ধন্যবাদ প্রধানমন্ত্রী : শিরীষতলা ফিরিয়ে দেয়ার জন্য

ড. আব্দুল্লাহ আল মামুন | রবিবার , ২০ নভেম্বর, ২০২২ at ১০:০৮ পূর্বাহ্ণ


সিআরবির শিরীষতলায় হাসপাতাল না হোক, এ ছিল চট্টগ্রামবাসীর প্রাণের দাবী। সবুজে ঘেরা এ জায়গাটি রক্ষার জন্য দীর্ঘদিন ধরে চলছে নাগরিক আন্দোলন। গত ৪৮৩ দিনের আন্দোলনে এবার সফল হতে যাচ্ছে চট্টগ্রামবাসী। সিআরবিতে বেসরকারি হাসপাতাল নির্মাণের প্রকল্প থেকে সরে আসতে যাচ্ছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। ফলে রক্ষা পেতে যাচ্ছে সিআরবি।

দাবী আদায়ের জন্য আমরা সচরাচর ভাঙচুর ও অবরোধের আশ্রয় নেই, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে বিপর্যস্ত ও দুর্বিসহ করে তুলি। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় অর্থনীতি। কিন্তু সংঘবদ্ধ ও নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনও যে কাঙ্ক্ষিত সুফল বয়ে আনতে পারে সিআরবি আন্দোলন তার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

দেড়শ’ বছরের পুরোনো হেরিটেজ এলাকা হিসাবে তালিকাভুক্ত সিআরবি এলাকায় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি)-এর আওতায় একটি হাসপাতাল নির্মাণ প্রক্রিয়া শুরু করলে চট্টগ্রামে গণ আন্দোলনের সূচনা হয়। তবে সিআরবি আন্দোলনের ইতিবাচক দিক হল দল-মত নির্বিশেষে নিজেদের মত-পার্থক্য সরিয়ে রেখে বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং শ্রেণি পেশার মানুষ চট্টগ্রাম নাগরিক সমাজের ব্যানারে একতাবদ্ধ হয়ে এই আন্দোলনে অংশ নেয়। কবি ও সাহিত্যিক সমাজ কবিতা ও প্রবন্ধ লিখে যেমন করেছেন প্রতিবাদ তেমনি চিত্রশিল্পীরা রং তুলির আঁচড়ে এঁকেছেন প্রতিরোধের বিমূর্ত ছবি। তাদের সবার একটাই দাবি, চট্টগ্রাম মহানগরীর এই সবুজভূমি কেড়ে নেয়া যাবে না।

এই আন্দোলন বেগবান করতে মিডিয়াও অত্যন্ত জোরালো ভূমিকা নেয়। চট্টগ্রামের পত্র-প্রত্রিকায় দিনের পর দিন হাসপাতাল নির্মাণের নেতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরে ছাপা হয় প্রতিবেদন ও বিশ্লেষণ। চট্টগ্রামের শীর্ষ পত্রিকা দৈনিক আজাদীর উপ-সম্পাদকীয়তে জলবায়ু ও পরিবেশের ওপর সবুজ এলাকা ধ্বংস করে স্থাপনা নির্মাণের প্রভাব নিয়ে আমি একটি প্রবন্ধ লিখি। এছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত প্রবাসী চট্টলবাসীও সোচ্চার হয়েছেন প্রতিবাদে। বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব ও গবেষকদের নিয়ে অন্তর্জালের জানালায় নিয়মিত আয়োজিত হয়েছে সচেতনামূলক আলোচনা ও প্রতিবাদ সভা। এভাবে শান্তিপূর্ণ উপায়ে চট্টগ্রামের গণ-মানুষের মধ্যে যে চরম ক্ষোভ ও জনরোষের আগুন জ্বলছিল, সেই বার্তা খুব সহজেই প্রধানমনন্ত্রীর দপ্তরেও পৌঁছে গিয়েছিল। তাই সিআরবি রক্ষার আন্দোলন আগামী দিনের যে কোনো দাবী আদায়ের আন্দোলনের একটি আদর্শ ও মাইলফলক হতে পারে।

