নতুন পাঠকের কাছে যে ইশারা নিয়ে হাজির হন ওমর কায়সার

আহমেদ মুনির | শুক্রবার , ১ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ at ৬:০২ পূর্বাহ্ণ

ওমর কায়সারের নতুন কোনো কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের পরপরই পড়ি। তবে তাঁর কবিতা পড়তে গিয়ে আমার কিছু অসুবিধা হয়। অসুবিধা বা সমস্যাটা এই যে, প্রকাশিত কোনো কবিতা পড়তে গেলেই মনে হয় আগেই পড়েছি। হয়তো লেখার অব্যাহতি পরেই, কম্পিউটার কম্পোজ করা (এখন তিনি হাতে লেখেন না) নতুন কবিতাটি আমাকেই প্রথম পড়িয়েছেন তিনি। তাই ফের ছাপা কবিতা পড়তে গেলে মনে হয়, এটা অন্য কোনো বইতে নেই তো? এমন বিভ্রমের কারণ আমাদের দীর্ঘদিনের নৈকট্য বা সাহচর্য। তারুণ্যদীপ্ত এই কবি আমার দীর্ঘ তিন দশকের সুহৃদ, বড়ভাই, বন্ধু আর বর্তমানে সহকর্মী।

১৯৮৮ সালে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রাগৈতিহাসিক দুঃখ যখন প্রকাশিত হয়, সে সময় আমি অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর পুরোনো বইয়ের দোকানে অচিরা পত্রিকার কয়েকটা সংখ্যার সঙ্গে ওমর কায়সারের বইটা পেয়েছিলাম। সেটা ১৯৯৭৯৮ সাল হবে। পুরোনো বইয়ের ধুলোমলিন তাকের পাশে দাঁড়িয়ে আমি প্রথম যে কবিতাটি পড়ি তা ছিল, ‘লিলি গাঙ্গুলি পাখি নয়’। কবিতাটি পড়েই মুগ্ধতায় আচ্ছন্ন হয়েছিলাম। বাঙালি পাঠকের কাছে নিটোল প্রেমের কবিতার আবেদন কখনো ফুরাবে না। এই কবিতাও সেভাবে পাঠকের হৃদয়ে স্থান করে নেবে। পড়া যাক এর চুম্বক অংশ।

লিলি গাঙ্গুলি পাখি নয়

তাই তার গান শুনতে পেয়েছিলাম খুব কাছাকাছি থেকে

পাখিরা শোনায় গান দূর থেকে

আর অরণ্যে সে আমাকে শুনিয়েছিল গান পাশাপাশি হেঁটে

পাতার জড়তা ভাঙতে ভাঙতে পাখির স্বভাবে।

তার নখ নিখুঁত রক্তিম

তাজা কোন শালিখের রক্ত দিয়ে মাখা

পোষা কোন টিয়ের মত তার গায়ে বাঁধা ছিল রূপোর নূপুর।’

(লিলি গাঙ্গুলি পাখি নয়, প্রাগৈতিহাসিক দুঃখ, ১৯৮৮)

ওমর কায়সারের ১০টি কাব্যগ্রন্থে প্রেমের অনুষঙ্গ একটা বিশেষ জায়গা জুড়ে রয়েছে। তাঁর কাব্য দর্শনের প্রধান ঝোঁকও রোমান্টিকতায়। প্রেম ও মৃত্যুর খোলস ছাড়াতে ছাড়াতে মাঝে মাঝে আত্ম অনুসন্ধান করেছেন। চোখ ফিরিয়েছেন ইতিহাসের নানা বাঁকে। বর্তমান সময়ের যুদ্ধ দীর্ণ পৃথিবীর সঙ্গে সংলাপ করেছেন তিনি। তবু ওমর কায়সারের চার দর্শকের দীর্ঘ সৃষ্টিশীল পথটা এতটা সরল নয় যে এক লাইনে তাকে ব্যাখ্যা করা যাবে। বাংলা কবিতার সামগ্রিক উত্তরাধিকারই তিনি বহন করে চলেছেন।

