রাতভাঙ্গা ভোরের আলো উজ্জীবনের প্রথম প্রহর স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পত্রিকা দৈনিক আজাদীর প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর এই মাঙ্গলিক ক্ষণে অফুরন্ত অভিনন্দন জ্ঞাপন করছি। দৈনিক আজাদীর বর্ষপূর্তির এই দিনে পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা পরম শ্রদ্ধেয় ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল খালেক, পত্রিকার প্রাক্তন সম্পাদক অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ এবং প্রকাশকাল থেকে আজাদী পত্রিকার সাথে সংশ্লিষ্ট প্রয়াত কলমযোদ্ধা, সকল স্তরের কর্মকর্তা–কর্মচারী–হকারসহ সকলের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন এবং মহান স্রষ্টার কাছে তাঁদের আত্মার শান্তি কামনা করছি। সারারাত ধরে কলাকুশলীরা প্রতিদিনকার সম্পাদকীয়–সতেজ সংবাদ–নিবন্ধ–শিক্ষা–সংস্কৃতি–বিনোদন ইত্যাদির সমারোহে রজনীগন্ধার মতো সকালের প্রত্যাশায় ফুলের ডালা সাজিয়ে আলোর সূচনায় নন্দিত। প্রকাশের প্রথম দিন থেকেই দেশবাসী বিশেষ করে চট্টগ্রামের নগর–শহর–গ্রামীণ জনপদে ও সকল স্তরের জনগোষ্ঠীর দৃষ্টি উন্মীলিত হয় স্বকীয় ভঙ্গিমা–শৈলী–সত্তায় উদ্ভাসিত দৈনিক আজাদীর প্রতি পৃষ্ঠার প্রতিটি বাক্য–শব্দ চয়নে। এক কথায় দৈনিক আজাদী মানেই চট্টগ্রামের প্রথম প্রহর। দেশের প্রবেশদ্বার বাণিজ্যিক রাজধানী খ্যাত বন্দর নগরী চট্টগ্রাম শুধু বাংলাদেশ–ভারতবর্ষে নয়; পৃথিবী নামক এই গ্রহের প্রত্যেকটি অঞ্চলে অবস্থানকারী যেকোন বাঙালির হৃদয়ে প্রোথিত একটি নাম। চট্টগ্রামের সুপ্রাচীন ইতিহাস–ঐতিহ্যের সাথে জড়িয়ে আছে দৈনিক আজাদীর বর্ণালী অবগাহন।
ইতিহাস ও স্মৃতিতে পুরোধা স্মারক চট্টগ্রাম বিশ্বপরিমন্ডলে অত্যন্ত সুপরিচিত। চট্টগ্রামকে ঘিরে উল্লেখযোগ্য ঘটনাপঞ্জির মধ্যে রয়েছে– ১০ শতকে আরব বণিকদের চট্টগ্রাম আগমনের সূচনা, ১২৯১/৯২ খ্রিস্টাব্দে ইতালীয় পরিব্রাজক মার্কো পোলোর চট্টগ্রাম বন্দরে আসা, আনুমানিক ১৩৪০ খ্রিস্টাব্দে ফকরুদ্দিন মুবারক শাহের রাজত্বকালে সেনাপতি কদল খাঁ গাজী আরাকানিদের বিতাড়িত করে চট্টগ্রামে সর্ব প্রথম মুসলিম শাসন কায়েম, ১৩৪৫–৪৬ খ্রিস্টাব্দে আরব বিশ্বপর্যটক ইবনে বতুতার চট্টগ্রাম সফর, ১৭৬১ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রামে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক প্রথম কারখানা নির্মাণ, ১৭৭৪ খিস্টাব্দে ১২ জুলাই থেকে চট্টগ্রামে দাস প্রথা রহিতকরণ, ১৭৮৫ খ্রিস্টাব্দে বিখ্যাত প্রাচ্যবিদ স্যার উইলিয়াম জোনস’র চার মাস চট্টগ্রামে অবস্থান, ১৮৩৯ এর ২৪ ডিসেম্বর চট্টগ্রামে প্রথম গির্জা স্থাপন, ১৮৪১ খ্রিস্টাব্দে সবচেয়ে প্রাচীন ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সেন্ট প্লাসিডস স্কুল প্রতিষ্ঠা, ১৮৬৯ ও ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রামে যথাক্রমে প্রথম কলেজ ও মাদ্রাসা স্থাপন, ১৯০৬ সালের ২৭ নভেম্বর সাপ্তাহিক ‘পাঞ্চজন্য’ পত্রিকার আত্মপ্রকাশ, ১৯০৭ সালের ১৭ জুন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চট্টগ্রামে শুভাগমন, ১৯১১ সালের ১৫ আগস্ট চট্টগ্রাম সাহিত্য পরিষদ গঠন, ১৯১৮ সালে বঙ্গীয় মুসলমান শিক্ষা ও মওলানা আকরাম খাঁ’র সভাপতিত্বে সাহিত্য সম্মেলন, ১৯২৬, ১৯২৯ ও ১৯৩২ সালে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইমলামের চট্টগ্রাম সফর, ১৯২৮ সালে চট্টগ্রামে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তন, ১৯৫৪ সালের অক্টোবরে মাহবুব–উল আলম সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘জমানা পত্রিকার প্রকাশ, ১৯৬০ সালের ৫ সেপ্টেম্বর দৈনিক আজাদীর প্রথম প্রকাশ, ১৯৬৪ সালের ১০ এপ্রিল মুসলিম হলে কবিয়াল রমেশ শীলকে নাগরিক সংবর্ধনা প্রদান, ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে লালদিঘি ময়দানের জনসভায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ দফা ঘোষণা, ১৯৬৬ সালের ১৮ নভেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন, ১৯৭১ সালের ২৩–২৪ মার্চ সোয়াত জাহাজ থেকে পাকিস্তানি অস্ত্র নামানোর বিরুদ্ধে শ্রমিক জনতার রক্তক্ষয়ী প্রতিরোধ, ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র চালুসহ আরো বিপুল সংখ্যক ঘটনা প্রবাহে চট্টগ্রাম বিশেষ বৈশিষ্ট্যমন্ডিত।
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবনে উজ্জ্বল হয়ে আছে চট্টগ্রামের নাম। নজরুলের চট্টগ্রাম সফরের স্মৃতি চিহ্নিত হয়ে আছে তার ‘সিন্দু’, ‘বাংলার আজিজ’, ‘কর্ণফুলী’ প্রভৃতি কবিতায় এবং ‘সিন্দু হিন্দোল’ কাব্যগ্রন্থের উৎসর্গপত্রে। সাগর–নদী বিধৌত কর্ণফুলীর তীরে অবস্থিত চট্টগ্রাম নিয়ে রচিত ‘কর্ণফুলী’ কবিতায় কাজী নজরুল ইসলামের অসাধারণ অভিব্যক্তি সর্বত্রই স্মরণযোগ্য। কর্ণফুলী নদী নিয়ে লেখা তাঁর অনুপম কয়েকটি পংক্তি উপস্থাপন করা হল। ‘ওগো ও কর্ণফুলী! তোমার সলিলে পড়েছিল কবে কার কান–ফুল খুলি?/ তোমার স্রোতের উজান ঠেলিয়া কোন তরুণী কে জানে,/ ‘সাম্পান’ –নায়ে ফিরেছিল তার দয়িতের সন্ধানে?/ আনমনা তার খুলে গেল খোঁপা, কান–ফুল গেল খুলি,/ সে ফুল যতনে পরিয়া কর্ণে হলে কি কর্ণফুলী?’ চট্টগ্রাম শুুধুমাত্র বৃটিশবিরোধী আন্দোলনের সুতিকাগার হিসেবে মাস্টার দা সূর্যসেন–প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারসহ অন্যান্য শহীদ বিপ্লবীদের রক্তপিন্ডে উত্থিত নয়; বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার পটভূমি রচনায় মাতৃভাষা ‘বাংলা’ আন্দোলনের শহীদদের আত্মত্যাগের স্মরণে রচিত চট্টগ্রামের কৃতি সন্তান মাহবুব–উল–আলম রচিত কবিতাটি প্রথম ছাপানো হয় চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদী পত্রিকার কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস থেকে। এ পুস্তিকাটি ছিল একুশের প্রথম