জানা গেছে, রেলপথ সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সাম্প্রতিক সভায় সিআরবিতে প্রস্তাবিত হাসপাতালের বিকল্প হিসেবে কুমিরার নাম প্রস্তাব করা হয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন রেলপথ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এবিএম ফজলে করিম চৌধুরী। কুমিরা রেলওয়ে স্টেশনের বিপরীতে পাহাড়ের উপরে রেলওয়ের একটি যক্ষা হাসপাতাল ছিল। প্রায় ৩০ বছর আগে থেকে হাসপাতালটি পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। সংসদীয় কমিটি সেখানে থাকা প্রায় ১৩ একর জায়গায় হাসপাতাল নির্মাণের জন্য বিকল্প প্রস্তাবনা দেয়া হয়েছে। তবে কোথায় হাসপাতাল নির্মিত হবে- সেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।

সিআরবি অবশেষে রক্ষা পাচ্ছে বলে প্রধানমন্ত্রীকে জানাই আন্তরিক কৃতজ্ঞতা। ইতিমধ্যে সিআরবি রক্ষায় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত হয়েছে মহাসমাবেশ। সিআরবিতে হাসপাতাল প্রকল্প না হয়ে বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের নামে জাতীয় উদ্যান করার ঘোষণা দিয়েছে নাগরিক সমাজ।

সিআরবি রক্ষার আন্দোলন আপাতত শেষ হলেও চট্টগ্রামের সংগ্রামী জনতাকে খুব সহসাই নতুন আন্দোলনে সোচ্চার হতে হবে বলে মনে হচ্ছে। সিআরবি’র পর এবার চট্টগ্রামের মানুষের প্রাণভরে শ্বাস নেয়ার আরেকটি প্রিয় জায়গা পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত কেড়ে নেয়ার পাঁয়তারা করছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত এলাকার ৭ কিলোমিটার পরিসরের ১.৫ কিলোমিটার অংশ ২৫ বছরের জন্য বাণিজ্যিকভাবে ইজারা দিতে যাচ্ছে সিডিএ। এই দেড় কিলোমিটার অংশে টিকেট কাটা ছাড়া সাধারণ মানুষ প্রবেশ করতে পারবে না। চট্টগ্রামের মানুষের জন্য যেখানে আরও বেশি উন্মুক্ত এলাকা দরকার, সেখানে তা আরো সীমিত করার যৌক্তিকতা কতটুকু তা বোধগম্য নয়।

অন্যদিকে বৃটিশ আমলে তৈরী চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর ওপর দাঁড়িয়ে থাকা ঐতিহ্যবাহী ‘কালুরঘাট সেতু’ সংস্কারের জন্য দীর্ঘদিন ধরে দাবি জানিয়ে আসছে চট্টগ্রামবাসী। একাত্তরে নদীর উত্তর ও পশ্চিম পাড়ের দখল নিয়ে হানাদার বাহিনীর সাথে লড়াই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখা রয়েছে। যদিও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কালুরঘাট সেতুটি যুগোপযোগী করে নির্মাণের নির্দেশনা দিয়েছেন, বাজেটও বরাদ্দ কিন্তু বিভিন্ন জটিলতায় বারবার আটকে যাচ্ছে চট্টগ্রামে কালুরঘাট সেতুর নির্মাণকাজ। সিআরবি’র মত সাধারণ মানুষকে এ দু’টো ইস্যুতে সোচ্চার হতে হবে, প্রতিবাদে মুখর হতে হবে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কল্যাণ ও স্বার্থের বিপক্ষে যায় এমন কোনো সিদ্ধান্ত চট্টগ্রামের বীর জনতা মেনে নেবে না।

লেখক: প্রকৌশলী ও জলবায়ু গবেষক

পূর্ববর্তী নিবন্ধনারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের শক্তিশালী কেন্দ্র
পরবর্তী নিবন্ধপটিয়ায় সোহেল হত্যাকারীদের ফাঁসির দাবিতে মানববন্ধন