নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের শক্তিশালী কেন্দ্র

সোমা ধর | রবিবার , ২০ নভেম্বর, ২০২২ at ১০:০৭ পূর্বাহ্ণ

চির সৌন্দর্যের পুজারী কবি জন কিটস এন্ডিমিয়ন কবিতায় বলেছেন-
সৌন্দর্যের যে কোন জিনিস চির আনন্দের
এর প্রীতিময়তা বাড়তেই থাকে;
এটি কখনো শূন্যতায় হারিয়ে যায় না।

সাজগোজ করতে কে না ভালোবাসে? আর এ সাজগোজ এখন শুধু মেয়ে বা নারীর মাঝেই সীমাবদ্ধ নয়, সৌন্দর্য চর্চায় পুরুষেরাও এখন পিছিয়ে নেই। অতীতে যে সৌন্দর্যের বহিঃপ্রকাশ শুধু বিত্তশালীদের উপাচার বলে ভাবা হতো, কালের বিবর্তনে আজ সৌন্দর্য চর্চা, উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত এমনকি নিম্নবিত্তের মাঝেও জীবনের একটি অপরিহার্য কাজে পরিণত হয়েছে। তাছাড়া পূর্বে এই চর্চা ছিল অনুষ্ঠান ভিত্তিক, আজ তা দৈনন্দিন চাহিদায় পর্যবসিত হয়েছে।

স্যালন বা পার্লারের সূচনা:

স্যালন শব্দটি ফ্রেঞ্চ শব্দ স্যালন থেকে এসেছে যার অর্থ রিসেপশন রুম বা অভ্যর্থনা কক্ষ। যার সমার্থক শব্দ পার্লার। স্যালনের শিকড় হলো প্রাচীন গ্রিস এবং রোম। পনের শতাব্দীতে ইতালিতে ইসাবেলা ডি’এস্টে এবং এলিসাবেটা গঞ্জাগা নামক দুজন সম্ভ্রান্ত পরিবারের নারী ঘরোয়া পরিবেশে স্যালনের প্রবর্তন করেন। এই সময়কালকে এনলাইট্‌েনমেন্ট বা জ্ঞানদানের অগ্রদূত বলা হয়। (১৭০০- ১৮০০) সালের প্রথম ভাগকে পুরোপুরি জ্ঞানদানের সময় বলা হয় কেননা তখন থেকেই মুক্ত চিন্তাধারা প্রসার লাভ করে। তবে এই স্যালন শুধু শিক্ষিত, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ, এবং সংস্কৃতিমনা ব্যক্তিদের পারস্পরিক আলোচনার ব্যক্তিগত কক্ষ রূপে পরিগণিত হতো। পার্লারের সাথে বিউটি যুক্ত হয়ে তা হয় বিউটি পার্লার যা নারী সৌন্দর্যের সেবা কক্ষ রূপে পরিচিত। আর স্যালন নারী, পুরুষ উভয়ের সৌন্দর্য সেবায় প্রতিষ্ঠিত।

বিশ্বের প্রথম বিউটিশিয়ান (রূপবিশারদ) এবং বিউটি পার্লারের রূপকার:

১৮৮৮ সালে কানাডার মারথা মাতিল্ডা হারপার নামক এক ভৃত্যা, ২২ বছর সেবিকা হিসেবে কাজ করে ৩১ বছর বয়সে বিউটিশিয়ান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন এবং ধীরে ধীরে নিজেই ৫০০ স্যালনের অধিকারী হন। যাকে আধুনিক বিউটি পার্লারের ফ্র্যাঞ্চাইজিং এর পথিকৃৎ বলা হয় এবংতিনি বিশ্বের প্রথম বিউটিশিয়ান হিসেবে পরিচিত। স্কুলে ভর্তি হওয়া শিশুদের অপেক্ষারত মায়েদের নিয়ে তিনি তাঁর বিউটি পার্লারের যাত্রা শুরু করেন। তাঁর দ্যা হারপার মেথড বিশ্বে জনপ্রিয় একটি পদ্ধতি ছিল যা চুলের সৌন্দর্য বর্ধনে ব্যবহৃত হতো। পার্লারের কাজের সূত্রে তিনি বহু নারীর দারিদ্র্য দূরীকরণে এবং নারী উদ্যোক্তা তৈরিতে সহায়তা করেছিলেন।

