কাল আজকাল

কামরুল হাসান বাদল | বৃহস্পতিবার , ১১ নভেম্বর, ২০২১ at ৮:১৭ পূর্বাহ্ণ

মনের অসুখের খবর তো
কেউ রাখে না

মহামারীতে মৃত্যুর সংখ্যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতো পাঁচ মিলিয়ন পেরিয়ে গেছে। তবে অনেকে দাবি করেন এই সংখ্যা আরও বেশি হবে। কারণ প্রায় প্রতিটি সরকারই মহামারীতে মৃত্যুর সঠিক পরিসংখ্যান কখনো দেয়নি। যেমন, করোনা ভাইরাসের উৎপত্তি যেখানে, অর্থাৎ চীনের উহানে, সেখানে করোনায় মাত্র সাড়ে তিন হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছিল বলে চীন দাবি করেছিল এবং এই তথ্যটিই তারা প্রকাশ করেছিল। কিন্ত মহামারীর ভয়াবহতা এবং মৃত্যুহার দেখে চীন সরকারের সে তথ্য সঠিক ছিল বলে মনে করার প্রয়োজন নেই। করোনায় আক্রান্ত হয়ে সরাসরি মৃত্যুর সংখ্যা থেকে কভিড পরবর্তী নানা জটিলতায় মৃত্যুর সংখ্যাও কম নয়। এ ধরনের মৃত্যুর খবর সবসময় সরকারি হিসেবে দেখানো হয়নি।
সামনে কী পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে জানি না তবে বর্তমানে সংক্রমণ ও মৃত্যু কমছে দেশে ও বিশ্বের অন্যান্য দেশে। এই মহামারী হয়ত নিয়ন্ত্রণে আসবে। একদিন সবকিছু স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যাবে তবে এই মহামারীর অভিঘাত রয়ে যাবে মানুষের জীবনে। এই অভিঘাত সবচেয়ে বেশি লেগেছে মানুষের মনোজগতে। শারীরিক অসুস্থতার চেয়ে করোনায় মানসিক অসুস্থতার সংখ্যা কম নয়। উন্নত বিশ্বের অধিবাসীরা স্বাভাবিক সময়েও মনোবিদ বা মনোচিকিৎসকদের শরণাপন্ন হতেন। এটি তাদের নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষার অংশই ছিল। বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে শারীরিক অসুস্থতার চিকিৎসাসেবাই যেখানে সীমিত সেখানে মানসিক অসুস্থতার জন্য চিকিৎসা নেওয়া দূরে থাক মানসিক চিকিৎসারও দরকার এটাই অনুধাবন করে খুব অল্প সংখ্যক লোক। মানসিকরোগ বা সমস্যাকে এখনো জিন-ভূতের আছর বলে মনে করা হয়। তাদের চিকিৎসাও করা হয় অত্যন্ত নির্মম-নির্দয়ভাবে। যে কারণে রোগী মৃত্যুবরণও করে থাকে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের প্রতিবেদন অনুসারে বাংলাদেশে মানসিক রোগের প্রাদুর্ভাব ১৭ শতাংশ, যার তুলনায় যোগ্যতাসম্পন্ন মানসিক স্বাস্থ্য পেশাজীবীর সংখ্যা ভয়াবহভাবে কম। বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্য পেশাজীবীদের মধ্যে আছেন সাইকিয়াট্রিস্ট (মানসিক বা মনোরোগ চিকিৎসক), ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ও কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট এবং অন্যান্য মানসিক স্বাস্থ্যসেবা কর্মী আছেন। তুলনামূলকভাবে অনেক কম ও শহরকেন্দ্রিক চিকিৎসাব্যবস্থা হওয়াতে মানুষ প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা নিতে পারে না।
আমাদের মতো দেশে আমরা রোগ বলতে শারীরিক রোগকেই বুঝি। মানসিক রোগেরও যে চিকিৎসার দরকার সে প্রয়োজনটি আমরা অনেক সময় অনুধাবন করি না, গুরুত্ব প্রদান করি না। খুব সাধারণভাবে দেখলেও আমরা বুঝতে পারব, শারীরিক কোনো রোগের কারণে মানসিক সমস্যাও দেখা দিতে পারে। কিংবা মানসিক সমস্যার কারণেও অনেক সময় শারীরিক সমস্যা তৈরি হতে পারে। আমাদের অনেক শারীরিক রোগের কারণ হচ্ছে মানসিক অসুস্থতা। অর্থাৎ মনের রোগে আমরা শারীরিক অসুস্থতায় পতিত হচ্ছি।
মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার নানা রূপ ও স্তর আছে। মানসিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি মাত্রই কিন্তু পাগল নন। অনেককে দেখে এবং প্রাথমিকভাবে মেলামেশা করেও বোঝা যায় না তার মানসিক অসুস্থতার বিষয়টি। বছর তিনেক আগে ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর সেন্ট্রাল হেলথের (ডব্লিউএফএস এইচ) ‘কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে উল্লেখ করা হয়েছে কর্মক্ষেত্রে প্রতি পাঁচজনে একজন মানসিক সমস্যায় ভোগেন। আর তাঁদের মধ্যে গুরুতর মানসিক অসুস্থতার জন্য ৮০ শতাংশ কাজ হারান। এসব মানুষ অনুপস্থিতি কর্মদক্ষতা হ্রাস, কাজে কম মনোযোগ, সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব এবং ভুলে যাওয়া সমস্যায় ভোগেন।
বেশ কয়েক বছর আগে একটি বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানি বিজ্ঞাপন দিয়েছিল “বিষণ্‌নতা একটি রোগ।” তখন অনেকেই বিষয়টি কোম্পানির ওষুধ বিক্রির কৌশল হিসেবে সমালোচনা করেছিলেন। অথচ এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে কর্মক্ষেত্রে ১০ শতাংশ কর্মী কেবল বিষণ্নতার কারণে যথাযথভাবে তাঁদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হন। তাঁদের মধ্যে ৯৪ শতাংশই কাজে মনোযোগ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও ভুলে যাওয়া সমস্যায় ভোগেন। এতে একজনের গড়ে ৩৬ কর্মদিবস নষ্ট হয়। ডব্লিউএফএসএইচ বলছে ‘মানসিক চাপের কারণে কর্মক্ষেত্রে কর্মীদের উপস্থিতি ও কর্মদক্ষতা কমে যায়। এতে আর্থিক ক্ষতি হয়। বিশ্বব্যাপী কর্মীর কর্মদক্ষতা বাড়াতে নানা নীতি গ্রহণ করা হলেও তাতে মানসিক স্বাস্থ্য গুরুত্ব পায় না। উন্নত বিশ্বে প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে গড়ে প্রায় ১০ শতাংশ কর্মী কেবল বিষণ্‌নতার কারণে যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারে না। কিন্তু এদের ৫০ শতাংশই চিকিৎসাসেবা নেন না।
বাংলাদেশে ঢাকা-চট্টগ্রামের মতো কিছু শহরে মানসিক স্বাস্থ্য চিকিৎসার সুবিধা পাওয়া গেলেও অন্যান্য স্থানে বা প্রত্যন্ত এলাকায় এই সুবিধা অত্যন্ত সীমিত। অর্থাৎ বিশাল জনগোষ্ঠী এই সুবিধা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত। বরঞ্চ এসব ক্ষেত্রে পূর্ব সংস্কার, কুসংস্কার এবং অজ্ঞতা এই সমস্যাকে প্রকট করে তুলছে। অনেকে এজন্য ঝাড়ফুঁক, কবিরাজী, তাবিজ, পানিপড়া, তেলপড়া ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে। দেশের অনেক রোগী বা তাদের স্বজনরা ধর্মীয় ও সনাতন পদ্ধতির চিকিৎসা গ্রহণ করে থাকেন। এই ধরনের রোগের চিকিৎসা করতে গিয়ে গ্রাম্য বৈদ্য বা মোল্লারা অনেকের মৃত্যুর কারণও হয়েছেন।
মানসিক বিষণ্নতা ছাড়াও মানসিক রোগের আরও প্রকারভেদ আছে। যেমন মানসিক প্রতিবন্ধী। মস্তিষ্কের ত্রুটিপূর্ণ বিকাশের ফলে সৃষ্ট অবনমিত বুদ্ধিমত্তা। এতে শৈশবকাল থেকেই বুদ্ধিমত্তার অভাব, বেড়ে ওঠার সময়কালে স্বল্প ও মন্থর মানসিক বিকাশ, খর্বিত শিক্ষণক্ষমতা এবং দুর্বল আচরণগত ও সামাজিক অভিযোজ্যতা দেখা দিতে পারে। এটি একটি স্থায়ী প্রতিবন্ধীতা, কিন্তু কোনো রোগ নয়। মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের ভাষাগত, দক্ষতা অত্যন্ত দুর্বল এবং বিচার বিবেচনার ক্ষমতায়ও বিকেশিত হয় না।
আরেকটি স্তর হচ্ছে সিজোফ্রোনিয়া। উদ্ভট চিন্তা, ভগ্নমনস্কতা, সামঞ্জস্যহীন আচরণ এবং আবেগ প্রবণতা ও বুদ্ধিমত্তার অবনতি এমন উপসর্গ প্রদর্শনকারী এক ধরনের মনোবিকার। বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি মানসিক হাসপাতাল ও চিকিৎসাকেন্দ্রে ভর্তিকৃত অধিকাংশ রোগীই সিজোফ্রোনিয়ায় আক্রান্ত। এছাড়া, বিষণ্নতা, অ্যাংজাইটি, বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডার, সিজোফ্রেনিয়া, সাইকোসিস ডিজঅর্ডার, সাবস্টেন্স অ্যাবিউজ, ওসিডি, হেলথ অ্যাংজাইটি, পোস্ট ট্রমাটিক ট্রেস ডিজঅর্ডার, প্যানিক অ্যাটাক, ফোবিয়া, কনভারশন ডিজঅর্ডার, পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডারেও অনেকে আক্রান্ত। একটি সূত্রমতে, দেশের প্রায় তের লাখের বেশি লোক সিজোফ্রেনিয়া ধরনের রোগে ভুগছে।
