নানিয়াচর

তারেক জুয়েল | শুক্রবার , ১ এপ্রিল, ২০২২ at ৬:২১ পূর্বাহ্ণ

গাম্ভীর্য্য আর মৌনতার সংমিশ্রণে সৃষ্ট পাহাড়ের সবকিছুর মধ্যে কেমন যেন একটা রহস্য আছে। সেটা পাহাড়ি আঁকা-বাঁকা পথ হোক কিংবা পাহাড়ের ভাঁজ, খাঁজ, খাঁদ। এমনকী ছোটবেলায় সাধারণ গণিতে করা সরল অংকের উত্তরের মতো সাধারণ চোখের পাহাড়ি মেয়েদের মধ্যেও কেমন যেন একটা অজানা অব্যাক্ত কাহিনী লুকিয়ে আছে।
সুরভীর সাথে পরিচয় রাঙা আর লংগদুর মাঝামাঝি নানিয়াচর নামের এক জায়াগায়। রাঙামাটিকে এখানকার বাসিন্দারা আদর করে রাঙা ডাকে। নামটা আগে শোনা ছিল না। বিদেশিদের কথা জানি না, তবে আমাদের দেশের মানুষরা তাদের প্রিয় মানুষটাকে তার নাম ছোট করে ডাকে। নাম ছোট করে নিজের মত করে ডাকাটার মধ্যে একধরনের নাকি ভালোবাসা আছে, ওটাতেই নাকি সত্যিকারের আবেগ। আর নাম ছোট করে ডাকার ব্যাপারে এদেশেই মা’রাই এগিয়ে।
সেদিন সকালে রাঙা থেকে লংগদু যাচ্ছিলাম। আমাদের দেশটার সবচে সুন্দর জলপথ এ রাঙার লেক ধরে চার ঘন্টায় পৌঁছুব লংগদু। দু’দিন থাকবো থানার ডাকবাংলোতে, ওসি সাহেবের অতিথি হয়ে। সম্পর্কে বড় ভাই, নতুন এসেছেন। বোটে যখন উঠলাম তখন আকাশাটা বেশ পরিষ্কার ছিল, ঝড় তো দূরের কথা একটু বৃষ্টি যে হতে পারে তা বুঝতে পারিনি। কিন্তু আমাদের বোটটা নানিয়াচরের কাছে আসতেই হঠাৎ একটা ঝড় এসে আমাদেরকে প্রায় ডুবিয়ে দিচ্ছিল।
রাঙার লেকের ঝড় মাঝে মাঝে বেশ ভয়ংকর হয়ে ওঠলেও তার মধ্যে কেমন যেন একটা কোমলতা আছে, সুন্দরী কেউ কখনো প্রচন্ড রেগে গেলে যেমন লাগে ঠিক তেমনি, হঠাৎ আসা ঝড়ে তাই ভয় পাইনি। দক্ষ হাতে আমাদের সারেং বোটটা ঘাটে ভিড়িয়ে সবাইকে জলদি নেমে যেতে বললে আমি নেমে কিছুটা দৌড়ে ছোট্ট একটা ছাউনির নিচে বসি। ঝড় তো কখনো একা আসে না, সাথে তার থাকে তার প্রিয় সঙ্গিনী, বৃষ্টি। ছাউনিতে বসতেই শুরু হয় তুমুল বৃষ্টি, পাঁচ হাত দূরের জিনিসও পরিষ্কার দেখা যাচ্ছিল না ।
প্রচন্ড বৃষ্টির পর্দা ভেদ করে যখন বাইরেরটা দেখতে চেষ্টা করছিলাম তখনই বৃষ্টির মধ্যে আবির্ভাব হয় একটা পাহাড়ি মেয়ের, পরনে হালকা গোলাপী রঙের পাহাড়ি কাপড় যেটা ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে, সাথে দুজন ষন্ডামার্কা লোক। লোকদুটোকে ষন্ডামার্কা বললাম, কারণ তাদের চেহারায় কেমন যেন একটা রুক্ষতা ছিল, পরনের লুঙ্গি হাঁটু পর্যন্ত ভাঁজ করা, গায়ে বড় একটা শাল জড়ানো, নীচে কোন অস্ত্রও থাকলে থাকতে পারে। লোকগুলোর কেমন যেন এক অদৃশ্য নিরাপত্তার চাদরে মেয়েটাকে ঢেকে রেখেছিল যেটা চোখ এড়ায়নি। পাহাড়ি মেয়েটা ছাউনির নিচে এসে দাঁড়ালে একটু সরে আমি জায়গা করে দিই, সে বেঞ্চে বসে মাথার চুলগুলো একদিকে করে দুহাত দিয়ে যখন চুল থেকে পানি নিংড়ে বের করার চেষ্টা করছিল, তখন ব্যাগ থেকে একটা টাওয়াল বের করে এগিয়ে দিয়ে বলি, ‘পরিষ্কার, ধোয়া টাওয়েল, মাথাটা মুছে নিন, ঠাণ্ডা লেগে যেতে পারে।’
