নারীর উন্নয়নই রাষ্ট্রের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে পারে

কাজী রুনু বিলকিস | শনিবার , ২৩ জুলাই, ২০২২ at ৫:৩৫ পূর্বাহ্ণ

একটা সমতাভিত্তিক সমাজ নির্মাণে আমরা কতটা এগিয়েছি! আর কতটা পথ পাড়ি দিলে একটা ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র গড়ে তোলা যাবে? নারীর জীবনে কতটা পরিবর্তন আনতে পেরেছে দেশের সার্বিক উন্নয়ন ? জীবন কতটা নির্ভয় হয়েছে নাকি চলার পথে আরও বেশি ভয়ের কাটা বিছিয়ে রাখা হয়েছে? এসব প্রশ্নের উত্তর আমরা সবাই খুব ভালো করে জানি। প্রতিদিন রুটিনমাফিক নারী নির্যাতনের খবরগুলো যখন ইলেকট্রনিক মিডিয়া ও খবরের কাগজ ভর্তি হয়ে আমাদের চোখের সামনে আসে তখনই বুঝা যায় বাংলাদেশ কতটা উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে? এখনো গণপরিবহনে গ্যাং- রেপ নিয়মিত ঘটনা। নারীর প্রতি সহিংসতা আমরা সহজভাবে গ্রহণ করেছি। আমাদের সমাজে যারা দুর্বল তাদের ভয় দেখানো হয় শাসন- শোষণ করা হয় তেমনি আমাদের সমাজে শিক্ষিত অশিক্ষিত নারী সবাইকে দুর্বল হিসেবে দেখা হয়। নারীর প্রতি সহিংসতায় শুধু যে সামাজিক ক্ষতি হচ্ছে তা তো নয় অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে, রাষ্ট্রের ক্ষতি হচ্ছে। দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে নারীর কর্মপরিধি বেড়েছে বহু অংশে। বর্তমানে মেয়েদের বাইরে কাজ করার ক্ষেত্র অনেক বেশি। সমাজের সব স্তরে সব ধরনের কাজে যখন মেয়েরা অংশ নিচ্ছে তখন তাকে প্রতিদিন সকালে ঘর থেকে বের হতে হয়। কর্মস্থল ছাড়া ও যখন ভ্রমণে বের হচ্ছেন তখন তাকে কোনো না কোনো গণ পরিবহন ব্যবহার করতে হচ্ছে। সেখানেই সমস্যা! এই গণ পরিবহন কখনও নারীবান্ধব নয়। অযাচিত স্পর্শ, সেক্সচুয়াল হ্যারাসমেন্ট নারীদের জন্য নির্ধারিত। যে নারীরা আমাদের কর্মশক্তির অর্ধেক সেই নারীদের জন্য নিরাপদ পরিবহনের ব্যবস্থা করা না হয় তারা যদি সহিংসতার ভয় মনের মধ্যে বয়ে বেড়ায় তাহলে নির্বিঘ্নে কাজ করবে কী করে! তাতে দেশের উন্নয়নকে কি বাধাগ্রস্ত করে না? মানুষের জীবনের নিরাপত্তা সরকার কতটা নিশ্চিত করতে পারছে বিশেষ করে সমাজের দুর্বল অংশ নারী ও শিশুর নিরাপত্তা কোন স্তরে আছে সেটা বিবেচনায় আনতে হবে। ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরের জন্য সরকার ৬ লাখ ৭৮হাজার ৬৮ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেছে। বাজেটে জেন্ডার সম্পৃক্ত বাজেটের শতকরা হার ৩৩.৮৪ বা জিডিপির ৫.১৬শতাংশ। সরকারি সেবাপ্রাপ্তিতে নারীর সুযোগ বৃদ্ধিখাতে সর্বোচ্চ ৫২ শতাংশ বরাদ্দ করা হয়েছে। এরপরে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে নারীর ক্ষমতায়ন ও সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির খাত। কিন্তু প্রকৃতিগতভাবে জেন্ডার বাজেট কতটা কাজে লাগছে বা নারীর জীবনযাত্রায় কতটা পরিবর্তন আনতে পারছে সেটাই আমাদের দেখার বিষয়। নারীর ক্ষমতায়ন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা কেবল প্রতিশ্রুতিই যথেষ্ট নয় বরং প্রয়োজন অনুসারে বাস্তবায়নটা জরুরি। বাজেটের কতটা অংশ প্রকৃত উন্নয়নে ব্যয় হচ্ছে তা দেখাও গুরুত্বপূর্ণ। নারীর প্রতি সহিংসতার বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে নিতে হবে। নারীর কর্মক্ষেত্রকে নিরাপদ ও নারীবান্ধব করে তুলতে হবে। নারীদের বিভিন্ন ধরনের ভয় থেকে মুক্ত করতে হবে। নারী সহিংসতা রোধে বাজেট প্রয়োজন। যেহেতু সামপ্রতিক সময়ে নারী অনেক দৃশ্যমান। তাই তিনটি বিষয়ের উপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
১.সহিংসতা থেকে সুরক্ষা ও প্রতিকার
২.মনিটরিং সেল গঠন
৩.নারীর কাজের পরিধি বৃদ্ধি
স্বাস্থ্য, শিক্ষা, অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ ও অংশগ্রহণের সুযোগ এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন এই চার সূচকে নারী ও পুরুষের অংশগ্রহণ সমান হলে বলা যায় একটি সমতাভিত্তিক সমাজ তৈরি হয়েছে। যদিও এমন সমতাভিত্তিক সমাজ পৃথিবীর কোথাও শতভাগ গড়ে ওঠেনি। উন্নত দেশগুলো এই সূচকে এগিয়ে যাচ্ছে। গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট ২০২২ এর হিসেবে যে হারে পৃথিবী হাঁটছে তাতে সমতা অর্জিত হতে ১৩২ বছর সময় লাগবে পৃথিবীর। লিঙ্গ সমতা সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার অবস্থান সবচেয়ে নীচে। অবশ্য করোনা মহামারীও এই সূচককে পিছিয়ে দিয়েছে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন আ্যন্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক তানিয়া হকের মতে পরিবারে বিদ্যমান পুরুষতান্ত্রিকতা সমতার পথে বড় বাধা। তিনি আরও বলেন বাংলাদেশে নারী পুরুষের সমতা অর্জনের লক্ষ্যে কার্যকর ফল পেতে হলে সরকারকে এখন পরিবার কেন্দ্রীক কাজে হাত দিতে হবে। পরিবার থেকে একটি সমতাভিত্তিক রাষ্ট্র পাওয়া সম্ভব। সমতার ভিতগুলোকে টেকসই করতে হবে যেন কোভিডের মতো কোন পরিস্থিতি ভবিষ্যতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ঝরে পড়া, বাল্যবিবাহ বাড়িয়ে তোলা বা অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজের জায়গায় নারীদের অংশগ্রহণ কমিয়ে দিতে না পারে।
দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অবস্থান ভালো। ডব্লিউ এফ এর প্রতিবেদনে সবচেয়ে বেশি জনসংখ্যার ১৫টি দেশের একটি হিসেবে বাংলাদেশের নাম উল্লেখ করে বলা হয়েছে এই দেশগুলোতে বিশ্বের দুই তৃতীয়াংশ নারীর বাস। বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা হয়েছে সামগ্রিকভাবে শিক্ষায় সমতার ক্ষেত্রে আগের চেয়ে কিছুটা অবনতি ঘটেছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সমতা আগের চেয়ে কিছুটা বেড়েছে। সব মিলিয়ে শিক্ষায় আগের বছরের তুলনায় দুই ধাপ নেমে অবস্থান হয়েছে ১২৩তম। রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের অবস্থান ভালো বৈশ্বিকভাবে নবম স্থানে।
নারীর অবস্থান ভালো হলেই কেবল সমাজ এগিয়ে যায়, অর্থনীতি এগিয়ে যায়, জাতি এগিয়ে যায়, রাষ্ট্র এগিয়ে যায়। তখনই হয় সত্যিকারের উন্নয়ন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনিপীড়কের পক্ষেই কি তবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়?
পরবর্তী নিবন্ধহাটহাজারীতে মোটরসাইকেল চোরাই চক্রের ২ সদস্য গ্রেপ্তার