নিপীড়কের পক্ষেই কি তবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়?

সাদিয়া মেহজাবিন | শনিবার , ২৩ জুলাই, ২০২২ at ৫:৩৫ পূর্বাহ্ণ

গত রোববার ১৭ জুলাই সন্ধ্যার পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন নারী শিক্ষার্থী ৫ জন তরুণের হাতে যৌন হয়রানি ও হেনস্তার শিকার হন। প্রীতিলতা হলের পাশ দিয়ে রাত দশটায় বন্ধুর সাথে হেঁটে যাচ্ছিলেন সে শিক্ষার্থী, তখনই সে ৫ জন তরুণ তাদেরকে হুমকি দিয়ে বোটানিক্যাল গার্ডেনে নিয়ে যায়। তখন তারা শিক্ষার্থীকে বেঁধে বিবস্ত্র করে মুঠোফোনে ছবি ও ভিডিও ধারণ এবং মারধোর করে। ভুক্তভোগীর বন্ধু প্রতিবাদ জানাতে চাইলে, তাকেও মারধর করে। পরবর্তীতে তাদের দ’ুজন থেকে মুঠোফোন ও মানিব্যাগ নিয়ে ছেড়ে দেন।
সম্পূর্ণ ঘটনাটি ঘটার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নেননি। ভুক্তভোগী মৌখিক ও লিখিত অভিযোগ জানানোর পরেও বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান পরিবর্তন হয়নি। বরং বিশ্ববিদ্যালয় সান্ধ্য আইনের নির্দেশ দেন, অর্থাৎ রাত দশটার পরে বাইরে থাকা নিষেধ।
এ পুরো ঘটনাটি মাছি আসে বলে খাবার ঢেকে রাখার মতোই কি নয়?
সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়ে নানান জায়গা থেকে, বিচিত্র মনমানসিকতার শিক্ষার্থীরা আসে। ফলে কেবল যে সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন হয় তা নয়, সাথে সাম্যতাও শেখে শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো উচ্চশিক্ষা লাভের স্থানে সাম্যের ধারণার ছিটেফোঁটা না নিয়ে যদি শিক্ষার্থীরা কেবল কেজির দরে বই মুখস্ত করে নিস্তার হয় তাহলে কাক হওয়া ছাড়া উপায় নেই। কেননা আমরাও ভাবছি এগারো শ একর এ বিশাল জায়গায় আমাদের কেউ দেখছে না, আমাদের প্রতি অন্যায়ে কীইবা আসে যায়।
হ্যাঁ, বিচলিত হবার কিছু নেই। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন ঘটনা এবারই প্রথম নয়। বিগত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর ক্যাম্পাসের ভেতরেই ছাত্রলীগের চার কর্মীর বিরুদ্ধে দুই ছাত্রীকে হেনস্তার অভিযোগ উঠলে তাদের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেননি। গত জুন মাসেও শাটল ট্রেনে বহিরাগত ব্যক্তিদের দ্বারা দুই ছাত্রী ধর্ষণচেষ্টার শিকার হন। বিশ্ববিদ্যালয়ে এর আগেও এমন বহু ঘটনা ঘটে। সাথে বিচারহীন বিশ্ববিদ্যালয়ে আসামীদের মুক্তভাবে ঘুরে ফেরার কারণে সকলে আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন সমদূর কিন্তু এমতাবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিগত সময়ে কোনো ঘটনার সুষ্ঠু বিচার করতে পারেনি। কিন্তু বিচার না করলেও একদম চুপ করে বসে আছে বললে অন্যায় হবে কেননা সান্ধ্য আইন জারিসহ নানান রকম সাম্রাজ্যবাদী পুরুষতান্ত্রিক আইন আরোপ তারা করেছেন। ক্যাম্পাস এরিয়াতে প্রায় নানান জায়গায় সিসিটিভি ক্যমেরা আছে বলে দাবী করলেও সেগুলো সব সচল নয়। সেগুলো যদি আদতে সচল হতো তাহলে রোববারের ঘটনায় সে যুবকদের অন্তত ২৪ ঘণ্টায় আইনের আওতায় আনা হতো। ঘটনার শিকার শিক্ষার্থী জানাচ্ছে আসামীরা বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্র।
প্রশাসন তাহলে কাদের পক্ষে? প্রশাসন স্পষ্টত নিপীড়ক ও ক্ষমতাসীনের। সান্ধ্য আইনের অর্থ দাঁড়ায় নারী শিক্ষার্থীরা রাতে বাইরে থাকলে এমন হতে পারে, তারা কেন বাইরে যাবে, দোষ মূলত তাদেরই। প্রাচীনকালের সাম্রাজ্যবাদী পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মতোই ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে বিশ্ববিদ্যালয়। নারীকে বন্দী করো, নারীকে খাঁচায় পুরো।
বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে ন্যায়-অন্যায়বোধের মূর্ত প্রতীক হবে, সাম্যের গান গাইবে, আধুনিক-যুক্তিবাদী-বৈজ্ঞানিক পথের যাত্রা করবে সেখানে গোঁড়া পুরুষতান্ত্রিক সাম্রাজ্যের আগ্রাসন তৈরি করছে। এর কারণ কি তবে ক্ষমতাবান আসামীকে রুখতে না পারার ভয়? নাকি আদতে সান্ধ্য আইনের মতো বাদবাকি সকল অন্যায়ের পথপ্রদর্শক হতে চায় বিশ্ববিদ্যালয়?
বলতে পারেন, কোনো মা-বাবা চায় না তার সন্তান খারাপ হোক তাই বলে কি বখে যাওয়া সন্তানকে অন্যায়ের শাস্তি দেন না? তবে একটি ভালো প্রশ্ন হতে পারে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো স্থানে শিক্ষার্থীরা কেন তাদেরই সহপাঠীদের সাথে এমন আচরণ করছেন?
গাদাগাদা নোট-শীট প্রতিনিয়ত গিলে, সিনিয়রদের হাতে র‌্যাগ খেয়ে, ভালো কোনো লেকচারার না পেয়ে, সিজিপিএ নিয়ে দৌড়ে, চাকরি পরীক্ষার পেছনে ছুটে, সামাজিক-মানসিক ক্রাইসিস নিয়ে লাখ লাখ শিক্ষার্থীরা হেনস্তা করাকে বিনোদন হিসেবে নিচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশিরভাগ শিক্ষার্থী নানান কারণে মানসিক অসুস্থতায় ভোগে। মানসিক এ দৈন্যতা দূর করার মতো নেই কোনো কাউন্সিলিং সেন্টার। মানসিক সুস্থতা বজায় রেখে উৎকর্ষতা সাধন তাদের দ্বারা আদৌ কি সম্ভব? তাছাড়া অন্যতম কারণ শিক্ষার্থীদের পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব দিনে দিনে দ্বিগুন হচ্ছে। কথায় আছে, বাঙালি সুযোগের অভাবে সৎ বা ভালো। কেননা সুযোগ দিলে এবং খুঁজলেই দেখবেন বেশিরভাগ শিক্ষার্থী পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব সম্পন্ন। এ শিক্ষার্থীরা তো মায়ের গর্ভ থেকেই এমন ছিল না নিশ্চিত! প্রথমে আমাদের সমাজ পরে বাস্তবচিত্রে তারা একেকটা পুরুষতান্ত্রিক ড্রাগন হয়ে পড়ছে। তাই তো, রাতে কেন মেয়েটা বন্ধু নিয়ে ঘুরছে দেখেই তারা হেনস্তা করলো এবং একে একটি মহৎ কাজ ভেবে মুচকি হাসলো। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এ-সান্ধ্য আইন যেন, সে মহৎ কাজেরই পুরষ্কার ও স্বীকৃতি। চিন্তা করুন, কি পরিমাণে ভয়াবহ মনন তাদের, ধর্ষণ না করে বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করেছে যেন এসব দেখিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে সুবিধা নিতে পারে।
এতসবের মাঝে ভুক্তভোগীর সাথে একেরপর এক অন্যায় হয়ে চলেছে। সুষ্ঠু বিচার না হওয়ার ফলে কি পরিমাণ অসহ্য মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছে সে শিক্ষার্থী। নিরাপত্তাহীন পরিবেশে তার পক্ষে কোনো পদক্ষেপ নেওয়াও কঠিন। ভুক্তভোগীর সাহায্য দূরে থাক বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নিপীড়ন পরবর্তী মানসিক কাউন্সিল সেন্টার ও সেল নেই যে তাকে সেখানে রাখা যাবে নিরাপদে। তবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কতটা শিক্ষার্থীবান্ধব? এক্ষেত্রে দুঃখের দিনে হাস্যরসে বলতে হয়, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরের বছর থেকে নারী শিক্ষার্থী নেওয়া বন্ধ করতে পারে। তাহলে একেবারেই ল্যাঠা চুকে গেলো। যে-বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলে না, অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়, আসামীদেরকে অবাধে চলাচলের সুযোগ দিয়ে সান্ধ্য আইনের ব্যবস্থা করে, সাম্যের পাঠ দেয় না, নিরাপত্তা না দিয়ে কেবল প্রতিশ্রুতি দিতে পারে সে-বিশ্ববিদ্যালয় আর যাই হোক আমাদের নয়। তাহলে একুশশত একরের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কাদের?

পূর্ববর্তী নিবন্ধবর্ধিত জনসংখ্যাকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ হিসাবে গড়ে তুলতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধনারীর উন্নয়নই রাষ্ট্রের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে পারে