পাহাড়ি মেয়েরা সাধারণত বাঙালি ছেলেদের সাথে কথা বলে না। এটা নাকি পাহাড়ের নিয়ম। তার উপর টাওয়েল নেয়া! অসম্ভব। পাশের ষন্ডামার্কা লোক দুটো কেমন যেন কড়া চোখে তাকালো। একটু ভয় পেয়েছিলাম অবশ্য, তবে আমাকে অবাক করে টাওয়েলটা নিয়ে চুলগুলো মুছে টাওয়েলটা কোলের উপর রাখলো। কোন ধন্যবাদ দিল না, চুপচাপ বসে।
কিছুটা সময় চলে যাবার পরও যখন দেখলাম পাহাড়ি কন্যা কোন কথা বলছে না তখন বললাম, ‘হয়ে গেলে টাওয়েলটা দিয়ে দিতে পারেন।’
দাম্ভিক বলবো না, তবে মেয়েটার হাঁটা-বসা-চলার মধ্যে এক ধরনের ডাঁট ছিল। খুব জড়তা না রেখেই বললো, ‘রাজকন্যারা তাঁদের ব্যাবহার করা জিনিস তো কাউকে কখনো দেয় না, সেটা শুধু একবার ব্যবহার করা হোক বা খুব পুরনো।’
রাজকন্যা? মেয়েটা আমাকে বোকা বানাচ্ছে না তো? রাজকন্যারা কি এরকম কাঠের বোটে করে আসে, বাড়তি কোন জৌলুস নেই। আমার অবাক হওয়া দেখে নিজ থেকে বলল, ‘আমি সুরভী চাকমা। রাজা ধীরেন চাকমার মেয়ে। ঝড়টা থামলে দেখিয়ে দিতে পারবো আমাদের প্রাসাদটা। পাহাড়ের ওপাশে, এখান থেকে দেখা যায়।’
এবার একটু ভাল করে দেখলাম আমার পাশে বসা, বৃষ্টির পানিতে ভিজে চুপচুপে হয়ে যাওয়া রাজকন্যাকে। সুরভীর নাকটা আর দশটা পাহাড়ি মেয়েদের মত বোঁচা হলেও লম্বায়, গড়নে প্রথম দেখায় বিদেশী মনে হতে পারে। তবে হ্যাঁ সত্যি সত্যি একটা বনেদী ছাপ আছে ওর মধ্যে।
‘ঝড়টা থামতে কতক্ষণ লাগতে পারে?’ জানতে চাইলে বললো, ‘ঝড় থেমে যাবে।’
রাঙায় ঝড় বেশীক্ষণ থাকে না। কিছু ঝড় পাহাড় থামিয়ে দেয়।’
‘আচ্ছা, সেজন্যই বলি পাহাড়কে দেখতে এতো রুক্ষ মনে হয় কেনো?’ পাহাড়কে হঠাৎ কেন রুক্ষ বললাম জানি না, তবে কথাটা বলেই বুঝলাম রুক্ষ বলাটা উচিত হয়নি। সুরভীর মুখটাও দেখলাম কেমন যেন হয়ে গেল, হয়তো তাই খুব নির্লিপ্ত মুখে বললো, ‘পাহাড়কে রুক্ষ কেন মনে হবে? পাহাড়ের সৌন্দর্য দেখেছেন কখনো? একবার দেখার চেষ্টা করুন, ভালো লাগবে, আপনারা সমতলের মানুষরা পাহাড়ের খালি দোষ খুঁজে বেড়ান।
‘দোষ খুঁজলাম কোথায়? বরং বোঝাতে চাইলাম পাহাড় হলো বাবার মত, বিপদ ঠেকিয়ে দেয়।’ একটু আগে করা দোষটা কাটাতে চাইলাম।
আমার কথা শুনে সুরভী হেসে ফেললো। ‘হয়েছে পাহাড়কে বাবা আর সমতলকে মা বানিয়ে আমার আর আপনার মধ্যে ভাই-বোনের সম্পর্ক খুঁজতে হবে না বরং চোখ তুলে পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে দেখুন। দেখবেন পাহাড়ও তাকিয়ে আছে আপনার দিকে। জানেন, পাহাড় কথা বলে! পছন্দ না হলে কথা ফিরিয়ে দেয়। আর এখন পাহাড়ের এই বৃষ্টিটাই দেখুন না, কি সুন্দর লাগছে! আপনাদের সমতল এতো সুন্দর বৃষ্টি হয়?’
