পৃথিবীতে মানুষ জন্মে আবার একটা সময়ের পরে মারাও যায়। এটা বিধির বিধান। এর মধ্যে কিছু মানুষ থাকেন যারা মৃত্যুর পরেও মানুষের মনে জাগরুক থাকেন। আবার অনেকেই থাকেন না। পৃথিবীতে এমন কিছু কাজ থাকে যা করে গেলে মানুষ যুগের পর যুগ স্মরণীয় হয়ে থাকেন। এর মধ্যে সাধারণভাবে যদি কোন বীধসঢ়ষব দিতে হয় তা হলে বলা যায়, যারা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন তারা বারবার স্মরণীয় হয় কমপক্ষে স্কুলের শিক্ষার্থীদের খাতার মাধ্যমে বা প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমের মাধ্যমে। আবার আর কিছু বিষয় থাকে যা মানুষকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম ধরে স্মরণীয় করে রাখে তা হচ্ছে সংবাদপত্র প্রকাশ। আবার কবি সাহিত্যিকেরাও প্রজন্ম প্রজন্ম ধরে মানুষের মনে থাকেন তাদের লেখনির কারণে-যা পরবর্তী প্রজন্মকে দিক নির্দেশনা দিয়ে থাকে। তেমনি একজন মানুষ হচ্ছেন ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক। তাঁর প্রকাশিত দৈনিক আজাদী প্রকাশের মাধ্যমে তিনি চট্টগ্রামের আপমর জনগোষ্ঠীর কাছে একজন নমস্য এবং কর্মবীর হিসাবে স্মরণীয় হয়ে আছেন। দৈনিক আজাদীর কথা বলতে গেলেই অবশ্যই যার নামটি প্রথমে উচ্চারিত হতে হয় তিনি “আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার”। ১৯৬০ সালের ৫ ই সেপ্টেম্বর দৈনিক আজাদী প্রকাশিত হয় চট্টগ্রাম থেকে। আবদুল খালেক সাহেব ছিলেন এক ধর্মপ্রাণ মানুষ। আন্দরকিল্লা মসজিদে সকালে নামাজ পড়তে গিয়ে তিনি দেখেন বেশ কিছু লোক ভোরে ভোরে আন্দরকিল্লাহ জামে মসজিদের সামনে বসে পড়তেন সাহায্য পাবার আশায়। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব পত্রিকা বের করার আগে থেকেই তাদের সাথে কথা বলেন। তিনি বলেন তোমাদের অনেকেই আছ কিছু কাজ করে খেতে পার। তোমাদের একটা কাজ দেব। তোমরা সেটা করলে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে ইজ্জতের সাথে সমাজে চলতে পারবে। তিনি তাদের নিয়ে কয়েক দফা বৈঠক করে পত্রিকা বিক্রির কাজে নিয়োগ করেন। প্রায় দশ/বার দিন পত্রিকা বিক্রির টাকা না নিয়ে তিনি বললেন, তোমাদের কাছে ত আমি কিছু টাকা পাব তাই না? সবাই সমস্বরে হ্যাঁ সূচক জবাব দেন। তিনি বলেন, তোমাদের কাছে যা টাকা পাব এই টাকা আমি নেব না। এটা তোমাদের ক্যাপিটেল। এরপর থেকে যারা পেপার নেবে তাদেরকে টাকা দিতে হবে। এই কথা শুনে সবাই খুশিতে আত্মহারা। সেই সময়ের এক এক জনের কাছে পাওনা ২০-৩০ টাকা মানে অনেক টাকা। এইভাবে তিনি এক হকার গ্রুপ তৈরি করেন। যাদের অনেকে বংশ পরম্পরায় এখনো এ কাজটি করছে। ইঞ্জিনিয়ার আন্দরকিল্লাহ বাসায় থাকতে বাজার করতেন টেরিবাজারে। সকালে বাজার করতে যাবার সময় তিনি বেতের তৈরি ঝুড়িতে করে বেশ কিছু পত্রিকা নিয়ে যেতেন। বাজারে ঢুকার আগে তিনি দোকানের কাঠের তৈরি দরজার ফাঁক দিয়ে পত্রিকা ঢুকিয়ে দিয়ে মানুষের পত্রিকা পড়ার অভ্যাস তৈরি করেছিলেন।