সার্ভিস কোয়ালিটির ডাইমেনশন বা মাত্রা:

১৯৯১ সালে প্যারাসুরামান এবং কয়েকজন গবেষক সার্ভকোয়াল মডেল প্রবর্তন করেন। গবেষকদের মতে সার্ভিস কোয়ালিটি বা পরিষেবার মাত্রাগুলো হলোঃ ১। স্পর্শকাতরতা ২। নির্ভরযোগ্যতা ৩। প্রতিক্রিয়াশীলতা ৪। নিশ্চয়তা এবং ৫। সহমর্মিতা।

বাংলাদেশে বিউটি পার্লারের সূত্রপাত:

স্বাধীনতার পূর্বে ১৯৬৩ সালে চীনা নাগরিক কার্মেল চ্যাং লিউ শেই ঢাকায় প্রথম বিউটি পার্লার চালু করেন। ১৯৬৫ সালে পার্লারটি মে ফেয়ার নামে আবার চালু হয়। পরবর্তীতে হংকং এবং এর পরে লি নামে আরো দুটি পার্লার ঢাকায় চালু হয়। মূলত এ দেশে আসা চীনা নাগরিকরাই এই পার্লারগুলো পরিচালনা করতেন। তৎকালীন অভিনেত্রী এবং সম্ভ্রান্ত পরিবারের নারীরাই একমাত্র সৌন্দর্য চর্চার সেবা গ্রহণ করতেন। বারো বছর পর স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৭ সালে প্রথম বাঙালি হিসেবে জেরিনা আজগর লিভিং ডল নামে একটি বিউটি পার্লার প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি করাচি থেকে ১৯৭০ সালে বিউটিফিকেশনের ওপর কোর্স সম্পন্ন করেন। গ্রাহকদের সাথে পেশাদারিত্ব সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার কারণে তিনি এই উদ্যোগ গ্রহণ করেন যা চীনা পার্লার গুলোতে অভাব ছিল। সৌন্দর্য চর্চার পাশাপাশি তিনি সৌন্দর্যের বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতেন। পরে ১৯৯৬ সালে ঢাকার গুলশানে তিনি তার পার্লার প্রতিস্থাপন করেন। ঢাকার বাইরে প্রথম বিউটি পার্লার শুরু হয় চট্টগ্রামে যার নাম লুসি বিউটি পার্লার। প্রাক্তন জাতীয় দলের ক্রিকেটার শফিকুল হক হীরার সহধর্মিণী লতিফা হক লুসি এই পার্লার প্রতিষ্ঠা করেন। প্রায় ৪৪ বছর পূর্বে যেখানে চট্টগ্রামে মাত্র লুসি পার্লার ছিল, আজ চট্টগ্রামে ২০০ অধিক পার্লার প্রতিষ্ঠিত।

১৯৯০ সাল থেকে বাংলাদেশে স্যাটেলাইট টিভির বদৌলতে সৌন্দর্য রহস্য উন্মোচিত হতে থাকে এবং দ্বিতীয় (নতুন) প্রজন্মের বিউটিশিয়ানরা সৌন্দর্য চর্চাকে পেশা হিসেবে নিয়ে আরো দক্ষতার সাথে পরিচালিত করতে থাকে। তারা ঘরের গৃহিণীদের এই শিল্পের দ্বারা আত্মনির্ভরশীল হতে অনুপ্রেরণা দিতে শুরু করে। আর তারই পরশ পেয়ে নারীদের মাঝে সৌন্দর্য সচেতনতা বাড়তে থাকে। বিউটি পার্লারের সংখ্যা বেড়ে যায় বাংলাদেশে। শুভ সূচনা হয় সৌন্দর্য সংস্কৃতির এক নতুন ধারার।
কথায় বলে যে রাঁধে সে চুল ও বাঁধে। বাংলার নারীরা পারে না সত্যি কোনো কাজ নেই। জন্মদিন, বিয়ে, নানা সামাজিক অনুষ্ঠানে নারীরা নিজেদের সুন্দর করে তুলে পার্লারের দ্বারস্থ হয়। আর পার্লারের কর্মরত নারীরা তাদের দক্ষতা দিয়ে প্রতিটি নারীকে অপরূপা করে তোলেন। কাউকে তারা শ্রীহীন রাখেন না, বরং শ্রীহীন ও শ্রীযুক্ত হয়ে ওঠে তাদের ছোঁয়ায়।

