ধ্বনিত হোক মননশীলতার মাঙ্গলিক শঙ্কনিনাদ

কুমার প্রীতীশ বল | রবিবার , ৩০ অক্টোবর, ২০২২ at ১০:৪৪ পূর্বাহ্ণ

শিশুসাহিত্যের রাজধানী চট্টগ্রামে অতিসম্প্রতি অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ‘শেখ রাসেল ছোটদের বইমেলা ও শিশুসাহিত্য উৎসব’। উৎসবের বিশালতা এবং বহুমাত্রিকতা আবারও ‘চট্টগ্রাম সবার আগে’ গান্ধীজীর মন্তব্যের সত্যতা প্রমাণ করল। এ উৎসবের মাধ্যমে চট্টগ্রামে আবারও ধ্বনিত হলো মননশীলতার মাঙ্গলিক শঙ্কনিনাদ। এ উৎসব আবার আমাদের নতুন করে ভাবনার পথ অবারিত করে দিল।

এখন এদেশে মননশীলতার পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে। সমাজের রন্দ্রে রন্দ্রে সাম্প্রদায়িকতা, কুপমন্ডুকতা, সন্ত্রাস, দুর্নীতি, মাদক, অনৈতিকতা বাসা বেঁধে বিস্তার লাভ করেছে। সমাজ ও রাষ্ট্র আজ এসবে আকন্ঠ ডুবে আছে। ফলে পঁচাত্তর পরবর্তী প্রজন্ম বেড়ে উঠছে নানান সব পঙ্কিলতার মধ্যে। মাদক, কিশোর গ্যাং কিংবা টিকটকদের নানান সব দুঃসংবাদ আজ প্রিয় সন্তানের ভবিতব্য নিয়ে শঙ্কিত করে তুলছে। আজ উন্নয়নের অনেক মেগা প্রকল্প বাস্তবায়িত হলেও মননশীলতার রুদ্ধ কিংবা সংকীর্ণ পথ মুক্ত হচ্ছে না। আমরা যারা চাই, পঁচাত্তরের পনর আগস্ট ‘শিশু হত্যার বিক্ষোভে আজ কাঁপুক বসুন্ধরা’, তাঁরা সবাই যার পর নেই আশাহত হচ্ছি। কেউ মানুক আর নাই মানুক আজকের সব ধরনের অপকর্মের সূতিকাগার পঁচাত্তরের পনর আগস্ট। তখন থেকে দেশ উল্টোপথে চলা শুরু করে, আজও তা অব্যাহত আছে।

শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি একটি জাতির মননশীলতার প্রতীক। আজকাল আমাদের দেশে সেই মননশীলতার চর্চা নানাভাবে বাধাগ্রস্ত। এখন সব কিছু বাণিজ্যিক আবরণে বাধা পড়ে আছে। শিক্ষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার স্বতঃস্ফূর্ত আয়োজন এখন আর নেই। লেখাপড়া শিখে আমাদের সন্তানেরা আজকাল এক একজন বেনিয়া হতে চাচ্ছে এবং বেনিয়া হয়ে বেরিয়ে আসছে। সর্বত্র অর্থের সন্ধানে হানা দিচ্ছে। হাজার বছরের বাংলা কিংবা বাঙালিকে জানার চেষ্টা করছে না। আবার কেউ সে পথে হাঁটলেও উদ্দেশ্য কিন্তু বেনিয়া ভাবনা। ফলে মননশীল মানুষ তৈরি হচ্ছে না। আমরা সেই পঁচাত্তরের পনর আগস্ট পথ হারিয়ে বসে আছি। তাই বোধকরি চট্টগ্রামে ‘শেখ রাসেল ছোটদের বইমেলা ও শিশুসাহিত্য উৎসব’-এ শিশু সাহিত্যিক-সাংবাদিক রাশেদ রউফ একদিনের আলোচনার বিষয়বস্তু নির্ধারণ করেছিলেন ‘পথ খুঁজছে শিশুসাহিত্য’। বিষয়টিকে হেলাফেলা করার অবকাশ নেই। এটাকে দেশের বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে দেখার সময় হয়েছে। সময়টা এমনই প্রতিকূল যে, এখন বলা দরকার, শুধু শিশুসাহিত্য নয়, মননশীলতা চর্চার পথ খুঁজছে গোটা বাংলাদেশ।