তবে মাইকেল মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দের কবিতা বিশ্বকে ধারণ করেও পূর্ববঙ্গ অর্থাৎ স্বাধীন বাংলাদেশের কবিতা যেন ভিন্ন চেহারায় দেখা দিল। পশ্চিম বাংলার কাব্যভাষা থেকে তা অনেকটাই আলাদা। যুদ্ধ, দারিদ্র্য আর বিপ্লবের স্বপ্নের পাশাপাশি পূর্ব বাংলার গ্রামীণ জীবন, জলহাওয়া, জন্ম দিল নতুন এক কাব্যভাষার। এই জন্মক্ষণের একটা উজ্জ্বল ছবি যেন পাওয়া যায় শহীদ কাদরীর কবিতায়।

জন্মেই কুঁকড়ে গেছি মাতৃজরায়ন

থেকে নেমে

সোনালি পিচ্ছিল পেট আমাকে

উগ্রে দিল যেন

দীপহীন ল্যাম্পপোস্টের নিচে…’ (উত্তরাধিকার, শহীদ কাদরী)

শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, আবুল হাসান, রফিক আজাদ, মোহাম্মদ রফিক, নির্মলেন্দু গুণ সেই দীপহীন ল্যাম্পপোস্টকে নতুনভাবে আলোকিত করলেন। হয়ে উঠলেন নতুন বিশ্বের কবি। সেই কবিতাবিশ্ব ঘিরে জন্ম হলো আরও অনেক ছোট ছোট অণু বিশ্বের। আর এভাবেই বাংলাদেশের কবিতা তার বিচিত্র পথরেখা তৈরি করল।

কিন্তু বাংলাদেশের কবিতা বলতে যারা কেবল রাজধানী ঢাকাকেন্দ্রিক সাহিত্যের ধারাকে বোঝেন, তারা এই ভূখণ্ডের কবিতার বৈচিত্র্যকে অস্বীকার করেন প্রকারান্তরে। চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী কিংবা বগুড়ায়ও এ দেশের কবিতা স্বাতন্ত্র্য ধারা তৈরি করে নিয়েছে সেই সত্তরের দশকেই।

তবে সিলেট বা চট্টগ্রামের কবিতা বলে পৃথক কোনো সাহিত্যধারার অস্তিত্ব নেই। তা না থাকলেও সেসব অঞ্চলের সাহিত্য আন্দোলনের নিজস্ব একটা বৈশিষ্ট্য ছিল। চট্টগ্রামের অচিরা পাঠচক্রের মধ্য দিয়ে আশির দশকে আবুল মোমেন, শাহীদ আনোয়ার, বিশ্বজিৎ চৌধুরী, জ্যোতির্ময় নন্দী, ওমর কায়সার, তপনজ্যোতি বড়ুয়া নিজেদের আলাদা স্বর তৈরি করেছেন কবিতায়। এর সমসাময়িক ঢাকার গান্ডীব আন্দোলনের চেয়ে তা অনেকখানিই স্বতন্ত্র ছিল।

অচিরা গোষ্ঠীর কবিদের অনেককেই পরবর্তীকালে সমানতালে সক্রিয় দেখা যায়নি। এদের মধ্যে বিশ্বজিৎ চৌধুরী কথাসাহিত্যকেই এখন তাঁর প্রকাশের মাধ্যম করে নিয়েছেন। শাহীদ আনোয়ারের মতো শক্তিমান কবি অবশ্য মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লিখে গেছেন। কবি ওমর কায়সার এই গোষ্ঠীর কবিদের মধ্যে সবচেয়ে মুখর বলা যায়। গত চার দশকে তিনি লিখে গেছেন অবিরাম।

১৯৮৮ সালে প্রকাশিত হয়েছিল ওমর কায়সারের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রাগৈতিহাসিক দুঃখ’। এরপর একে একে প্রকাশিত হয়েছে ১০টি কাব্যগ্রন্থ। প্রত্যেক পর্বেই ওমর কায়সার একটু একটু করে বদেলেছেন। নিজেকে ভেঙে এগিয়ে গিয়েছেন।

বলা যায় প্রথম কাব্যগ্রন্থেই ওমর কায়সার নিজেকে জানান দিয়েছিলেন। আলোচিত না হলেও ‘প্রাগৈতিহাসিক দুঃখ’ সামপ্রতিক সময়ের একটি উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ।

ওমর কায়সারের দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘প্রতিমাবিজ্ঞান’ প্রকাশিত হয় ২০০১ সালে। প্রথম কাব্যগ্রন্থের এক যুগেরও বেশি সময় অর্থাৎ ১৩ বছর পর। এই দীর্ঘ যতির পর দ্বিতীয় কবিতার বইয়ে আমরা অন্য এক কাব্যদর্শন পাই। যৌবনের উচ্ছ্বলতা পেরিয়ে যেখানে কবি কেবল আত্ম অনুসন্ধান করেছেন। জাতিস্মরের মতো নিজের পূর্বজন্মের স্মৃতি রোমান্থন করেছেন। আবিষ্কার করেছেন অখণ্ড এক ভারতীয় আত্মা।

মাথা তুলে উঠে এসো মগ্ন জাতিস্মর।

বৈদিক হৃদয় জুড়ে তোমার প্রশস্ত পথে

আর্যের রমণী আজো হাঁটে,

অনন্ত বন্ধুর কাল, দস্যুপরিবেষ্টিত হরপ্পার বিজন প্রদোষ।

শতভূজি, অশ্মময়ী, আয়সীনগর আজ শত্রু অধ্যুষিত।

তাদের সকল রীতি ভিন্ন,

তাদের সকল নীতি ভিন্ন

ইন্দ্রের দাপটে দেখ থেমে গেছে সিন্ধুর কল্লোল।

সিন্ধু সভ্যতার এ অন্তিমকালে

আরেকবার উঠে এসে লিখে রাখ আরেকটি ঋদ্ধ ঋগ্বেদ।

(মগ্ন জাতিস্মর, প্রতিমাবিজ্ঞান)

আত্মপরিচয়ের যে সংকটে উপমহাদেশের মানুষ আজ জর্জরিত, সেখানে কবি চিনিয়ে দিচ্ছেন, কোথায় আমাদের শুরু। ভারতীয় পরিচয় মুছে ফেললে বাঙালি বা বাংলাদেশি বলতে কিছুই যে থাকে না সেই সত্য সংকীর্ণ রাজনীতির নিচে চাপা পড়ে গেছে।

আত্মপরিচয় প্রশ্নে কেবল ভারতীয় আত্মার সন্ধান করেননি ওমর কায়সার। প্রতিমাবিজ্ঞানের পর তাঁর পরবর্তী কাব্যগ্রন্থগুলোতে তিনি নিজের শেকড় সন্ধান করেছেন জন্মভূমি চাটগাঁর মাটিতে। আশ্রয় খুঁজেছেন চাটগাঁর জল হাওয়ায় সিক্ত মায়ের আঁচলে। অন্য এক ঘরের কাব্য রচিত হতে থাকে তাঁর হাতে। যেখানে মায়ের মুখের লোকজ ছড়ায় ভর করে পাঠক পৌঁছে যায় অন্য এক দার্শনিক অনুভবে।

বাস্তুসাপও পালিয়ে বেড়ায়’(২০০৫) কাব্যগ্রন্থে এর এক ইশারা পায় পাঠক। চিহ্নিত হয় নতুন এক কাব্যভূমির।

এখানে কখনো কি একবার আনন্দিত সন্ধ্যা নেমেছিল?

ডেকেছিল ভোর উচ্ছ্বসিত ডানার আমেজে?

তবু গান হয় বাউলের

ঘুমন্ত শঙ্খের তীরে

অজাত ভোরের আর্তনাদে, যেখানে মানুষ পোড়ে

আর সভ্যতার ধুলোভস্ম ওড়ে।’ (বাউল, বাস্তুসাপও পালিয়ে বেড়ায়)

এভাবে হরপ্পার বিজন প্রান্তর থেকে শঙ্খ নদের তীরে এসে পৌঁছায় পাঠক। ‘বাস্তুসাপও পালিয়ে বেড়ায়’ কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের তিন বছর পর ২০০৮ সালে প্রকাশিত ‘প্রাচীন প্রার্থনাগুলো’ বইতে কবির শেকড় সন্ধানী যাত্রা আরও গভীরে পৌঁছায়। চাটগাঁর লৌকিক মন ও মননের সঙ্গে আধুনিক নগরবাসীর সংলাপ আবিষ্কার করে পাঠক।

ঘরে হাসে, ঘরে কাঁদে

ঘরে মানুষ তোয়ায়

সুন্দর ঘরগান ছাড়ি গেলগোই

আঁ’র উগ্‌গা পোয়ায়।

(ঘরেরও হাসিকান্না আছে, মানুষ খোঁজে। কী সুন্দর ঘর ছেড়ে চলে গেল আমার সন্তান)

ঘরের ভেতর আমি ঢুকব কীভাবে। আমার ভেতর ঘর ঢুকে আছে বহুকাল আগে। আমার নিজের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে সে তো অজস্র জনম ধরে। পৃথিবীর কোথাও তাকে খুঁজেও পাই না।’ (যেভাবে ঘরের কাব্য রচিত হয়, প্রাচীন প্রার্থনাগুলি)

এ কথা দ্বিধাহীনভাবে বলা যায় ওমর কায়সারের এই নিরীক্ষা বাংলা কবিতায় বহুদিন আলোচনার বিষয় হয়ে থাকবে। তবে কেবল নিরীক্ষার মধ্যেই থেমে থাকেননি তিনি। তার দীর্ঘ সৃজনযাত্রায় দৈনন্দিন রাজনৈতিকসামাজিক সংকট বারবারই এসে হাজির হয়। নিমগ্নতা ঝেড়ে ফেলে সোজাসাপ্টা কথা বলতেও দ্বিধা করেন না তিনি। পাঠকের মনে পড়বে ইংরেজ কবি ম্যাথিউ আর্নল্ডের সেই উক্তির কথা। যেখানে তিনি বলেছেন, কবিতা বস্তুত জীবনের সমালোচনা। এ কথাকে আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে দাঁড়ায়, কবিতাই জীবন বা জীবনযাপনের এক অনুপম আখ্যান।

২০০৮ সালের পর প্রায় এক যুগের বিরতির পর পঞ্চম কাব্যগ্রন্থ ‘আমিহীন আমার ছায়াগুলো’ প্রকাশিত হয় ২০২০ সালে। ৪৭টি কবিতা নিয়ে এই সংকলন পাঠকের কাছে নতুন কোনো বিস্ময় নিয়ে হাজির হয়নি। কেবল প্রণয় আবেগ আর রোমান্টিক বিহ্বলতায় ভেসে যাওয়া দেখেছে পাঠক। নতুন বিষয়আঙ্গিক না থাকলেও বাহুল্য বর্জিত একটা নতুন ভাষার ইশারা পাওয়া যায়।

২০২২ সালে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘দস্যু বনহুরের মতো’ পাঠ করে ভিন্ন প্রতিক্রিয়া হয় পাঠকের। এ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় জারিত হয়ে আরও সংকেতময়তা আর নিমগ্নতা নিয়ে হাজির হয়েছে।

আমার অতীত ছিল কোনো এক নিশ্চিন্দিপুর

ভুলে যাওয়া মানচিত্রে দেখি গল্পের কোন কোন বাঁকে

খুন ঝরা নদীটির স্রোত গড়িয়ে গড়িয়ে গেছে কতদূর।

আমিও নিমগ্ন হবো রহস্যভেদে

কাশবনে কোন হাওয়া চুরি করে এনেছিল মহুয়ার ঘ্রাণ।

ভিখিরি পাখির কণ্ঠে বিলি করে দেব বলে

বিকেলের রং থেকে লুট করে নেব সুর

মনে রেখ

আমার নায়ক ছিল দস্যুবনহুর (দস্যু বনহুরের মতো)

৪৬টি কবিতার এই সংকলনের কবিতাগুলোতে বাহুল্য নেই। নেই অতি আবেগ আর প্রগলভতা। প্রকৃতি এখানে আরও রহস্যময় হয়ে উঠেছে। ভোরের স্নিগ্ধ কুয়াশার মতো অনচ্ছ পর্দা সরিয়ে দেখতে হয় তাকে।

ছোট ছোট মেঘ এসে ভিজিয়ে দিয়েছে

কুমারী দ্বীপের ঘাস

বাছুরের ক্ষুরধ্বনি স্পষ্ট হওয়ার আগে

প্রার্থনায় মগ্ন গাছেদের ফাঁক গলে

নেমে গেছে বকুলগোধূলি।

কিছুটা পরাগ ছড়ানোর বাকি ছিল বলে

ত্রস্ত প্রজাপতি

আলো ভিক্ষা চেয়েছিল জোনাকির কাছে।

পান সুপারির বনে ধীরে ধীরে

তখন গড়িয়ে পড়ে অন্ধকার।

এই সব দৃশ্যমান ছবি

একজোড়া নীল চোখে বন্দী হয় তারার মেজাজে।

ওখানে আমার স্পর্শ কখনো লাগেনি

তবু তার ভ্রমণকাহিনি গান হয়ে ভাসে

ঝোঁপে ঢাকা গরুলুটা খালের ওপারে।

সে গান রচিত হবে রাত্রিভর

তার সুর কীভাবে যে ভুলি।’

(গরুলুটা খালের ওপারে, দস্যু বনহুরের মতো)

২০২৩ সালে প্রকাশিত হয় কবির সর্বশেষ কাব্যগ্রন্থ ‘ঋতুচক্র থেমে গেলে’। এই কাব্যগ্রন্থেও হিরের দ্যুতি ছড়ানো কবিতার সন্ধান পায় পাঠক। তিন পর্বে বিভক্ত এই কাব্যগ্রন্থে ওমর কায়সার আরও সংহত করে তুলেছেন তাঁর কাব্যভাষা। যেন এক ধ্যানমগ্ন কবির দেখা পাই এই বইতে। যেখানে অনুচ্চস্বরে কবি মন্ত্রপাঠের মতোই প্রকৃতি আর জীবনের সঙ্গে গূঢ় সংলাপ চালিয়ে গেছে। ৪৮ পৃষ্ঠার এই কাব্য ভ্রমণে পাঠক ইন্দ্রিয়গোচর পৃথিবীর বাইরের অন্য এক জগতের সন্ধান পাবেন।

চৈত্র সংক্রান্তির দিনে তোমাদের জানালার পাশে

অতীব বেগুনি ফুল নীলকান্ত ফোটার সময়

দূরের বাতাস এসে ছিনিয়ে নিয়েছে তার

সমস্ত সৌরভ।

জানি এ বেদনা শুধু প্রকৃতির।

বছর মূলত যায় ফুলের গন্ধের শোকে

ঋতুচক্র থেমে গেলে

তবুও সেদিন সূর্যাস্তের শোকগ্রস্ত কালে

একটা বছর টুপ করে ডুবে গেল সমুদ্রের জলে।’ (ঋতুচক্র থেমে গেলে)

অনেক জ্যেষ্ঠ কবিদের মাঝে পুনরাবৃত্তির যে দোষ দেখা যায়, তা ওমর কায়সারের ক্ষেত্রে নেই বললেই চলে। নিজের মৌলিক স্বর অক্ষুণ্ন রেখেই বারবার নতুন নতুন কাব্যভূমি উন্মোচন করেন তিনি। ছাপিয়ে গেছেন নিজেকেই।

এই কাব্যগ্রন্থের কয়েক লাইনের কবিতার সিরিজ ‘সামান্য কথার ফুল’ পড়লেই বোঝা যায় এসময়ে এসেও নিজেকে ভেঙে দেখতে চাওয়ার আকুল আগ্রহ হারিয়ে যায়নি কবির।

মানিকছড়ির পাহাড় থেকে আকাশ খুব একটা কাছে নয়,

তবে আকাশের কিছু গান এখানে কানের কাছে শিষ দিয়ে যায়।’

রাত্রির মাত্র বিশ শতাংশকে জেনেছি। বাকিটুকু অন্ধকারে থাক আমার নীলিমা। কয়েকটি উল্কা কানের কাছে পতনের ধ্বনিতে ফিসফিসিয়ে বলে গেল, ফেরারী সকালেরা এখনো অপেক্ষায় আছে কুয়াশার ভেতর।’

.

মুখাগ্নি করে চলে গেলে

সেই চিতা এখনো জ্বলছে

ছাই হয়ে মিশে যাব বাতাসের সঙ্গে

তারপর তোমার কানের কাছে

শিষ দিয়ে যাব।’ (সামান্য কথা ফুল, ঋতুচক্র থেমে গেলে)

ষাট পেরিয়ে ওমর কায়সার নিজের সৃষ্টির পথ ধরে হাঁটছেন। পেরিয়ে যাচ্ছেন আশ্চর্য সব বিস্ময়ভূমি। এই পরিভ্রমণ কিংবা কবিতাযাপনই তাঁর কবিতার মূল শক্তি। এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় বাংলাভাষী পাঠকের কাছে তাঁর সৃষ্টিসম্ভার টিকে থাকবে। উল্লেখযোগ্য বলেই বিবেচিত হবে তাঁর অনেক কবিতা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে
পরবর্তী নিবন্ধঅবিনশ্বর নজরুল