বুঝতে পারলাম পাহাড় আর সমতলের নিয়ে বাক্‌যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। এতো সহজে সুরভী ছাড়ছে না। এমনিতে পাহাড়ের মানুষরা নাকি একটু একরোখা হয়।
বললাম, ‘হতে পারে পাহাড়ে বৃষ্টির আলাদা একটা রূপ আছে কিন্তু বিশাল সমুদ্রের অনেক উপরে আপনাদের বসবাস আর অন্যদিকে সমুদ্র হলো আমাদের প্রতিবেশী।’
‘সমুদ্র আপনাদের প্রতিবেশী সেটা মানলাম। তবে তাকে কি খুব ভরসা করতে পারেন? সমুদ্রে জলোচ্ছ্বাস হয়। আমাদের পাহাড়কে দেখুন, কি সুন্দর আকাশের কাছে তার বসবাস। আকাশ ভরা তারা আমাদের প্রতিবেশী, হাত বাড়ালেই আমরা আকাশ ছুঁতে পারি। আকাশের জোৎস্ন্যা আগে আমাদের উপরে পরে, তারপর বাকি যেটুকু থাকে সেটা আমরা পাঠিয়ে দিই আপনাদের কাছে।’
হো হো হো করে হেসে উঠি। ‘আপনাদের পাহাড়ের দিয়ে তাকিয়ে দেখুন, কেমন যেন রহস্যময়। আমাদের সমতলের কোথাও কিন্তু কোনও কিছু অজানা নেই। পাহাড়ের ওপারটাও তো আপনার কাছে অজানা। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো পাহাড়ে কারো কাছে পৌঁছতে কষ্ট হয়, অনেক চড়াই উতরে পৌঁছতে হয়।’
‘হতে পারে পাহাড়ের কারো কাছে পৌঁছতে কষ্ট হয়, তবে একবার পৌঁছে গেলে তাকে ছেড়ে যেতেও কষ্ট, কথাটা মনে রাখবেন জনাব।’
কি আরেকটা বলতে চাচ্ছিলাম, থামিয়ে দিল আমাকে। ‘শুনুন ঝগড়া থাক। পাহাড় আর সমতল কখনো এক হবে না, দুজনের আবেগ দু’রকম। আমি পাহাড়ি, পাহাড়ই আমার ভালবাসা। সমতলের মানুষের কাছে পাহাড় হলো সাময়িক বেড়ানোর বিষয়।’
এতক্ষণ কথা হলো। কিন্তু মেয়েটা আমার সম্পর্কে কিছু জানতে চায়নি। রাজকন্যারা কি এরকমই হয়?
‘কতদূর যাওয়া হচ্ছে?’ ভদ্রতার গণ্ডির ভেতর থেকে জানতে চেষ্টা করি। ‘আমি অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছি। পরশু ফ্লাইট।’
‘তাই? পড়তে না থাকতে?’
পড়তে, কোন দুঃখে আমি ভিনদেশে বসবাস করবো? আমার ইচ্ছে, ইন্টারন্যাশনাল রিলেশানের উপরে পড়ে দেশে ফিরে আসবো।
‘তারপর?’
‘তারপর দেখবো পৃথিবীর সবাইকে কীভাবে একটা জাতি হিসেবে একসাথে রাখা যায়।’
ও পথে কথা বলতে ইচ্ছে করলো না, তাই কথা না বাড়িয়ে বলি, ‘আপনার ফ্লাইট কখন?’
