণ্ডিত অংশ লাল না হয়। চাউলে দেওয়া হয় ইউরিয়া স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি পরিষ্কার ও সাদা করার জন্য। আবার চিকন চাউলের চাহিদা ও দাম বেশি হওয়ায় মোটা চাউলকে হলার দিয়ে কেটে সরু করে পলিশের নামে ইউরিয়া মিশিয়ে মসৃন চকচকে ও আর্কষণীয় করা হয়।গরুকে মোটাতাজা করার জন্য দেওয়া হয় স্ট্রোরয়েডের ইনজেকশন। দইয়ের উপরের অংশ সরে দেওয়া হয় টিস্যু পেপার। যে সব ভোগ্যপণ্যে মেয়াদ দেওয়া থাকে সেগুলোর মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেলে আবার মেয়াদ দিয়ে রিপ্যাকিং করা হয়। আরো ভয়াবহ হলো মেয়াদ উত্তীর্ণ কাঁচামাল দিয়ে তৈরী করা হয় ওষুধ। অন্যদিকে গত কয়েক বছরে দেশে হোটেল, রেস্তোরাঁ ও ফাস্ট ফুডের দোকানে সয়লাব হয়ে গেছে। তরুনদের মধ্যে জাংক ফুড, ফাস্ট ফুড ও হোটেল রেস্তোরাঁয় খাবার প্রবণতা বেড়ে গেছে। ঐসব খাবার তৈরিতে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর টেস্টিং সল্ট, বীট লবণ ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। ফলে তরুণদের মধ্যে রোগের আধিক্য বেড়ে গেছে। বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য মতে, বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৪৫ লাখ লোক খাদ্যে বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন জটিল রোগে ভুগছে। মুশকিল হলো ভেজাল খাবারের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয় খুব ধীরে ধীরে। ভেজাল খাবারের ফলে আমাদের অজান্তেই দেহে বাসা বাঁধে নানা মরণব্যাধি। তবে দেশে খাদ্যে ভেজাল রোধে-১৯৫৯ সনের বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশ ও নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩ অনুযায়ী খাদ্যে ভেজাল ও ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য মেশানোর অপরাধে বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তির বিধান রয়েছে। কিন্তু শুধু আইন দিয়ে এর সমাধান করা যাবে না। ভেজাল খাবার রোধের জন্য মানুষের সচেতনতা খুবই জরুরি। এ ক্ষেত্রে সংবাদ মাধ্যম, সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও সচেতন মহলকেই এগিয়ে আসতে হবে। মানুষকে বোঝাতে হবে ভেজালের ব্যাপ্তি ও পরিণতি এবং এগুলো থেকে বেঁচে থাকার পথ। একই সঙ্গে জরুরি ভিত্তিতে এর বিরুদ্ধে সরকারসহ দলমত নির্বিশেষে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। মনে রাখতে হবে দেশে নিরাপদ ও বিষমুক্ত খাদ্যের ব্যবস্থা না করতে পারলে যতবড় নেতা বা আমলা হই না কেন, কেউ এর বিষক্রিয়া থেকে রক্ষা পাব না।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক

পূর্ববর্তী নিবন্ধজাতির পিতা
পরবর্তী নিবন্ধকাল আজকাল