বর্তমানে বাংলাদেশে নিবন্ধিত পার্লারের সংখ্যা হলো সাড়ে তিন লাখের মতো। তবে ছেলেদের মোট স্যালনের সংখ্যা পাঁচ লাখ। দেশে নারী কর্মজীবীদের মোট সংখ্যার (৩৪.৮৭ শতাংশ) ১৮ শতাংশ পার্লারে কাজ করছেন। পার্লারের কর্মী হিসেবে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মেয়েরা বিশাল একটা জায়গা দখল করে আছেন।

নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নে পার্লার বা স্যালনের ভূমিকা:

বাংলাদেশের নারীদের কর্মক্ষেত্রের একটি বিশাল স্থান জুড়ে আছে বিউটি পার্লার। পার্লারের জনপ্রিয়তা এখন শহরের পাশাপাশি গ্রাম গঞ্জের আনাচে কানাচেও ছড়িয়ে পড়েছে। উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে নারীরা সাজসজ্জার দিকে আগের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন হয়ে উঠছে।

রূপবতী হোক বা না হোক নিজেকে পরিপাটি রাখার মধ্যে দিয়ে ফুটে ওঠে নারীর ব্যক্তিত্ব, রুচি, ভালোলাগা, সৌন্দর্য। সর্বোপরি মনের সঙ্গে সাজসজ্জার একটি মেলবন্ধন তৈরি হয়। নিজেকে সুন্দর করে উপস্থাপনে তৃপ্তি এবং পরিপূর্ণতা আসে, যা নিজেকে আত্মবিশ্বাসী এবং আত্মনির্ভরশীল করে তোলে। তবে তা হতে হবে পরিমার্জিত এবং সাবলীল। সৌন্দর্য চর্চা শুধু বাহ্যিক সৌন্দর্যের মাঝে থেমে নেই, এখন তা চিকিৎসাও বটে। বিউটিশিয়ানরা স্যালনের মাধ্যমে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে ত্বকের সুষ্ঠু পরিচর্যার পাশাপাশি একজন নারী চুল থেকে শুরু করে শরীরের বিভিন্ন অংশের সৌন্দর্য বর্ধনে সহায়তা করেন। সেবার মূল্য যাতে গ্রাহকদের ব্যয় সাপেক্ষ না হয়, সেদিকে সেবা খাতের কর্ণধারবৃন্দ বিশেষ মনোযোগী থাকেন। কেননা প্রতিযোগিতামূলক বাজারে গ্রাহকদের দৃষ্টি আকর্ষণে সব বিউটি পার্লার সজাগ।
সৌন্দর্য সেবা খাতে আজকাল নারী উদ্যোক্তারা বেশি আগ্রহ প্রকাশ করছেন। তবে করোনা মহামারীর প্রকোপে দেশের বিউটি পার্লারগুলো চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন। এই খাত থেকে প্রতি বছর প্রায় ৫০০ কোটি ডলার আয় হচ্ছে। প্রায় সাড়ে তিন লাখ নারী উদ্যোক্তা এই খাতের সাথে যুক্ত। আর এসব পার্লারে কর্মরত আছেন প্রায় ১০ লাখ কর্মী। যার ৯৯ শতাংশ নারী ।

দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সৌন্দর্য সেবা খাতের অবদানের পথ সুগমে সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা অত্যাবশ্যক। এতেই নারী অর্থনৈতিক ভাবে শক্তিশালী হয়ে ওঠার সুন্দর, সুস্থ ধারা উন্মোচন হতে পারে, হতে পারে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত। শিক্ষাগত যোগ্যতা সবার সমান নাই হতে পারে, তাই বলে দক্ষতা প্রমাণের সুযোগ থেকে কোনো নারীকে বঞ্চিত করা উচিত নয়। যে যে কাজে পটু, তাই তার এগিয়ে চলার পাথেয়। তা সে হাতে কলম নিয়ে হোক বা রান্না দিয়ে বা চোখে কাজল পরিয়ে। চলার পথ শুরু হোক আজ থেকে।

লেখক: পি এইচ ডি গবেষক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধধন্যবাদ প্রধানমন্ত্রী : শিরীষতলা ফিরিয়ে দেয়ার জন্য