‘ফ্লাইট ঢাকা থেকে পরশু, ১২ ঘন্টা ট্রানজিট। তারপর সিডনি।’
‘১২ ঘণ্টা? এতক্ষণ কি করবেন?’ বেশ অবাক হয়েই জানতে চাই।
সুরভী বললো, ‘শুনতে অবাক লাগলেও আমার লম্বা ট্রানজিটের ফ্লাইট ভালো লাগে, এটা আমার একটা পাগলামীও বলতে পারেন, ট্রানজিটে সময় কাটাতে আমার বেশ লাগে।’
আমি সত্যি সত্যি অবাক হই। সবাই যেখানে কম ট্রানজিটের ফ্লাইট চায় সুরভীর পছন্দ লম্বা ট্রানজিট। ‘কারণটা কি জানতে পারি?’
‘আমাদের এ সময়টার কথাটাই ভেবে দেখুন না। কোথাকার কোন আপনি কোন শহর থেকে এসে কোথায় যাচ্ছিলেন এ রাঙার পথ ধরে, আর হঠাৎ এই নানিয়ারচরে এসে আমার সাথে গল্প করছেন। কখনো ভেবেছিলেন কি এরকম কিছু হবে? অথবা ভেবে দেখুন, আমার জন্ম এ রাঙায়, রাজ পরিবারে আর আজ আমি চলছি অস্ট্রেলিয়া, মা-বাবাকে ফেলে। এখন মনে হচ্ছে ওনাদের ঘরটাও একটা ট্রানজিট ছিল। হয়তো অন্য কোন ট্রানজিট পয়েন্টে আবার দেখা হবে তাঁদের সাথে। সত্যি বলতে আমার কেন যেন মনে হয় আমাদের পুরো জীবনটাই হলো ছোট ছোট ট্রানজিট পয়েন্টের সমষ্টিসৃষ্টি। তাই যতটা সময় ট্রানজিটে থাকা যায় ততটাই উপভোগ্য।’
লাইফ ইজ আ জার্নি। মানুষ চলে তার গন্তব্যে আর চলার পথে দেখা হয় সবার সাথে। প্রতিটা দেখা, কথা বলা, একসাথে সময় কাটানো যেন একটা একটা ট্রানজিট পয়েন্ট। ছেলেবেলায় একটা বাসের নাম দেখেছিলাম ‘কিছুক্ষণের মেহমান।’ কি থটফুল নাম। বাসে যাত্রীরা ওঠে, কিছুক্ষণ পর তার গন্তব্যে চলে এলে নেমে পড়ে। কি জীবন! মা-বাবা. ছেলেমেয়ে সবাই যে যার পথ পাড়ি দিচ্ছে আর পথে দেখা মানুষটাকে আপন করে পর মুহূর্ত আবার বিদায় জানাচ্ছে। লাইফ ইজ নট আ জার্নি। ইট ইজ আ ট্রাভেল থ্রু ট্রানজিট পয়েন্টস।
‘এই কোথায় হারালেন?’ সুরভীর কথায় সম্বিত ফিরে এলো। বললাম, ‘হারাইনি, আপনার বলা কথাগুলোই ভাবছিলাম।’ সুরভীকে কথার নেশায় পেয়েছে মনে হয়। বাংলাটা আমাদের মতো বলতে না পারলেও তবে শুনতে খারাপও লাগে না। সংকোচহীন। সুরভী বললো, ‘আরেকটা কথা বলা হয়নি, আমি কিন্তু জার্নিতে কখনও সাথে বই রাখি না। আশপাশের মানুষগুলোকে দেখি। একেকজন একেক ধরনের, কেউ ছুটছে পরবর্তী গন্তব্যের ফ্লাইট ধরতে, কেউ অপেক্ষায়, কেউ কাজ সেরে নিচ্ছে, কেউ কফি খাচ্ছে। আমার এসব দেখতে বেশ লাগে। পরবতী ডেস্টিনেশানে পৌঁছে চলে যাবে আরেক গন্তব্যে। গন্তব্যের তো শেষ নেই।’
‘গন্তব্যের শেষ নেই কথাটা একটু ভুল বললেন’ আমি বললাম।
‘কেমন?’ সুরভী জানতে চাইলে আকাশের দিকে আঙুল তুলে দেখালাম।
‘হাঁ, তা ঠিক, ওখানে পৌঁছানোর জন্যই তো এতোটা পথ চলছি আমরা। সবারই একসময় ওই পথ ধরতে হবে। সেজন্যই আমার ট্রানজিটে আটকে যাওয়া সময় ভাল লাগে। তবে খেয়াল করে দেখেছেন? ছেড়ে যাওয়া ট্রানজিট পয়েন্টগুলো যেন এক একটা জুয়ার টেবিল, যেখানে হারিয়ে যাওয়া প্রিয় মুখ খুঁজি আমরা। মাঝে মাঝে পেয়েও যাই। এই যেমন আজকের পর থেকে আপনি যখনই রাঙায় আসবেন তখন এই সুরভীকে খুঁজবেন। সত্যি বলতে ট্রানজিটে হারিয়ে যাওয়া মুখগুলোতে ভালোবাসা বেশী থাকে, তাই তো ফেলে যাওয়া ট্রানজিটে সেই মুখগুলো খুঁজে মানুষ, তবে সবার ভাগ্যে তা জোটে না।’
কথাটা বেশ, হারিয়ে যাওয়া মুখ ফিরে পাওয়া সবার ভাগ্যে জোটে না ।
কথায় কথায় সময় চলে গেল অনেকক্ষণ। ঝড় থেমে গেছে, বৃষ্টিও নেই। কিছুটা রোদ উঠতেই দু’জনের থেমে যাওয়া পথ দুটো যেন প্রস্তুত হয়ে গেল।
সুরভী নামের একটা মেয়ের সাথে অচেনা এক পাহাড়ে কয়েক মিনিটের পরিচয়টা যে কী গভীর প্রভাব ফেলেছিল ওই সময়ে কলেজ পড়ুুয়া এই ছেলেটার মনে, সেটা বোঝা গেল যখন চাকরির পোস্টিং- এর প্রশ্নে সবগুলো হিলট্র্যাক্ট জেলার মধ্যে যখন আমি রাঙ্গামাটিকেই বেছে নিই।
ওইবারের পরে আমার আর রাঙামাটি যাওয়া হয়ে ওঠেনি, আমিও এক সময় পড়তে চলে যাই দেশের বাইরে। ফিরে এসে জয়েন্ট করি একটা এনজিওতে। যে এনজিওটার মূল লক্ষ্য ছিল দেশের হিলট্র্যাক্টের মানুষদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন নিয়ে কাজ করা।
একদিন দুপুরে আমাকে নিয়ে বাসটা পৌঁছুল রাঙার মেইন বাস স্ট্যান্ডে। কাঁধে ছোট ব্যাগ আর একটা স্যুটকেস নিয়ে বাস থেকে নেমেই চারিদিকে যখন চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিলাম, তখন মনে হলো আমি সুরভীর মুখটাই খুঁজছিলাম। ছেড়ে আসা ট্রানজিট পয়েন্টে ফেলে আসা মুখ ফিরে পেতে বেশ লাগে, সুরভী বলছিল। ‘সুরভী আমি আজ তোমার শহরে, তুমি কি আছো?’ বাতাসে আমার আগমনী সংবাদটা ছেড়ে দিয়ে নিজের পাগলামীতে নিজেই হেসে ফেলি।
একটা সিএনজি নিয়ে পৌঁছে যাই অফিস থেকে আমার থাকার জন্য ঠিক করা ডাকবাংলোয়, নদীর ধারে। আমার কেয়ারটেকার অর্জুন চাকমা জানতো আমি আসছি, যখন ঘরে পৌছি তখন প্রায় বিকেল। পেটে খিদে ছিল বেশ, তাই শুধু হাতটা ধুয়েই খেতে বসি। পাহাড়ি রান্নাকে যতটুকু দেশী করা যায় তার চেষ্টা কার্পণ্য করেনি অর্জুন। খেতে খারাপ হয়নি, পাহাড় আর সমতলে মাঝামাঝি একটা টেস্ট।
‘অর্জুন শোন।’
‘জ্বি বড়সাব।’
‘তোমাদের এখানে ধীরেন চাকমা নামে কোন রাজা ছিলেন?’