সংকলন। এই প্রেসের স্বত্বাধিকারী দৈনিক আজাদী পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক মরহুম আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের অনুমতিক্রমে তৎকালীন প্রেস ম্যানেজার দবির আহম্মদ চৌধুরী প্রচন্ড সাহসিকতার সাথে এই কবিতাটি ছাপানোর দায়িত্ব নেন। ফলস্বরূপ পাকিস্তান সরকার পুস্তিকাটি বাজেয়াপ্ত করে কহিনূর ইলেকট্রিক প্রেসের কাজ বন্ধ এবং দবির উদ্দিন সাহেব ছয় মাস কারাবরণ করেন।
উল্লেখ্য নির্ভীক–সাহসী স্বাধীনতা প্রেমিদের আত্মবিসর্জনের গৌরবগাঁথায় অভিষিক্ত চট্টগ্রামকে নিয়ে খ্যাতিমান কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য ‘চট্টগ্রামঃ ১৯৪৩’ শিরোনামে রচিত কবিতার কয়েকটি পংক্তি সম্মানিত পাঠকদের স্মরণে প্রবহমান করতে চাই– ‘ক্ষুধার্ত বাতাসে শুনি এখানে নিভৃত এক নাম-/ চট্টগ্রামঃ বীর চট্টগ্রাম!/ বিক্ষত বিধ্বস্ত দেহে অদ্ভুত নিঃশব্দ সহিষ্ণুতা/ আমাদের স্নায়ুতে স্নায়ুতে/ বিদ্যুৎপ্রবাহ আনে, আনে আজ চেতনার দিন।/ চট্টগ্রামঃ বীর চট্টগ্রাম।/ এখনো নিস্তব্ধ তুমি/ তাই আজো পাশবিকতার/ দুঃসহ মহড়া চলে,/ তাই আজো শত্রুরা সাহসী।/ জানি আমি তোমার হৃদয়ে/ অজস্র ঔদার্য আছে; জানি আছে সুস্থ শালীনতা / জানি তুমি আঘাতে আঘাতে/ এখনও স্তিমিত নও, জানি তুমি এখনো উদ্দাম– হে চট্টগ্রাম! …………… তোমার সংকল্পস্রোতে ভেসে যাবে লোহার গরাদ/ এ তোমার নিশ্চিত বিশ্বাস।/ তোমার প্রতিজ্ঞা তাই আমার প্রতিজ্ঞা, চট্টগ্রাম!/ আমার হৃদপিন্ডে আজ তারি লাল স্বাক্ষর দিলাম।।’
মহান মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ শহীদ ও দুই লক্ষ জননী–জায়া–কন্যার সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত মুক্ত মাতৃভূমির প্রথম সংবাদপত্র হিসেবে দৈনিক আজাদীর প্রকাশ একটি বিস্ময়কর ঘটনা। এটি শুধু দৈনিক আজাদী পত্রিকাকেই মর্যাদাসীন করেনি; বাংলাদেশে গণমাধ্যমের ইতিহাসে প্রতিশ্রুত অধ্যায় নির্মাণ করেছে। প্রাসঙ্গিকতায় ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশ ও বাঙালির প্রিয় অভিভাবক শ্রী প্রণব মুখার্জি মহোদয় যথার্থই বলেছেন, ‘অবিভক্ত ভারতবর্ষে স্বাধীনতা সংগ্রামে চট্টগ্রামের মানুষের একটি বিপুল ভূমিকা ছিল; ঠিক তেমনি বাংলাদেশকে স্বাধীন করার ক্ষেত্রেও চট্টগ্রামের ভূমিকা কোনো অংশে কম নয়। সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে স্বাধীন বাংলাদেশের বার্তা পৌঁছে দিয়েছিল কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র।’
