দেশ হতে দেশান্তরে

সেলিম সোলায়মান | রবিবার , ৩০ অক্টোবর, ২০২২ at ১০:৪৪ পূর্বাহ্ণ

রোদ থাকুক না থাকুক হয়েছে সকাল : ১

সুনসান নীরবতার মধ্যে সামান্য শব্দকেও সম্ভবত ঘুমন্ত কান আমার ঢাকের বাড়ি বলে বিবেচনায় নেয়। তদুপরি ঘুমন্ত কানে শব্দ যাওয়ার পরও নাক ডেকে ঘুমানোর মতো কুম্ভকর্ণও তো আমি নই। যদিও যাই হচ্ছে কাজ রুমে হচ্ছে অতি সন্তর্পণেই, তারপরও সুটকেস খুলে এটা ওটা নামানোতে গিয়ে যে মৃদু খুট খাট শব্দ হয়েছে, তাতেই ঘুম চটে গেছে।

হঠাৎ করে যাকে বলে কাঁচাঘুম, তা যদি চটে যায় তাতে মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে যায় সাধারণত আমার। অবশ্য মেজাজের অবস্থা আমার যাই হোক, আর তা যাকেই দেখানো যাক না কেন, এই ভোরে স্ত্রীকে দেখানোর মতো দুঃসাহসী আলেকজান্ডার নেপোলিয়ন স্বামী তো আমি নই। তদুপরি আসলে তেমন খারাপও লাগছে না হঠাৎ এই ঘুম ভেঙে যাওয়াতে। মনে হচ্ছে যতোটুকুই ঘুম হয়েছে রাতের শেষ দিকে এসে হলেও তা সম্ভবত বেশ গাঢ় ও গভীর ছিল। ফলে কাঁচা ঘুম ভেঙে যাবার মতো অস্বস্তি নেই দেহে ও মনে। গতরাতে আমাদের দুজনের মাঝে জায়গা নেয়া ঘুমন্ত অভ্রর নড়াচড়ায় গোটা রাতে বেশ ক’বার ঘুম ভেঙে গিয়েছিল, তবে অন্যান্য সময়ের চেয়ে ব্যতিক্রম হিসাবে প্রতিবার ঘুম ভাঙার পর পুনরায় ঘুমানোর জন্য হাঁসফাঁস করতে হয়নি তেমন গতরাতে। হয়তো গতকাল সেই সকাল থেকে শুরু করে রাত প্রায় ন’টা সাড়ে ন’টা পর্যন্ত বেইজিংহিমের মোকাবেলা করতে করতে যে ঘুরে বেড়াতে হয়েছিল, তাতে ভালই ধকল গিয়েছিল শরীরে। ক্লান্ত দেহটি তাই পুত্রের নড়াচড়ায় ঘুম ভেঙে জেগে উঠলেও, দ্রুতই পুনরায় তা ঘুমসাগরে তলিয়ে গিয়েছিল নিসাড় হয়ে। গত ৬/৭ ঘণ্টার টুকরো টুকরো সেই ঘুমগুলোকে জোড়া দিলে বলতে হয় অবশেষে চমৎকার একটি নকশিকাঁথাই বানানো গিয়েছিল তাতে।

হঠাৎ এ সময়ে মাথার কাছে সুরেলা গলায় হাতফোন আমার তার উপস্থিতির জানান দিতেই, তড়িঘড়ি পাশ ফিরে পাশটেবিল হাতড়ে দু তিন বারের চেষ্টায় সেটির নাগাল পেতেই থামালাম তার গান, যাতে পাশে হাত পা ছড়িয়ে ঘুমে কাঁদা কাঁদা হয়ে থাকা অভ্র ঘুম না ভাঙে।

‘কী ব্যাপার, ভাঙলো নাকি ঘুম? আমি তো ইচ্ছে করেই লাইট জ্বালাইনি তোমার ঘুম ভেঙে যাবে বলে। তবে এখনই ঢুকবে না বাথরুমে কিন্তু। আমার রেডি হওয়া একটু বাকি আছে। থাকো শুয়ে, এ ফাঁকে কাপড় বদলে আসি’।