দৈনিক আজাদী বের করার দুই বছরের মধ্যে ইঞ্জিনিয়ার সাহেব ইন্তেকাল করেন। এর পর সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ। তাঁর মৃত্যুর পর এখন সম্পাদকের দায়িত্বে আছেন ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের একমাত্র সন্তান এম.এ মালেক। ষাটের দশকের প্রথম দিকে এম.এ. মালেক কলেজে পড়াকালীন সময়ে প্রত্যেক দিন সকালে সাইকেল চালিয়ে আজাদী পৌঁছে দিতেন তার আত্মীয়দের বাসায়। এইভাবে তিলে তিলে তাদের শ্রমের বিনিময়ে দৈনিক আজাদী দেশের সর্বাধিক প্রচারিত একটি আঞ্চলিক পত্রিকা হিসেবে স্থান করে নিয়েছে। দৈনিক আজাদী বের করার আগে ইঞ্জিনিয়ার সাহেব কোহিনূর নামে একটি ম্যাগাজিন বের করেছিলেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেসও বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরীর লেখা কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি কবিতাটি কোহিনূর প্রেসে ছাপিয়ে ’৫২ সালে লালদীঘির মাঠে প্রচার করে বাংলা ভাষা আন্দোলনে জোরদার ভূমিকা পালন করে। এ জন্য কোহিনূর প্রেসের সে সময়কার ম্যানেজার দাবির উদ্দিনকে ছয় মাসের কারা ভোগ করতে হয়।
৬০ এর দশকের ১২ ই নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড়ে চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন থানা যখন লন্ডভন্ড হয়ে যায় তখন দেনিক আজাদীর রিপোর্টগুলি প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। অনেক সময় ঢাকার পত্রিকার সাংবাদিকেরা দৈনিক আজাদী অফিসে টেলিফোন করে খবরা-খবর নিয়ে তা ইত্তেফাক, আজাদ, সংবাদ, অবজারভার এবং মর্নিং নিউজে ছাপানো হত। (সূত্র অধ্যাপক মোঃ খালেদ)
ষাটের দশকের ছাত্র আন্দোলন, ’৬৬ এর ছয় দফা আন্দোলন, ’৬৮-’৬৯ এর গণ আন্দোলনে দৈনিক আজাদী বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এছাড়া ’৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষে গণজাগরণ সৃষ্টির ক্ষেত্রেও ভূমিকা পালন করে দৈনিক আজাদী।
স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বাংলা দৈনিক হিসাবে স্বীকৃত দৈনিক আজাদী বিভিন্ন ক্রান্তিকালে দৈনিক পত্রিকার পাশাপাশি অতিরিক্ত বুলেটিন বের করে জনগণের তথ্য প্রাপ্তিতে সহায়তা করে। চট্টগ্রামের সার্কিট হাউসে জিয়াউর রহমান মারা যাবার পর ঐদিন একটি দুই পৃষ্ঠার বুলেটিন বের করা হয়। কয়েক হাজার বুলেটিন নিমিষেই হট কেকের মত বিক্রি হয়ে যায়। ’৮৮ সালের ২৪ শে জানুয়ারি চট্টগ্রামে নির্বিচারে গুলি করে প্রায় ত্রিশ জনের উপর রাজনৈতিক কর্মীকে হত্যার প্রতিবাদেও বিশেষ ক্রোড়পত্র বের করা হয়। ’৯০ এর গণ আন্দোলনে দৈনিক আজাদীর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত প্রশংসনীয়। স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত জনগণের দাবি দাওয়া প্রতিষ্ঠা এবং চট্টগ্রামের ন্যায্য অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে আজাদী কোনো সময় পিছপা হয়নি। যার কারণে দৈনিক আজাদী গত ৫ ই সেপ্টেম্বর ’৬২ বছরে পদার্পণ করার গৌরব অর্জন করেছে।