বস্তুতপক্ষে সংবাদ মাধ্যম এবং সাংবাদিকতা সম্পূরক ও পরিপূরক এবং বহুমাত্রিক অর্থে প্রচলিত প্রত্যয় হিসেবে বিপুল সমাদৃত। যদিও সংবাদ পরিবেশনায় তথ্য সংগ্রহ–বিশ্লেষণ, সম্পাদনা ও প্রকাশ ইত্যদি প্রাচীনকাল থেকেই প্রায়োগিক বিষয়রূপে ঐতিহাসিকভাবে মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে নানা অনুষঙ্গের সাথে সম্পৃক্ত, প্রাচীন ভারতেও তার যথেষ্ট উদাহরণ রয়েছে। সম্রাট অশোকের আমলে বিভিন্ন আদেশ–নির্দেশ পাথর ও স্তম্ভে খোদিত হয়ে রাজ্যের সর্বত্র তথ্য বা প্রজ্ঞাপনরূপে প্রচারিত হতো। সে সময় দেশ–বিদেশ থেকে তথ্য সংগ্রহের কাজে গুপ্তচরও নিয়োগ করার প্রচলন ছিল। সুলতানি আমলে ‘বারিদ–ই–মামালিক’ (গোয়েন্দা কর্তৃপক্ষ) রাজ্যের তথ্য সংগ্রহ ও সরবরাহের দায়িত্ব পালন করতেন। সুলতান আলাউদ্দিন খলজির আমলে তা ছিল অধিকতর বিস্তৃত। মুগল আমলে ‘ওয়াকই–নবিশ’, ‘সাওয়ানিহ–নবিশ’ এবং ‘খুফিয়ানবিশ’ নামক সংবাদ নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠান হিসেবে সক্রিয় ছিল। এছাড়াও ‘হরকরা’, ‘আকবর–নবিশ’ নামে তথ্য সরবরাহের বিভিন্ন ব্যবস্থাও ছিল। সামাজিক, সাংস্কৃতিক খবরাখবর সরবরাহের জন্য ভাট, কথক ও নরসুন্দর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত।
সংবাদপত্রের ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, ১৫৬৬ সালে ইতালি ও ইউরোপের যুদ্ধ এবং রাজনীতির খবর প্রতি সপ্তায় পাঠকের নিকট পৌঁছানোর জন্য ভেনিসে হাতে লেখা সংবাদ প্রচার করা হতো। ১৬০৯ সালে জোহান ক্যারোলুসের উদ্যোগে জার্মান ভাষায় প্রকাশিত ‘রিলেশন’ নামে প্রথম ছাপা সংবাদপত্র বের হয় জার্মানি থেকে। আমস্টার্ডাম থেকে ১৬২০ সালে ইংরেজি ভাষায় প্রথম সংবাদপত্র প্রকাশ করা হয়। উন্নত দেশসমুহের মধ্যে ফ্রান্স ও আমেরিকায় সর্বপ্রথম পত্রিকা প্রকাশিত হয় যথাক্রমে ১৬৩১ ও ১৬৯০ সালে। বিভিন্ন বিজ্ঞ গবেষকদের উদ্বৃতি থেকে জানা যায়, আঠারো শতকে ইউরোপে আধুনিক সাংবাদিকতার সূচনা হলেও এ উপমহাদেশে মুদ্রন সাংবাদিকতা শুরু হয় জেমস আগাস্টাস হিকি কর্তৃক ১৭৮০ সালে কলকাতায় ‘হিকির গেজেট’ প্রকাশের মাধ্যমে। ১৮১৮ সালে জন ক্লার্ক মার্শম্যান সম্পাদিত ‘দিগদর্শন’, গঙ্গাকিশোর ভট্টাচার্য সম্পাদিত ‘বেঙ্গল গেজেট’ এবং ১৮৩১ ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের বাংলা ভাষায় প্রথম সাপ্তাহিক সাহিত্য পত্রিকা হিসেবে ‘সংবাদ প্রভাকর’ প্রকাশে বাংলা সাংবাদিকতার উন্মেষ ঘটে। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত ১৮৩২, ১৮৪৬ ও ১৮৪৭ সালে যথাক্রমে সংবাদ রত্নাবলী, পাষন্ড পীড়ন ও সংবাদ সাধুরঞ্জন নামে আরও তিনটি পত্রিকা বের করেছিলেন।
১৮৪২ সালে অক্ষয়কুমার দত্তের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ব্রাহ্মসমাজের মুখপত্র তত্ত্ববোধিনী। ১৮৪৬ সালে মৌলভী ফরিদুদ্দীন খাঁর সম্পাদনায় পঞ্চভাষিক সাপ্তাহিক ‘জগদুদ্দীপক ভাস্বর’ প্রকাশ পায়। রাজেন্দ্রলাল মিত্রের সম্পাদনায় ১৮৫১ সালে প্রথম সচিত্র মাসিক পত্রিকা ‘বিবিধার্থ সংগ্রহ’ এবং ১৮৫৪ সালে নারীদের জন্য প্রথম সাময়িকী ‘মাসিক পত্রিকা’ বের হয়। রংপুর জেলা কুন্ড্রী পরগনার জমিদার কালীচন্দ্র রায় চৌধুরীর অর্থায়নে পূর্ব বাংলার প্রথম সংবাদপত্র ‘রঙ্গপুর বাত্তাবহ’ প্রকাশিত হয় ১৮৪৭ সালে। আলেকজান্ডার ফর্বেসের সম্পাদনায় ঢাকার