‘হা বড়সাব।’
‘উনি কোথায়? আছেন এখনো?’
‘না বড় সাব, অনেক আগে গত হয়েছেন, একটা ছেলে ছিল, উনিও এক রাতে ঘর ছেড়ে গভীরে চলে যায়, আর মেয়েটা চলে যায় পড়তে। তারপর আর কেউ নেই ওখানে। পুত্রের শোকে রানী সাহেবাও বেশীদিন বাঁচেননি।’
এতটা চাপা কষ্ট যে সুরভীর মনে ছিল যেটা বোঝা যায়নি ওই দিন, ওর সাথে কথা বলার সময়। ক্রমেই ক্ষয়ে যাওয়া রাজত্ব দেখতে পারার মত কোন শক্তি তো কোন রাজকন্যার থাকার কথা নয়, হয়তো সে জন্যই সে পালিয়ে যাচ্ছিল।
‘রাতে কি খাবেন বড়সাব?’
‘রাতে আর কিছু খাব না, এ বেলাতেই অনেক খাওয়া হয়ে গেছে।’
‘দোচোয়ানী আর ছোট মাছ ভাজা দেব? সন্ধ্যের পর বারান্দায় বসে খেতে পারবেন, ভাল লাগবে।’
দোচোয়ানী হলো পাহাড়ি মদ। এখানে সবাই সন্ধ্যা হলে বসে পড়ে দোচোয়ানী আর ছোট মাছ ভাজা নিয়ে।
বললাম, ‘অভ্যেস নেই অর্জুন, তুমি বরং এক কাপ চা বানিয়ে দিতে পারো।’
ব্যাগ খুলে, কাপড় গুছিয়ে রেখে একটু ফ্রেশ হতেই সন্ধ্যা।
অর্জুন যেন রোবট, সূর্য ডোবার সাথে সাথে চা নিয়ে হাজির। সাথে বিস্কুট জাতীয় কিছু ।
‘বড় সাব আমার সাথে বারান্দায় আসুন, চা টা ওখানে খাবেন।’
বিকেলে বাসায় পৌঁছানোর পর এ প্রথম বারান্দায় আসা। বারান্দাটা রুমের সাথে লাগোয়া না, রুম থেকে বের হয়ে একটু ঘুর পথে ঘরটার পেছনের দিকে।
অপূর্ব বললেও কম হবে, অপার্থিব দৃশ্য যেন দেখছি। সামনে ৯২ কিলোমিটার লন্বা চাংগী নদীটির শেষ দেখা যাচ্ছে না, তার এক দিকে ফুরেমন পাহাড় আর অন্যদিকে লংগদু। কয়েকটা কান্ট্রি বোট টিম টিম আলো জ্বালিয়ে ফিরে যাচ্ছে। একটা চেয়ার টেনে বসি। অর্জুন পাশের টেবিলে ট্রে রেখে পাশে দাঁড়িয়ে থাকে।
চা জিনিসটা আমার কাছে অদ্ভুত লাগে। তিনটা মাত্র উপকরণ, চ াপাতা, পানি, আর দুধ কিন্তু একজনের বানানো চায়ের সাথে আরেকজনের বানানো চায়ের কখনই মিল হয় না। তাই চায়ের ব্যাপারে আমি দেখি কতটা দরদের সাথে বানানো হয়েছে। দরদ ছাড়া বানানো চা আর গরম পানি খাওয়া একই কথা।
অর্জুনের সেদিনের চা-টা বেশ হয়েছিল।
আমি একটা চুমুক দিয়ে দূরে ঝলমলে আলোজ্বলা একটা লম্বা ব্রিজ দেখিয়ে বললাম, ‘ওটা কোন ব্রিজ।’
‘বড়সাব শুনেননি?’ অর্জুন খানিকটা অবাক হলো মনে হলো, ‘এটা তো এখানের পদ্মাসেতু বলা হয়, নানিয়ারচর ব্রিজ কালকেই উদ্ভোধন হবে, সেজন্য সাজানো হয়েছে।’
নানিয়াচর নামটা কানে না বাঁজার কোন কারণ নেই। এখানেই তো সুরভীর সাথে দেখা, পরিচয়।
‘বড়সাব কাল বিকেলে প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করবেন, সময় থাকলে ঘুরে আসতে পারেন।’
আলোতে ঝলমলে নানিয়ারচর ব্রিজটি দূর থেকে নদীর নীল পানির উপর আলোর একটা সিঁদুরের মত লাগছিল। রাঙার জীবন আস্তে আস্তে বেশ সুন্দর হয়ে যাচ্ছে, ভাবতে বেশ লাগে।
পরদিন সকালে অফিসে সময়মত পৌঁছে যাই। নতুন বড়কর্তা আসবেন, সেটা সবাই জানতেন। পরিপাটি অফিস, ধুপধুরস্তর কাপড় আর ফুলের আয়োজন অন্তত সেটা বলে দেয়। যারা রাঙামাটিতে কাজে আসেন তারা কাজের প্রেমে পড়ার আগে প্রথমে রাঙার প্রেমে পড়ে আর তারপর এখানকার মানুষগুলোর। তাই এখানকার মানুষরা কাজটা খুব আনন্দ নিয়ে করে। অফিসে প্রথমদিন, তাই সবার সাথে পরিচয়পর্ব শেষ করে, কাজটাজ বুঝে নিয়ে যখন দুপুর তখন সবাইকে বললাম, ‘চলুন আজ দুপুরে একসাথে খাওয়া যাক।’
সবাই বেশ অবাক হলো কথাটা শুনে। বড়কর্তার সাথে একসাথে খাবে? একসাথে খাওয়ার সংকোচটা বুঝতে পারলাম। আমার প্রথম থেকেই ইচ্ছে, যেখানে কাজ করি না কেন কাজের জায়গায় দুটো জিনিস করবো। এক. খাওয়াটা একসাথে হতে হবে, এতে নিজেদের মধ্যে সম্পর্কটা আরো দৃঢ় হয়। আমি খেয়াল করে দেখেছি সেই সব মানুষরা আমার খুব কাছের হয়েছে যাদের সাথে আমি কোন এক সময় একসাথে খেয়েছিলাম, খাওয়া শেয়ার করেছিলাম। আর দুই. অফিসের খাওয়ার জায়গাটা যেন নিজের বাড়ির চেয়েও সুন্দর হয়। এই খাওয়ার জন্যই তো এই কাজ, এই কষ্ট, তবে খাবার জায়গাটা ভাল হবে না কেন?
খাবার সময়ে সবার গল্প শুনলাম, খুব আবেগ নিয়ে ওরা কথাগুলো বলছিল। যেন অনেকদিন কেউ ওদের কথা শোনেনি। নানিয়াচর ব্রিজের কথা বললো, বেশ খুশী দেখলাম। রাজা ধীরেন চাকমার কথা বললো। ওঁদের এখনো বিশ্বাস সুরভী চাকমা অথবা তাঁর ভাই একদিন আবার রাঙায় ফিরে আসবে।
বিকেলে কাজ শেষে পথ চিনে অনেকটা পথ হেঁটে চলে এলাম নানিয়াচর ব্রিজের কাছে। একটু পর ভিডিও কন্‌ফারেন্সের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করবেন। অনেক মানুষ ফুল, বেলুন আর লাল সবুজে সাজানো ব্রিজটা প্রথমবারের মতো পাঁয়ে হেঁটে পার হবার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে ।
ব্রিজের যে দিকে দাড়ালে নদী পাহাড় আর আকাশ একসাথে দেখা যায়, আমি ঐদিকটিতে দাঁড়িয়ে।
‘একটু সরবেন প্লিজ, ভিড়ের মধ্যে কে যেন আমাকে হাতের কনুই দিয়ে একটু ঠেলে জায়গা করে নিতে চাইছে, ফিরে দেখলাম এক পাহাড়ি মেয়ে। প্রথম দেখায় বুঝতে পারিনি। একটু কি সুরভীর মত লাগলো! আবার দেখলাম। সুরভীই তো। তবু মনে শঙ্কা নিয়ে আস্তে করে ‘সুরভী’ নামটা মুখে আনতেই মেয়েটা চমকে ফিরে তাকালো আমার দিকে। কয়েক সেকেণ্ড বেশকিছু স্মৃতি হাতড়ে মনে হয় চিনতে পারলো আমাকে। তবে মুখে খুশির ছটা দেখে মনে হলো আমার মতো ও যেন হাজারো ট্রানজিট পয়েন্টে এতোটা বছর আমাকেই খুঁজেছিল।
‘আপনি? কেমন আছেন? আবার দেখা হয়ে গেল। কতদিন পর!’
‘হুম, অনেকটা সময় পর। খুব একটা বদলাননি।’
সুরভী, যে একদমই বদলায়নি সেটা ভুল। আমিও বদলে গেছি বেশ। এতো সহজে চিনতে পারার কথা নয় কিন্তু। আশ্চার্য দুজনের একদমই অসুবিধা হয়নি চিনতে একজন আরেকজনকে। তবে কি আমার মতো সুরভীও ঐদিনের ক্ষুদ্রক্ষণের স্মৃতিকে ধূসর হতে দেয়নি?
‘এখানে কেন?’
‘রাঙায় কর্মসূত্রে, আর এখানে কারণ ব্রিজটার নাম নানিয়ারচর ব্রিজ। বুঝতেই পারছেন নামটার প্রতি আমার একটু দুর্বলতা আছে,’ বলে মুচকি হাসি।
‘আচ্ছা তাই?’ সুরভী আমার কথার মানে ধরতে পেরে একটু হেসে বললো, ‘আমাদের ট্রানজিট পয়েন্টের নাম তাহলে নানিয়ারচর।’
‘সেটাই তো দেখছি। তবে সমস্যাটা কি জানেন রাজকন্যা, আপনি কিন্তু আমার নামটা এখনো জানেন না।’
‘নামটা জানা কি খুব জরুরি ছিল।’
‘জরুরি নয় কি? কীভাবে খুঁজে বের করতেন তাহলে?’
‘এই যে আজ যেভাবে পেলাম, আমি জানতাম এরকম কোন একক্ষণে দেখা হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে আমি সব সময় থ্রি কার্ডসের ব্লাইন্ড গেম খেলি।’
শুনতে পেলাম মাইকে কাউন্ট ডাউন শুরু হয়ে গেছে, একটু পর খুলে দেওয়া হবে রাঙার সবচে সুন্দর ব্রিজটি, নতুন ব্রিজ, কারো পা পড়েনি, কোন গাড়ি পার হয়নি এখন অব্দি।
ব্রিজ, পুল, সেতু, সাঁকো কিংবা কালভার্ট এর জন্ম হয় প্রাপ্তির সন্ধানে। অবস্থান আর আয়তনভেদে এক এক নামে ডাকা হলেও নির্দ্ধিধায় সে-তার বুকটা পেতে দেয় মানুষকে কোন বৈরি স্থান পার হতে। দুটো ট্রানজিট পয়েন্টকে মিলিত করা ব্রিজ কিংবা সাঁকোর এক প্রান্তে থাকে প্রাপ্তির সন্ধান। অন্য প্রান্তে থাকে ফিরে আসার আবেগ আর সেটা নির্ভর করছে সাঁকোর কোন প্রান্তে আপনার বসবাস।
কাউন্টডাউন শেষ, ব্রিজ খুলে দেওয়া হলো, সবাই চলতে শুরু করলো, খরস্রোতা চাংগী নদীর উপরে নানিয়ারচর ব্রিজটার একপাশে আমি দাঁড়িয়ে, সাথে অনেক বছর আগে কোন এক ক্ষণে পরিচিত এক পাহাড়ি রাজকন্যা, যে হয়তো একটু পর আবার হারিয়ে যাবে আগের মত, হয়তো আবার এক যুগ পরে দেখা হবে এরকম কোন এক ক্ষণে!

কাঁধে ছোট ব্যাগ আর একটা স্যুটকেস নিয়ে বাস থেকে নেমেই চারিদিকে যখন চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিলাম, তখন মনে হলো আমি সুরভীর মুখটাই খুঁজছিলাম। ছেড়ে আসা ট্রানজিট পয়েন্টে
ফেলে আসা মুখ ফিরে পেতে বেশ লাগে, সুরভী বলছিল।
‘সুরভী আমি আজ তোমার শহরে, তুমি কি আছো?’ বাতাসে আমার আগমনী সংবাদটা ছেড়ে দিয়ে নিজের পাগলামীতে
নিজেই হেসে ফেলি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅপেক্ষার ছাই
পরবর্তী নিবন্ধউত্তর কাট্টলীতে দুদিনব্যাপী বই মেলা শুরু