নারী গবেষক ও আবিষ্কারক: ‘পেটেন্ট’ বিষয়ক বোঝাপড়া

বিপাশা আইরিন | শনিবার , ৯ অক্টোবর, ২০২১ at ৭:২১ পূর্বাহ্ণ

চলছে ২০২১ সালের জন্য নোবেল পুরস্কার ঘোষণার সপ্তাহ। ৪ অক্টোবর ২০২১ থেকে ১১ অক্টোবর ২০২১ সময়কালে পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসাশাস্ত্র, সাহিত্য এবং শান্তি এই পাঁচটি বিষয়ের উপর দেওয়া হবে এই সম্মাননা। ১৯০১ সালে নোবেল পুরস্কার প্রবর্তিত হওয়ার পর থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ১২০ বছরের ইতিহাসে এই পুরস্কারটি মাত্র ৫৭ জন নারীর হাতে উঠেছে। এরমধ্যে কেবল মারি কুরি দুবার (১৯০৩ এবং ১৯১১) পেয়েছেন এই পুরস্কার। তুলনায় ১২০ বছরের ইতিহাসে ৫৯৯ জন পুরুষের হাতে উঠেছে এই পুরস্কার। অর্থাৎ নারী ও পুরুষের অনুপাত এক্ষেত্রে ১:১০। প্রিয় পাঠক, ভাববেন না আমি নারী-পুরুষের সমতা, ন্যায্যতা, সুযোগ, শিক্ষা এসব নিয়ে তুলানায় যাব। বরং চলুন খোঁজার চেষ্টা করি ঠিক কী কী কারণে অনুপাতটি এমন।
শুরুতেই কিছু মামুলি উদাহরণ দিয়ে বোঝার চেষ্টা করি। প্রতিদিনের জীবনে ব্যবহৃত কিছু পণ্য যা নারীরা আবিষ্কার করেছে এবং তাদের নামেই সেই আবিষ্কারের পেটেন্ট রয়েছে, সেগুলোকে খুব সহজেই তালিকাবদ্ধ করা যায়। যেমন বাসনপত্র পরিষ্কারক বা ডিসওয়াশার, গাড়ির উইন্ডস্ক্রিন ওয়াইপার, বোর্ড গেম মনোপলির মতো কিছু জিনিসমাত্র। কিন্তু এক প্রতিবেদন বলছে, বিশ্ব নারীদের আবিষ্কারক চিন্তার পুরোপুরি এখনো ব্যবহার করতে পারছে না। যুক্তরাজ্যের বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ বা ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি বিষয়ক দপ্তর (আইপিও)-র গবেষণা বলছে, সারা বিশ্বে পেটেন্ট আবেদনের মাত্র ১৩% আসে নারীদের কাছ থেকে। কিন্তু এক সময়, প্রতি সাত জন আবিষ্কারকের মধ্যে একজনই ছিলেন নারী। এবং যদিও এখন পেটেন্ট আবেদনে নারীদের হার বাড়ছে তবুও এই বিষয়ে লিঙ্গ সমতা আনা ২০৭০ সালের আগে সম্ভব নয়!
আলোচনাটি আরেকটু এগিয়ে নেওয়ার জন্য চলুন জেনে নিই ‘পেটেন্ট’ বিষয়ে। পেটেন্ট যেকোনো উদ্ভাবন বা অবিষ্কারের ‘মালিকানা’ প্রমাণ এবং কেবলমাত্র একজন উদ্ভাবক বা আবিষ্কারকই পেটেন্টের জন্য আবেদন করতে পারেন। অতীতে, নারী সম্পত্তি মালিকানা সমতুল্য অধিকার অনুমোদিত ছিল না (পেটেন্টও মেধা সম্পত্তির একটি ধরণ) এবং অনেক নারী তাদের স্বামী বা বাবার নামের অধীনে তাদের উদ্ভাবিত পেটেন্ট আবেদন করতেন। বলাবাহুল্য, সেই যুগে নারীদেরকে উদ্ভাবনের জন্য উচ্চতর শিক্ষার প্রয়োজনীয় জ্ঞান অর্জন থেকেও বিরত রাখা হতো (দুর্ভাগ্যবশত, বিশ্বের বহু দেশে আজও নারীরা সমঅধিকার এবং সম-শিক্ষা লাভ থেকে বঞ্চিত)।