প্রথম ইংরেজি সাপ্তাহিক ‘ঢাকা নিউজ’ প্রকাশিত হয় ১৮৫৬ সালে। উনিশ শতকে প্রকাশিত পত্রিকাগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে– ১৯০৩ সালের সৈয়দ এমদাদ আলীর সম্পাদনায় মাসিক সাহিত্যপত্র ‘নবনূর’ এবং কলকাতা থেকে বের হওয়া মোহাম্মদ আকরাম খাঁর মাসিক ‘মোহাম্মদী’, ১৯১৮ সালে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীনের ‘মাসিক সওগাত’, ১৯১৯ সালে চট্টগ্রাম থেকে আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদ ও আবদুর রশীদ সিদ্দিকীর সম্পাদিত মাসিক ‘সাধনা’, কাজী নজরুল ইসলামের ‘নবযুগ’ (১৯২০), ‘ধুমকেতু’ (১৯২২) ও ‘লাঙল’ (১৯২৫), বুদ্ধদেব বসু ও অজিতকুমার দত্তের ‘প্রগতি’ (১৯২৬) ইত্যাদি।
প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ১৯৪৭’র দেশবিভাগ এবং পূর্ববাংলার রাজধানী ঢাকার উত্থান ইত্যাদি সাংবাদিকতার বিস্তারে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করে। ১৯০০–৪৭ সাল পর্যন্ত এ অঞ্চলে সংবাদপত্র শিল্পের বিকাশ নানা মাত্রিকতায় মুক্তবুদ্ধির চর্চা সীমিত হলেও তথ্য প্রবাহের গতিশীলতা ও মেধা–জ্ঞান সৃজন–বিতরণে অপরিমেয় অবদান অনিস্বীকার্য। উল্লেখ্য সময়ে বাংলায় ১৭৩টি সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়েছিল যার মধ্যে আনুমানিক ৬৫টি মুদ্রিত হয়েছিল পূর্ববঙ্গ থেকে। ভারত ভাগের পর উদ্ভুত পরিস্থিতিতে ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৪ সাল পর্যন্ত সংবাদপত্র ও সাময়ীকির সংখ্যা ১৬০ এ হ্রাস পায়। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বাংলাদেশে পত্রিকাগুলো ছিল রাজনৈতিক ব্যক্তি–দলের পৃষ্ঠপোষক। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বেশকিছু সংবাদপত্রের প্রকাশ বন্ধ থাকে এবং অনেক পত্রিকা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর তত্ত্বাবধানে চলে যায়। ১৯৪৭ সালে প্রকাশিত অর্ধ সাপ্তাহিক ‘জেন্দেগী’ পরবর্তীতে ১৯৪৭ সালের ৪ সেপ্টেম্বর দৈনিক পত্রিকার রূপ পরিগ্রহ করে। জনাব এস. এম. বজলুল হক সম্পাদিত এই পত্রিকার প্রকাশনা স্বল্প পরিসরে নিস্তব্ধ হওয়ার পর একই ঠিকানা থেকে দৈনিক সংবাদ প্রকাশিত হয়। ১৯৪৮ সালের ১৯ অক্টোবর মুসলিম লীগ ও পাকিস্তান সমর্থক দৈনিক আজাদ ঢাকা থেকে প্রকাশ শুরু করে।
১৯৪৯ সালের ১১ই মার্চ মুসলীম লীগ নেতা হামিদুল হক চৌধুরীর নেতৃত্বে ঢাকা থেকে প্রথম প্রকাশিত ইংরেজি দৈনিক ছিল পাকিস্তান অবজারভার। একই সালের ২০ মার্চ দৈনিক মর্নিং নিউজ কলকাতা থেকে ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়। ১৯৪৯ সালের গোড়ার দিকে মুসলিম লীগের চরম বিরোধীতা এবং আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে সাপ্তাহিক ইত্তেফাকের প্রকাশ উম্মীলিত হয়। পাকিস্তানের কথিত অখন্ডিত সুরক্ষায় সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে পত্রিকার কন্ঠরোধের অপচেষ্টায় ১৯৫৮ সাল থেকে ১৯৬১ সালে দৈনিক পত্রিকার সংখ্যা ১৮ থেকে নেমে এসে ১২টিতে অবস্থান নেয়। মহান মুক্তিযুদ্ধের সূচনাপর্বে ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে ছয়জন সংবাদকর্মীকে হত্যা করে দৈনিক দি পিপলস পত্রিকা ও পালাক্রমে ২৬শে মার্চ দৈনিক ইত্তেফাক অফিস পাকিস্তান হায়ানাদের আক্রমণে লন্ডভন্ড হয়ে পড়ে। মহান মক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য সাপ্তাহিক–পাক্ষিক গণমাধ্যম ও সংবাদ পত্র ছিল ‘জয় বাংলা’-‘রণাঙ্গন’-‘মুক্ত বাংলা’-‘স্বাধীন বাংলা’-‘নতুন বাংলা’-‘বাংলার বাণী’-‘বাংলাদেশ’-‘বিপ্লবী বাংলাদেশ’-‘দাবানল’-‘জাগ্রত বাংলা’-‘দেশ বাংলা’-‘বাংলার মুখ’-‘সংগ্রামী বাংলা’-‘মুক্তি’-‘অগ্রদূত’-‘সাপ্তাহিক বাংলা’-‘মুক্তিযুদ্ধ’– ইংরেজিতে ‘দ্যা নেশনস’-‘বাংলাদেশ’ ইত্যাদি (আর রাজী ঃ ২০১৬)
মূলতঃ গণমাধ্যম বিশেষ করে সংবাদপত্র, বেতার, টেলিভিশন, সামাজিক যোগাযোগ, স্যাটেলাইট সংস্করণ, ফেসবুক, ইন্টারনেটসহ ভিন্নধর্মী ক্রমবর্ধমান উপকরণসমূহ ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরিতে কতটুকু জনপ্রত্যাশা পূরণ করতে পারছে – তা নিয়ে সমুদিত সংশয় অত্যধিক প্রবল। সময়ের জোরালো দাবি – গণমাধ্যমের সত্যনিষ্ঠ লেখনি, প্রতিবেদন, সম্পাদকীয়, উপ–সম্পাদকীয়, মনন–সৃজনশীল কর্মযজ্ঞ তারুণ্যের অদম্য সক্ষমতার অবগাহনে এক আধুনিক যুগের ব্যাবর্তন সংস্কৃতির উৎসমূলে থাকবে এবং প্রতিটি সভ্য জাতিগোষ্ঠীতে সুশাসনের সংসর্গ প্রতিস্থাপন করবে। গণমাধ্যম সুশাসন প্রতিষ্ঠায় একনিষ্ঠ ব্রতী হয়ে প্রবর্তমান অনুন্নয়নের উন্নয়ন নয়; বরং গণউন্নয়নের উন্নয়ন সংস্কৃতিকে জাগরিত রাখবে। গণবিচ্যুত গণমাধ্যম অপসংস্কৃতির নষ্টধারাকে বিশ্বময়তাদানে উন্নয়নশীল বিশ্বকে কতটুকু নির্মমভাবে প্রভাবিত ও দুর্বৃত্তায়নের বন্ধনে আবদ্ধ করতে পারঙ্গম, সচেতন বিশ্বজনীন মানবতাবাদি বিবেকবান মানুষের বোধে তা অত্যন্ত সুস্পষ্ট। উল্লেখ্য সকল নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিকে সংহার করে দৈনিক আজাদী স্বমহিমায় অগ্রগণ্য থেকে অধিকতর পাঠকনন্দিত হোক। দৈনিক আজাদী বিকাশমানতায় সর্বক্ষেত্রে জয়ী থাকুক এবং দেশবাসীর প্রত্যাশা পূরণে অসীম সাহসিকতায় এগিয়ে যাক – প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর শুভকামনায় স্রষ্টার কাছে এটুকুই প্রার্থনা। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের দ্বিতীয় প্রধান সম্মাননা সাংবাদিকতায় একুশে পদকপ্রাপ্ত বর্তমান আজাদীর সম্মানিত সম্পাদক সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তিত্ব জনাব এম এ মালেক, সাংবাদিক, পত্রিকা সংশ্লিষ্ট সকল কর্মকর্তা–কর্মচারী, সম্মানিত পাঠক বিশেষ করে তরুণ পাঠকদের প্রতি অজস্র অভিনন্দন এবং আজাদী পত্রিকার অদম্য অগ্রযাত্রার শুভ কামনা করছি।
লেখক: শিক্ষাবিদ, সাবেক উপাচার্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।