ঘুম একটু আগেই ভেঙেছিল। তবে সকাল হয়নি বলে মনে করে মটকা মেরে পড়েছিলাম, বললাম স্ত্রীর কথার উত্তরে। তবে সচতেনভাবেই চেপে গেলাম যে, লাইট না জ্বালালে কী হবে? সুটকেস খোলার খুটখাটেই তো ভেঙেছিল সেই ঘুম কবেই। অতএব বাকি কথাগুলো মাটিচাপা দিলাম মনেরই গোরে! অযথা কোন পাগলে এরকম সকালেই মারতে যায় নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল। স্বামীদের কখন কোনো কথার কি মানে হয় স্ত্রীদের কানে, এ তো মনোবিদ কেন এমনকি দেবতারাও জানেন না।
এদিকে নিজের জামাকাপড়গুলো নিয়ে বাথরুমের দিকে লাজু চলে যেতেই, শুয়ে শুয়ে বয়ে সয়ে হাত পা টান করে ওগুলো জড়তা ভাঙতে ভাঙতে ছাদ থেকে মেঝে পর্যন্ত লম্বমান হয়ে, রুমের ডান দিকটার এ মাথা ও মাথা জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকছে কি না কোনো আলোর রেখা, ঘাড় তুলে দেখতে চাইলাম।
নাহ চোখে পড়ল না তেমন কিছুই। অবশ্য পড়বেই বা কীভাবে। ঘুমানোর আগে তো আমি নিজেই জানালার ভারী পর্দা এমনভাবে টেনে দিয়েছিলাম যাতে কোনো আলো না এসে পরে বাইরে জ্বলতে থাকা কোনো বাতি থেকে, নিজেরই ঘুমের সুবিধার্থে। ফলে ঘুটঘুটে অন্ধকার গোটা ঘরটিকে জাপটে রেখেছে এখনও। তবে ঘড়ির না হাতফোনের এলার্ম বলছে বাইরে বেইজিংএর আকাশে সূয্যিমামা নিশ্চিত উঁকি দিয়েছেন। যদিও জানি না এখনও, গতকালকের মতো আজো ধোঁয়াশার চাদর ভেদ করে বেইজিংকে আলোকিত করতে ব্যর্থ হয়েছেন কী না সূয্যিমামা? নাকি এখনও আছে গোটা বেইজিংয়ের আকাশ ধোঁয়াশার ফাঁপরে মুখ ভার করে।

সে যাই হোক। কথা হচ্ছে ফুল ফুটুক আর না-ই ফুটুক তাতেও যেমন নাকি বাংলাদেশের বসন্তের কিছু যায় আসে না বলে বলেছেন কবি, তেমনি এই অকবি আমি ভাবছি এখন, সূর্যের আলো মানে রোদ আসুক আর না আসুক বেইজিঙয়ের বুকে, সকাল কিন্তু হয়েই গেছে।

সন্তর্পণে বিছানা ছেড়ে নেমে মেঝেতে বিছানো নরম কার্পেটের উপর দাঁড়িয়ে ডানে বাঁয়ে উপরে নীচে হাত পা নাড়িয়ে শরীর ঝুঁকিয়ে বাঁকিয়ে স্কুল জীবনের মতো একটু মিনিপিটি করে শরীরের জড়তা ভাঙতে গিয়ে টের পেলাম গত কয়েকদিনের ধকল একটু আধটু চিহ্ন রেখে গেছে নানান পেশিতে। অল্প স্বল্প ব্যথার মতো করছে। অবশ্য পাত্তা দেবার মতো কিছু না যেহেতু ওসব। তাই পাত্তা না দিয়ে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে তার বিশাল আয়তাকার চোখ ঢেকে রাখা দু ‘স্তরের পর্দার মধ্যে উপরের ভারী পর্দাটি দুদিকে ঠেলে সরিয়ে দিতেই পরের স্তরে থাকা ফিনফিনে সাদা নেটের পর্দার ওপাড়ে চোখ যেতেই চোখে চোখ রাখল বেইজিং এর ঘোলাটে সকাল।

রাস্তায় মানুষজনের চলাচল শুরু হয়েছে কি না, মানে এই হিমে এখনও বেইজিং আসলেই জেগেছে কি না, তা বোঝার জন্য, জানালার উপর ঝুলতে থাকা দ্বিতীয় স্তরের সেই সাদা নেটের পর্দাটি সরিয়ে এক্কেবারে জানালার পুরু কাঁচে নাক চেপে ধরে ডানে বাঁয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে রাস্তায় নজর ফেলে বুঝতে চেষ্টা করলাম। নাহ ১৫/১৬ তলার উপর থেকে নীচে তাকিয়ে রাস্তা ঢেকে রাখা নানান আকারের গাছ গাছালির ফাঁক দিয়ে খুব একটা বেশি নজরে এলো না তার। এখানকার রাস্তার পাশের গাছগুলো কোন জাতের গাছ কে জানে? এই শীতেও দেখছি একদম ঝাঁকড়া আছে বেশিরভাগগুলোই। চীরহরিৎ বৃক্ষ নাকি ওসব? কুনমিংয়ের হোটেল থেকে হেঁটে দিয়াঞ্চি লেইক অভিমুখে যাওয়ার সময় একরাস্তায় শীতে একদম ন্যাড়া হয়ে যাওয়া সারি সারি গাছ যে দেখেছিলাম, তেমন গাছও চোখে পড়ল দুয়েকটা। ঐরকমই একটা গাছের ফাঁক দিয়ে নজরে এলো এসময় একটা লম্বা লরিজাতের ট্রাক যাচ্ছে এগিয়ে হেলে দুলে দুলকিচালে। তবে সবচেয়ে ভাল মতো যা চোখে পড়ছে তা হলো, রাস্তার ওপাশের সেই ষাটগম্বুজ মাথা ওয়ালা ডাকসাইটে বিল্ডিংটা, দেখেছিলাম যেটি প্রথম রাতেই।

‘এই, যাও তুমি এবার বাথরুমে। আর যাওয়ার আগে পারলে ঐ রুমে ওদেরকে একটু ফোন করে দেখো উঠেছে কি না ওরা। দীপ্র তো সকালে উঠতে খুবই ঝামেলা করে’।

লেখক : ভ্রমণ সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধভালোলাগা- ভালোবাসা এক নয়
পরবর্তী নিবন্ধধ্বনিত হোক মননশীলতার মাঙ্গলিক শঙ্কনিনাদ