সমপ্রতি আত্মহত্যা প্রবণতা উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে, বিশেষ করে কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীদের মধ্যে। বেসরকারি এক জরিপে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে আত্মহত্যাকারীর মধ্যে ১১ শতাংশ কিশোর বয়সী। জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ বলছে, করোনাভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারির কারণে দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ও ঘরে বন্দি থাকার বিশেষ প্রভাব পড়েছে শিশু-কিশোরদের ওপর। তার ওপর আছে সামাজিক ও পারিবারিক বিভিন্ন কারণ। শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কারণে বাংলাদেশের মানুষ যেখানে নিজের মনের খবরই রাখে না সেখানে সন্তান-সন্ততি বা স্বজনদের মনের খবর রাখবে কীভাবে? এদেশের অধিকাংশ মানুষ তো জানেই না শরীরের মতো মনেরও অসুখ হতে পারে। সমপ্রতি প্রকাশিত আরেকটি সমীক্ষায় বলা হয়েছে, করোনা মহামারি শুরুর পর ২০২০ সালের ৮ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ৮ মার্চ পর্যন্ত, সর্বমোট আত্মহত্যা করেছে ১৪ হাজার ৪৩৬ জন। এর মধ্যে ৩২২টি কেস স্টাডিতে দেখা যায়, আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে ৪৯ শতাংশই তরুণ-তরুণী, যাদের বয়স ২০ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। অর্থাৎ জনসংখ্যার বিশাল একটি অংশ কোনো না কোনোভাবে মানসিক সমস্যা বা রোগে ভুগছে।
মনে রাখতে হবে, মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার জন্য রোগী নিজে দায়ী নয়। বিভিন্ন কারণে যে কোনো ব্যক্তি মানসিক রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে আমার পাশের মানুষটির প্রতি খেয়াল রাখা। তার আচরণ লক্ষ করা এবং প্রয়োজনে তার দিকে সাহায্যের হাত প্রসারিত করা। এমন পরিস্থিতিতে রোগী নিজে বুঝতে পারেন না তার সমস্যাগুলো। ফলে পরিবারের সদস্য, বাবাুমা, বন্ধুুস্বজন ও কর্মক্ষেত্রের সহযোগীদের উচিত এ বিষয়ে এবং এ সমস্যা উত্তরণে সাহায্য করা। অবহেলা কিংবা উপেক্ষা পরিস্থিতি জটিল করে তোলে।
কভিড-১৯ মহামারী-উত্তর বিশ্বের অনেককিছু পাল্টে যাবে। মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থা, জীবনযাপন, কাজের ধরন। মানুষ সে পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেবে হয়ত। কিন্তু এই মহামারী মানুষের মনোজগতের যে ক্ষতি করে দিয়ে যাচ্ছে তা পূরণ হতে অনেক সময় লেগে যাবে। আমরা বুঝতেই পারছি না হয়ত আমি নিজেই খুব স্বাভাবিক আচরণ করছি না কিংবা পাশের বা খুব কাছের মানুষটি কেন হঠাৎ অন্য আচরণ করছে।
মহামারীর শুরুতে ধারণা করেছিলাম, পৃথিবী বদলে যাবে। মানুষে মানুষে সমপ্রীতি, ভালোবাসা, সহমর্মিতা বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু বাস্তবে ঘটছে উল্টো। মহামারীকালে মানুষে মানুষে কলহ-বিভেদ বেড়েছে, হিংসা-ঘৃণা বেড়েছে। দেশে-দেশে যুদ্ধবিগ্রহ, জাতিতে-জাতিতে হানাহানি বেড়েছে। বেড়েছে পারিবারিক অশান্তিও। বোঝা যাচ্ছে মহামারী মানুষের মনোজগতে নেতিবাচক প্রভাবই ফেলেছে বেশি। ফলে কভিডোত্তর আগামী দিনগুলো খুব ভালো যাবে না, যদি না আমরা মানবিক ও শান্তিময় একটি বিশ্ব প্রতিষ্ঠার দিকে মনোনিবেশ না করি। কিন্তু সমস্যাটি হচ্ছে সে উদ্যোগটি নেবে কে?
লেখক : কবি-সাংবাদিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধনিরাপদ ও বিষমুক্ত খাদ্যের ব্যবস্থা চাই : চাই সচেতনতা
পরবর্তী নিবন্ধগৌরব ও ঐতিহ্যের ৪৯ বছরে যুবলীগ