চিমামান্দা ও নারীবাদী ভাবনা

সাদিকা রুমন | শনিবার , ৯ অক্টোবর, ২০২১ at ৭:২২ পূর্বাহ্ণ

“একসময় ওকুলোমা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘জানো, তুমি একটা নারীবাদী।’
এটা কোনো স্তুতিবাক্য ছিল না। ওর সুরেই বুঝতে পেরেছিলাম, একই সুরে যেভাবে একজন মানুষ বলে, ‘তুমি সন্ত্রাসবাদের সমর্থক’।”

না, এই বক্তব্যের প্রেক্ষাপটের দেশটি বাংলাদেশ নয়, আফ্রিকা। তবু একটি নির্দিষ্ট শব্দের উচ্চারণ, তার সঙ্গে মিশে থাকা অভিব্যক্তি কী নিদারুণভাবে আমাদের চেনা! হ্যাঁ নারীবাদী শব্দটির কথাই বলছিলাম। শব্দের সঙ্গে ভাব জড়িয়ে থাকে, কল্পনা জড়িয়ে থাকে, অভিজ্ঞতা জড়িয়ে থাকে, জড়িয়ে থাকে চিত্রকল্পও। সে-জায়গা থেকে নারীবাদী শব্দটি উচ্চারণ বা শ্রবণের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মস্তিষ্কে কী প্রতিক্রিয়া তৈরি হয় ভেবে দেখতে পারি মিনিট দুই। যারা শব্দটির প্রতি ইতিবাচক তাদের অভিজ্ঞতা হয়েছে তিক্ত, জর্জরিত হয়েছেন তিক্ত বাক্যবানে। যারা নেতিবাচক তাদের ভাবনা নারীবাদী মানে শুধু ‘সন্ত্রাসবাদের সমর্থক’ এখানেই থামবে না, তারা নারীবাদীকে ভাববেন জগতের সকল অরাজকতার মূল আর নারীবাদী স্বয়ং মানুষ ভিন্ন অন্য কোনো প্রাণী। অবশ্যই মানবজাতির জন্য অভিশাপতুল্য কোনো প্রাণী। এর মাঝামাঝি আরো একটা দল আছে যারা নারীবাদকে ভাবেন সংকুচিত ক্ষেত্র বরং ‘মানুষবাদিতা’ বা ‘মানবতাবাদিতা’ তাদের কাছে যথোপযুক্ত অভিধা। ভাবনা আসতেই পারে, মানবতার পথ না ডিঙিয়ে কি নারীবাদিতাকে ধারণ করা সম্ভব?
নারীবাদী-প্রত্যয়কে ঘিরে বড়ো একটি অংশের ভাবনা, বিশ্বাস, দৃষ্টিভঙ্গি এরকমই অস্পষ্ট, ছেঁড়া অথবা কল্পনাজাত বিকৃতিতে ঠাসা। সে জায়গায় দাঁড়িয়ে ‘আমাদের সবার নারীবাদী হওয়া উচিত’ এমন উচ্চারণ চমকে দেয়ার মতো। আর সন্দেহাতীতভাবে এতে সবচেয়ে বেশি চমকে ওঠে পুরুষতন্ত্র। পুরুষতন্ত্র তখন পায়তারা করে পুরুষকেই নারীবাদের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়ে দিতে। অর্থাৎ তুমি নারীবাদী তুমি আর পুরুষ এখন সহযোদ্ধা নও, প্রতিপক্ষ। চিমামান্দা এনগোজি আদিচি পুরো বিষয়টিকে বয়ান করেছেন এভাবে, ‘স্বামী না পেয়ে যেসব মেয়ে অসুখী, তারাই নারীবাদী। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, আমি হব একজন সুখী নারীবাদী। তারপর একজন নাইজেরিয়ান নারী শিক্ষাবিদ আমাকে বলেন, নারীবাদ আমাদের সংস্কৃতি নয়; আমি পশ্চিমা বই পড়ে নিজেকে নারীবাদী বলি। যেহেতু নারীবাদ আফ্রিকান নয়, আমি এবার ঠিক করলাম আমি নিজেকে একজন সুখী আফ্রিকান নারীবাদী বলব। তারপর এক প্রিয় বন্ধু বলল, নারীবাদী মানে আমি পুরুষদের ঘৃণা করি। এবার সিদ্ধান্ত নিলাম, আমি হলাম একজন সুখী আফ্রিকান নারীবাদী, যে পুরুষদের ঘৃণা করে না।” অর্থাৎ একথা বুঝতে বেগ পেতে হয় না যে, নারীবাদকে ঘিরে ভাবনা ও নারীবাদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি আফ্রিকা এবং বাংলাদেশে অভিন্ন। কাজেই ‘আমাদের সবার নারীবাদী হওয়া উচিত এবং একটি নারীবাদী ঘোষণাপত্র’ বইটি বাংলাদেশের জন্য ভীষণরকম প্রাসঙ্গিক। গুরুতর তত্ত্বকথা নয়- বোধগম্য সহজ বিষয়, অভিজ্ঞতা, প্রতিদিনকার জীবনযাপনের উল্লেখেই লেখক বোঝাতে চেয়েছেন নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির অসঙ্গতিগুলো। আর তা আফ্রিকাতেও যেমন সত্য বাংলাদেশেও তেমন বাস্তব।
বইটির দুইটি অংশ। দুইটি পৃথক বইয়ের অনুবাদ এক মোড়কে ঠাঁই পেয়েছে। প্রথম অংশ: ‘আমাদের সবার নারীবাদী হওয়া উচিত’, দ্বিতীয় অংশ: ‘প্রিয় ইজাওয়েলে: পনের পরামর্শে একটি নারীবাদী ঘোষণাপত্র।’ দ্বিতীয় অংশের ভূমিকায় লেখক জানিয়েছেন, নারীবাদী হওয়ার এই পরামর্শগুলো তাঁর বন্ধুর অনুরোধে লেখা। যে-বন্ধু জানতে চেয়েছিলেন, কীভাবে তিনি তাঁর কন্যাকে নারীবাদী হিসেবে বড়ো করবেন। তিনি যুক্ত করেছেন, “তবু আমি মনে করি, ভিন্নভাবে সন্তান পালন করা নিয়ে, নারী ও পুরুষের জন্য পক্ষপাতশূন্য একটি পৃথিবী গড়ে তোলা নিয়ে সৎ আলোচনা হওয়া নৈতিকভাবে জরুরি।” এ অংশে লেখক নারী-পুরুষের কর্ম-বেড়ে ওঠার সমাজ-নির্ধারিত গৎবাঁধা মানদণ্ডগুলো থেকে বেরিয়ে আসার পরামর্শ দিয়েছেন। দেখিয়েছেন সমাজ কীভাকে শিশুকে ‘মেয়ে’ এবং ‘ছেলে’ করে তোলে। এই প্রক্রিয়াটি যে শুধু নারীর জন্যই বৈষম্যমূলক, অবমাননাকর মনস্তত্ত্বের জন্ম দেয় এবং লালন করে তাই নয়; ক্ষেত্রবিশেষে পুরুষের জন্যও হয়ে ওঠে ভারী বোঝা। আদিচি স্পষ্ট করে বলেছেন, “যেভাবে আমরা ছেলেদের বড় করি, তাতে তাদের প্রতি ঘোর অবিচার করা হয়। আমরা ছেলেদের মানবতাকে অবদমিত করি। আমরা পুরুষত্বের সংজ্ঞাকে খুবই সংকুচিত করে ফেলেছি। পুরুষত্ব একটি কঠোর, ছোট্ট খাঁচা আর আমরা আমাদের ছেলেদের সেই খাঁচায় পুরে দিই। আমরা ছেলেদের দুর্বলতা আর স্পর্শকাতরতাকে ভয় পেতে এবং তাদের সত্যিকারের সত্তাকে অবগুণ্ঠিত করতে শেখাই।”
‘পুরুষদের কাঁদতে নেই’ এ-জ্ঞান বাংলাদেশের অভিভাবকরাও তাদের ছেলেসন্তানেরর মস্তিষ্কে পুওে দেন। যার পরিণতি হিসেবে একজন পুরুষ সারাজীবনের জন্য বহন করেন অবদমনের ভার। কান্না তার কাছে দুর্বলতা। কান্না নারীর জন্য। নারী দুর্বল। এই মনস্তত্ত্বে সে আটকা পড়ে যায় শিশু বয়সেই। এই চাপানো ভার থেকে মুক্ত হওয়ার জন্যও আবশ্যক আদিচির পনেরোটি পরামর্শ।
পুরো বইয়ের সারকথা হিসেবে লেখকের একটি কথাকে টেনে আনা যায়, “তোমার নারীবাদী মূলনীতি হওয়া উচিত : আমি মূল্যবান। আমি সমানভাবে মূল্যবান। ‘শুধু যদি’ বা ‘যতক্ষণ পর্যন্ত’ নয়। আমি সমানভাবে মূল্যবান।”
বিষয়-বক্তব্যের দিক থেকে বইটি গুরুত্বপূর্ণ সন্দেহাতীতভাবেই। লেখকের ভাষা এবং সমাজ ভিন্ন হলেও দুটি সমাজেই নারী ও নারীবাদের মূল্যায়ন অভিন্ন। জিজ্ঞাসা থেকে যায় বইটি বাংলায় অনুদিত হয়ে ‘আমাদের সবার নারীবাদী হওয়া উচিত এবং একটি নারীবাদী ঘোষণাপত্র’-রূপে সেই অভিন্ন প্রেক্ষাপটকে কতটা ফুটিয়ে তুলতে পেরেছে, কতটা বোধগম্য করতে পেরেছে। সে-জায়গা থেকে বলা যায়, শিমিন মুশাররাত এমন একটি বিষয় নিয়ে সর্বজনের কাছে পৌঁছুনোর দায়বদ্ধতাকে ক্ষুণ্ন করেননি। তাঁর অনুবাদের ভাষা প্রাঞ্জল, স্বতঃস্ফূর্ত। অহেতুক ভারে ভারাক্রান্ত নয়। বইটির বিষয় ও বাস্তবতা যেমন পাঠকের কাছে অচেনা ঠেকে না, তেমনি অনুবাদের ভাষা ও প্রকাশভঙ্গিকেও দূরের মনে হয় না। কিংবা বলা যায়, ‘অনুবাদ’ বলে বইয়ের সঙ্গে পাঠকের দূরত্ব তৈরি হয় না। বইটি প্রকাশ করেছে বাতিঘর। মুদ্রিত মূল্য: ২০০ টাকা এবং বিক্রয় মূল্য: ১৬০ টাকা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনারী গবেষক ও আবিষ্কারক: ‘পেটেন্ট’ বিষয়ক বোঝাপড়া
পরবর্তী নিবন্ধরবিউল আউয়ালকে স্বাগত জানিয়ে আনন্দ র‌্যালি