দৈনিক আজাদীর কিছু কিছু হেডিং মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করত। যেমন ’৬৮ সালে তৎকালীন জাতীয় সংসদের স্পিকার ফজলুল কাদের চৌধুরীকে লালদীঘির মাঠে জনগণ পঁচাডিম মারতে শুরু করে তিনি অনন্যেপায় হয়ে ডাক দিলেন ‘শুক্কুয্যা গন্ডেরে’ শুক্কুর নামে চট্টগ্রামে একজন ‘গুন্ডা’ ছিল এবং সে ফজলুল কাদেরের ভক্ত ছিল। ওই সময় দৈনিক আজাদী ওই হেডিং পাঠকদের মজা দিয়েছিল। চট্টগ্রাম রেল স্টেশনে (পুরানো)এর সামনে একটি সাইনবোর্ড দেয়া হয়েছিল আজাদীর পক্ষ থেকে। এতে লেখা ছিল ‘আইয়ুন জে’ অর্থাৎ চট্টগ্রামে আপনাকে স্বাগতম। এর পর দেশের অর্থনীতিবিদ ও গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা যখন নোবেল পুরস্কার পান তখন দৈনিক আজাদীতে প্রধান হেডিং দেয়া হয়েছিল “আঁরার ইউনুস নোবেল পাইয়্যে” অর্থাৎ আমাদের ইউনুস নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। এই হেডিংও পাঠকদের আকর্ষিত করেছিল।
আমি আজাদীতে কাজ করার সময় অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ সাহেব মাস দুই মাস অন্তর আমাদেরকে নিয়ে বসতেন। তখন আমরা প্রশ্ন তুলতাম দৈনিক আজাদীর তার স্থান থেকে সরে একটু আধুনিক হবার চেষ্টা করে না কেন? এজন্য আমরা হাটহাজারী, রাউজান, বাঁশখালী, সন্দ্বীপসহ বিভিন্ন উপজেলার নাম জানা আজাদী প্রতিষ্ঠানগুলির সংবাদ না দিয়ে বেশি করে খেলার নিউজ, বিদেশি বা জাতীয় নিউজ দেয়ার জন্য বলতাম। তখন খালেদ সাহেব বলতেন, “কাউয়া মইয়ুর সাজিবার চেষ্টা গড়ি লাভ নাই।” আমরা আঞ্চলিক পত্রিকা। আমাদের এই ধারা বজায় রাখতে হবে। ঢাকার পত্রিকা চট্টগ্রামের গ্রাম-গ্রামাঞ্চলের খবর ছাপায় না। আমরা এই জনপদের খবর না ছাপালে কারা ছাপাবে। আমাদের চট্টগ্রাম এবং আশপাশের জেলাগুলো নিয়ে থাকতে হবে। আমাদের পাঠক কি চায় তা বুঝতে হবে। পরবর্তীতে আমরা সত্যিকারভাবে বুঝতে পেরেছি কেন এক সময় দৈনিক আজাদী জাতীয়ভাবে শ্রেষ্ঠ আঞ্চলিক পত্রিকার পদক পেয়েছিল। আমরা দেখছি দেশের অনেকগুলো পত্রিকা সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারেনি বলে বেশী দিন টিকতে পারেনি। এটা জাতীয় পত্রিকার ক্ষেত্রে যেমন দেখা যায়, তেমনি চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত পত্রিকার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
দৈনিক আজাদী এখন ৬২ বছর বয়সে পদার্পণ করেছে তার স্বকীয়তায়। সাধারণ পাঠকের মন জয় করতে যা যা প্রয়োজন তা করেছে সময়ে। এর উত্তরোত্তর সাফল্য কামনা করি চট্টগ্রামের উন্নয়নের লক্ষ্যে। চট্টগ্রাম দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। এর মর্যাদা রক্ষায় আজাদী এগিয়ে যাবে এ প্রত্যাশা রইল।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক