নারী ফুটবলাররাই আমাদের ফুটবল অঙ্গনের শ্রেষ্ঠ সম্পদ

রতন কুমার তুরী | সোমবার , ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ১০:২৯ পূর্বাহ্ণ

কুসংষ্কার, প্রতিকূলতা, সামাজিক বৈষম্য, দারিদ্রতাকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশের অদম্য নারী ফুটবল দল আজ বিশ্বের কাছে তাদের সফল অবস্থানের জানান দিতে সক্ষম হয়েছে। সাথেসাথে সারাবিশ্বে বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করেছে।
পুরো বিশ্বকে অবাক করে দিয়ে সামপ্রতিক বাংলাদেশের নারী ফুটবল দল সাফ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে। এটি বাংলাদেশের জন্য বিশাল অর্জন। সাথে সাথে এটি কোনো আন্তর্জাতিক ফুটবল আসরে বাংলাদেশের প্রথম শিরোপা অর্জন। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ওঠে আসা এই সমস্ত নারী ফুটবলাররা যে উপযুক্ত পরিবেশ এবং যথাযথ ট্রেনিং পেলে ফুটবলে যেকোনো দেশকে হারাতে পারে তা তারা সাফ ফুটবল মিশনে প্রতিটি দলের সাথে বড় বড় ব্যবধানে জয়ী হয়ে প্রমাণ করে দিয়েছে। সত্যি কথা বলতে কী বিগত এক দশক ধরে ফুটবলে তেমন কোনো সাফল্য না থাকায় আমাদের আনন্দ, বেদনা এবং প্রাপ্তির আশা আকাঙ্ক্ষা ছিল মূলত ক্রিকেটকে ঘিরে।
একসময় যে ফুটবল খেলা বাংলাদেশের আনাচে কানাচে দেখা যেতো বেশ কয়েক বছর ধরে সে দৃশ্য তেমন একটা দেখা যায় না বললেই চলে ফলে মানুষ বলতে গেলে কিছুটা ফুটবল বিমুখ হয়ে পড়েছে। মোটকথা বলতে গেলে ফুটবলে দীর্ঘসময় ধরে খরা চলছিল।এই মুহূর্তে নারী ফুটবল দলের সাফ শিরোপা অর্জনের ফলে সে খরা কিছুটা কাটবে বলে প্রত্যাশা করা যায়। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় বেশিরভাগ মানুষ প্রগতিশীলের লেভেল লাগিয়ে রাখলেও এদের মধ্যে অনেকেই নারীদের খেলাধুলায় তেমন আগ্রহী নয় এমন কী যেসব নারীরা নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে বিভিন্ন খেলাধূলায় মত্ত থাকে তাদেরকে উৎসাহ তো দেয়ই না বরং তাদেরকে অনেক সময় সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করতেও কার্পণ্য করেন না। এমন সমাজ ব্যবস্থায় দাঁড়িয়ে আঁখি খাতুন, শিউলি আজিম, রূপনা চাকমা, কৃষ্ণা রানী এবং মারিয়া মান্দাদের একেবারে আন্তর্জাতিক আসরে সাফ ফুটবলের মত দক্ষিণ এশিয়ার একটি বড় শিরোপা অর্জন অন্তত নারীদের জন্য নিঃসন্দেহে আমাদের ঘুনে ধরা আট পৌরে সমাজের জন্য বিশাল অর্জন। এই অর্জনকে ধরে রাখতে হলে বাংলাদেশের নারীদের ফুটবলসহ বিভিন্ন খেলাধূলায় আমাদের সবাইকে সামাজিকভাবে স্বীকৃতিসহ ব্যাপকভাবে উৎসাহ দিতে হবে। সাথে সাথে দিতে হবে তাদের আর্থিক নিরাপত্তা। দেখা যাচ্ছে যে, বাংলাদেশের নারী ফুটবল দলের প্রায় খেলোয়াড়ই একেবারে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ওঠে আসা এদের নেই কোনো আর্থিক সামর্থ্য এবং খেলাধূলার মত অনাবিল পরিবেশ। অনেকের বাসযোগ্য বাড়িও নেই ফলে এমন হতাশাজনক পরিবেশে তাদের এগিয়ে যাওয়া খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার। এই বিষয়টি বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন কর্মকর্তাদের অনেক আগে থেকে দেখভাল করার কথা থাকলেও তা তারা করতে ব্যর্থ হয়েছে। এখন সময় এসেছে বাংলাদেশের নারী ফুটবল দলের সদস্যদের পৃষ্ঠপোষকতা করার কারণ অন্তত আর্থিক দৈন্যতা থেকে তাদের মুক্তি দিতে হবে। দেশের বাইরেও এদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। দেশের গ্রামীণ পর্যায়ে ফুটবল খেলার মাঠগুলোতে আবারও ফুটবল প্রতিযোগিতার আয়োজন করে প্রান্তিক পর্যায় থেকে খেলোয়াড়দের জাতীয় পর্যায়ে তুলে আনার ব্যবস্থা করতে হবে এক্ষেত্রে নারী পুরুষ সবাইকে সমান সুযোগ দিতে হবে। উন্নত বিশ্বের ফুটবলের সাথে তাল মেলাতে বাংলাদেশের নারী ফুটবল দলকে ইউরোপের দেশ সমূহের ক্লাবগুলোতে খেলার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রকৃতপক্ষে যেকোনো খেলায় সফলতার জন্য প্রশিক্ষণের কোনো বিকল্প নেই সেই প্রশিক্ষণ যদি হয় ইউরোপের মত কোনো দেশে তাহলে তো কোনো কথাই নেই। প্রকৃতপক্ষে আমাদের সামাজিক ব্যবস্থায় নারী ফুটবল এখনও অস্পৃশ্য। অথচ নারী ফুটবলের সাফল্য আমাদের দেশে গর্ব করার মতো। নারীর ক্ষমতায়নের স্বার্থে হলেও নারী ফুটবলকে বিকশিত হওয়ার সুযোগ করে দেয়া দরকার। এ জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। ফুটবলকে মেয়েদের জন্য পক্ষপাতমুক্ত হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। এ বিষয়ে সরকারের নীতিনির্ধারকদেরই ভূমিকা রাখতে হবে।
একেবারে নিশ্চিতভাবেই বলা যায় এই নারী ফুটবলাররাই আমাদের ফুটবল অঙ্গনে শ্রেষ্ঠ সম্পদ। ভবিষ্যতে এরাই আমাদের ফুটবলকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। অর্থনৈতিকভাবে সংকটগ্রস্ত সামাজিক-সাংস্কৃতিকভাবে অধঃপতিত এই দেশে নারীরাই বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখায় বিশ্ব ফুটবল অঙ্গনে। নারীরাই জানান দেয় এখন আর ঘরে বসে থাকার সময় নেই, এখন সময় নারী পুরুষ একসাথে এগিয়ে চলার এবং দেশকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরার। আমরা প্রত্যাশা করবো নারী ফুটবল দলের এই জয়ের ধারা ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে এবং সরকারের নীতিনির্ধারকরা এদের অর্থনৈতিক বিষয়টাসহ বিভিন্ন বিষয়ে দেখভাল করবে।
লেখক: কলেজ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশরৎ রূপ
পরবর্তী নিবন্ধআমাদের সময়ের ডা. খাস্তগীর গার্লস হাইস্কুল