অবিনশ্বর নজরুল

এস ডি সুব্রত | শুক্রবার , ১ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ at ৬:০৩ পূর্বাহ্ণ

সব বেদনা উপেক্ষা করে অসুস্থ হওয়ার আগ পর্যন্ত লিখে গেছেন দু’হাত উজাড় করে। বাংলা সাহিত্যে দিয়ে গেছেন তাঁর মূল্যবান লেখা কবিতা, গল্প, উপন্যাস আর গান ।

কথা সবার জানা ছোটবেলা থেকে দুঃখের সঙ্গে যুদ্ধ করে তাকে বাঁচতে হয়েছিল বলে কাজী নজরুল ইসলামের আরেক নাম দুখু মিয়া। ছোট ছেলেটির গায়ের রং শ্যামলা। বড় বড় দুটি চোখে বিস্ময়ভরা চাহনি। ভীষণ চঞ্চলতা চোখেমুখে। দুঃখ কষ্টের মধ্য দিয়ে বড় হয়েছিলেন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। অন্যায় অবিচার ও জুলুমের বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন সর্বদা। নজরুলের জন্ম ১৮৯৯ সালের ২৪ মে অবিভক্ত ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে। নজরুলের বাবা কাজী ফকির আহমেদ গ্রামের মসজিদে ইমাম ছিলেন। মায়ের নাম ছিল জাহেদা খাতুন। সেসময় পুরো উপমহাদেশ ছিল ব্রিটিশ শাসনে। নজরুলের পূর্বপুরুষরা সিপাহি বিদ্রোহের সময় ইংরেজবিরোধী ছিলেন। তাই মোগল আমলে অভিজাত হওয়া সত্ত্বেও সিপাহি বিদ্রোহের পর তারা খুবই খারাপ অবস্থায় পড়ে যান।

অভাবের সংসারে নজরুলের জন্ম এবং শৈশব কেটেছে অভাবের মধ্যে। গ্রামের মক্তবে নজরুলের পড়াশোনা শুরু হয়। মাত্র ৯ বছর বয়সে তাঁর বাবা মারা গেলে দুঃখদুর্দশা আরও বেড়ে যায়। দশ বছর বয়সেই তাকে লেখাপড়া ছেড়ে আয়ের পথ খুঁজতে হয় পরিবার চালাতে গিয়ে। তিনি সেই মক্তবেই ছাত্র পড়ানো শুরু করলেন। গ্রামে হাজী পালোয়ানের মাজারের খাদেম আর মসজিদের মুয়াজ্জিন হলেন। নজরুলের এক চাচা ছিলেন লেটো দলের ওস্তাদ। লেটো দল গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে গান গেয়ে, নাটক দেখিয়ে টাকা রোজগার করে। চাচার প্রভাবে দুখু মিয়া ভিড়ে পড়লেন সেই লেটোর দলে। এখানে তাঁর বেশ সুনাম হল। তাঁর লেখা ও সুর করা গানগুলো শ্রোতা দর্শকদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়তা পেল।

দুঃখের গানে সবাই মুগ্ধ হত। পরে নিজেই লেটোর দলের ওস্তাদ হলেন। সংসারের অভাব অনটনের জন্য অর্থ রোজগার করতে হলেও দুখুর স্কুলে পড়ার খুব ইচ্ছা। নজরুল লেটোর দল ছেড়ে স্কুলে ভর্তি হলেন। রানিগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুলে পড়লেন কিছুদিন। তারপর ভর্তি হলেন মাথরুন হায়ার ইংলিশ স্কুলে। স্কুলের প্রধান শিক্ষকসহ অন্য শিক্ষকরা তাঁকে বেশ পছন্দ করতেন। কিন্তু দুখুর দুঃখের যেন শেষ নেই। ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর তাঁকে আবার রোজগারে নামতে হল । এরপর যোগ দিলেন বাসুদেবের কবিগানের দলে। কবিগানের দলে মুখে মুখে কবিতা বানিয়ে দর্শকশ্রোতাদের শোনাতে হয়। দুই দলের মধ্যে কবির লড়াইও চলে। কবিগানের দলে দুখু বেশ নাম করলেন। এরপর রেলওয়ের একজন গার্ডের গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করলেন কিছুদিন। সেই কাজ ছেড়ে আরেকটু বেশি রোজগারের জন্য আসানসোলে রুটির দোকানে কাজ নিলেন। এত কষ্টেও ভেঙে পড়েননি দুখু। রুটির দোকানে কাজ করতেন আর ছড়া কবিতা লিখতেন। ১৯১৪ সালে এই দোকানে কাজ করার সময় আসানসোলের দারোগা রফিকউল্লাহর সাথে পরিচয় ঘটে । নজরুলের ছড়া কবিতা শুনে রফিকউল্লাহ বুঝতে পারলেন ছেলেটি প্রতিভার বিষয়ে। তিনি দুখুকে নিয়ে এলেন ময়মনসিংহের ত্রিশালে এবং দরিরামপুর স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি করে দিলেন। দূরে ত্রিশালে তাঁর মন ভালো লাগত না। একা একা গ্রামে ঘুরে বেড়াতেন। ১৯১৫ সালে তিনি ফিরে এলেন রানীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুলে। ভর্তি হলেন অষ্টম শ্রেণিতে। ১৯১৭ সাল পর্যন্ত এখানেই লেখাপড়া করলেন। মাধ্যমিক পরীক্ষার সময় হওয়ার আগেই সুযোগ পেলেন সেনাবাহিনীতে । তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছিল। সৈনিক হিসেবে যোগ দিয়ে যুদ্ধে চলে গেলেন দুখু। পুরো শৈশবকৈশোর এভাবেই দুঃখের সঙ্গে লড়াই করেছেন। তবে হাল ছাড়েননি। আর কবিতা লেখাও ছাড়েননি। পরবর্তী জীবনেও তাঁকে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। আর্থিক কষ্ট ছিল। ছিল অনেকের তুচ্ছতাচ্ছিল্য। তবু চালিয়ে গেছেন লেখালেখি। শিশু কিশোরদের জন্য অনেক কবিতা লিখেছেন তিনি। জীবনে অনেক দুঃখ কষ্ট পেলেও মানুষের ভালোবাসাই দুখু মিয়াকে সব দুঃখ কষ্ট জয় করার প্রেরণা দিয়েছিল। বড়দের জন্যও লিখেছেন অনেক লেখা। লিখছেন কালজয়ী গান ও কবিতা। নজরুলের গান ও কবিতা আজও আমাদের সাহস দেয়, শক্তি যোগায়। নজরুলের কবিতা গান আমাদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে শেখায়, অসামপ্রদায়িক হতে শেখায় ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধনতুন পাঠকের কাছে যে ইশারা নিয়ে হাজির হন ওমর কায়সার
পরবর্তী নিবন্ধসাতকানিয়ায় গৃহনির্মাণ সামগ্রী বিতরণ এম এ মোতালেবের