যাই হোক, এবারে তাহলে জানার চেষ্টা করি আবিষ্কারের দুনিয়ায় নারীদের সংখ্যা কম কেন? গবেষকরা বলছেন, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, প্রকৌশল এবং গণিতে যা একত্রে সংক্ষেপে ‘স্টেম’ নামে পরিচিত তাতে নারীদের অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে একটি বড় ধরণের ফাঁক থাকাটাই এর জন্য দায়ী। বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ বিষয়ক আইনি প্রতিষ্ঠান পাওয়েল এন্ড গিলবার্টের অংশীদার পেনি গিলবার্টেও মতে, এটি একটি প্রবাহমান ধারারই অংশ। তিনি বলেন, ‘‘আমরা যদি দেখতে চাই যে নারীদের পেটেন্ট আবেদন বাড়ছে, তাহলে আরো বেশি সংখ্যক নারীকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ‘স্টেম’ বিষয়গুলো নিয়ে পড়াশুনায় যুক্ত করতে হবে এবং তাদের গবেষণাকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করার জন্য আগ্রহী করার পাশাপাশি সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে।’’ বর্তমানে যুক্তরাজ্যের ‘স্টেম’ শিল্পের কর্মীদের মধ্যে মাত্র এক তৃতীয়াংশ নারী। আমাদের দেশে মাধ্যমিক এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে খুব কম সংখ্যক (প্রায় ১১%) মেয়ে এবং নারীরা এ ধরণের বিষয়ে পড়াশুনা করে। যদিও বিশ্বব্যাপি এই বৈষম্য দূর করে ভারসাম্যে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। এ-প্রসঙ্গে গিলবার্ট আরও জানান, ‘‘নারীদের শিক্ষাগত এবং পেশাগত পছন্দ বিষয়ে যে-সাধারণীকরণ প্রচলিত আছে তা দূর করতে হলে নারীদের ‘স্টেম’ বিষয়গুলো নিয়ে পড়াশুনায় উৎসাহিত করার পাশপাশি এ-বিষয়ে নজরদারি ও পর্যবেক্ষণ বাড়াতে হবে এবং এক্ষেত্রে নারী রোল মডেল তৈরি হলে তার যথাযথ স্বীকৃতি দিতে হবে। আমাদের প্রশংসা করতেই হবে যে, ইতিহাসে ক’জন মহান নারী বিজ্ঞানী এবং আবিষ্কারক ছিলেন, ম্যারি কুরি এবং রোলিন্দ ফ্রাঙ্কলিন থেকে শুরু করে গ্রেস হপার যিনি প্রোগ্রামিং আবিষ্কার করেছিলেন এবং কেবল কারের আবিষ্কারক স্টিফানি কোলেকের নামও এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য।’’
একটি অন্তরায়ের কথাও উল্লেখ করেছে বুদ্ধিবৃত্তিক সম্পদ বিষয়ক আইনি প্রতিষ্ঠান পাওয়েল এন্ড গিলবার্ট। গবেষণা বলছে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে, নিজেদের গবেষণার জন্য পেটেন্টের অনুমোদন পাওয়ার ক্ষেত্রে নারীদের সম্ভাবনা পুরুষের তুলনায় অর্ধেক কম। এতে বলা হয় যে, নারীরা পুরুষের মতো তার পণ্যকে বাণিজ্যিক করার বিষয়ে তেমন আগ্রহী নয়। এদিক বায়োটেক বা জৈবপ্রযুক্তি খাতে সবচেয়ে বেশি লিঙ্গ সমতা রয়েছে বলেও জানায় গবেষণাটি। আশা করছি পেটেন্ট বিষয়ক এই আলোচনাটি থেকে আমরা বুঝতে পারছি যে নোবেল-এ নারী গবেষক, বিজ্ঞানী বা গবেষকদের অংশগ্রহণের পথে এটিও অন্যতম বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তাই জাতিগতভাবে উল্লেখিত পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসাশাস্ত্র, সাহিত্য ইত্যাদিতে পিছিয়ে থাকলেও আমাদের সময় এসেছে নারীদেরকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করার। পাশপাশি বিশ্ব দরবারে আমাদের দেশের নারীদের পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসা শাস্ত্র, সাহিত্য বিষয়ে বিভিন্ন লেখালেখি জার্নাল প্রকাশের মধ্যে দিয়ে পেটেন্ট গ্রহণের পথেও এগিয়ে যাওয়া নিশ্চিত করতে হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিশ্বকাপে ভারতকে হারাতে পারলেই ফুলে ফেঁপে উঠবে পাকিস্তান ক্রিকেটের তহবিল
পরবর্তী নিবন্ধচিমামান্দা ও নারীবাদী ভাবনা