চট্টগ্রামে ১৪ থেকে ১৮ অক্টোবর বাংলাদেশ শিশু সাহিত্য একাডেমী যে কাজটা করেছে, তা বহু আগে নিয়মিকভাবে জাতীয় পরিসরে করা দরকার ছিল খেলাঘর, কচি কাঁচার আসর কিংবা শাপলা কুঁড়ির আসর নামের জাতীয় সংগঠনসমূহের। একসময় সংগঠনসমূহ নিবিড়ভাবে মননশীলতার চর্চা করত। এসব কাজের জন্য তাদের দেশ-বিদেশে সুখ্যাতি ছিল। বিদেশে শিশু প্রতিনিধি দল নিয়ে যেত। লেখক, কবি সাহিত্যিকরা ছিলেন এসবের প্রধান পৃষ্ঠপোষক এবং সংগঠক। একটা সময় ছিল আমাদের শৈশবে, যখন আমরা এসব সংগঠনের সদস্য হতে পেরে গৌরববোধ করতাম। তখন আমাদের একটা জনপ্রিয় স্লোগান ছিল, ‘পাড়ায় পাড়ায় খেলাঘর, গড়ে তোল।’ এখন এসবের কিছু নেই। মনে হচ্ছে বাংলাদেশ আজ অবরুদ্ধ হয়ে আছে একদল আকাট মূর্খের বেড়াজালে। আমাদের দেশে শিশু একাডেমীসহ আরও কিছু সরকারি-বেসরকারি সংস্থা সক্রিয় আছে। কিন্তু এসবের তৎপরতা তৃণমূল পর্যায়ে তেমন প্রভাব ফেলতে পারছে না। ফলে জাগরণটা দেখা যাচ্ছে না। দিন বদলের সেই ক্রান্তিকাল এখনও আসন্ন নয়। শিশু হত্যা, ভ্রুণ হত্যার বিক্ষোভে আজও কেঁপে উঠছে না বসুন্ধরা। আজকের প্রজন্মের এসবে কোনো ভুক্ষেপও নেই। তাদের কাছে এসব কেবলই রাজনৈতিক বিষয়। মননশীলতার প্রশ্নে আজও আকাট মূর্খতা থেকে মুক্ত হতে পারছে না আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র। এমনই দুর্ভাগা দেশ, যেকোনো ইস্যু পেলেই আজ একটি আকাট মূর্খ গোষ্ঠী তোলপাড় শুরু কয়ে দেয়। গাজীর গানে গীত সেই অমর বাণী-‘নানান বরণ গাভীরে ভাই একই বরণ দুধ/ জগৎ ভ্রমিয়া দেখিলাম একই মায়ের পুত।’ দেশ সাম্প্রদায়িকতা, কুপমন্ডুকতার অতল গহবরে হারিয়ে যাচ্ছে। বেনিয়া তৈরির কারখানায় পরিণত হয়েছে গোটা দেশ। এর সূত্রপাত করেন জেনারেল জিয়াউর রহমান হিজবুল বাহার প্রমোদ তরী এবং সংবিধানে মাথায় ধর্মের বাণী সংযোজন করে। এরপর তাঁরই উত্তরসূরি জেনারেল এরশাদ রাষ্ট্রধর্ম করে কফিনের শেষ পেরেকটা ঠুকে দেন। তাই আজ আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করি, কারণে কারণে সাম্প্রদায়িকতা নামের বিষধর সাপের ছোবল। বিগত ৫০ বছরে সেই আকাট মুর্খতা বিনাশ হয়নি। কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। কারণ ধারাবাহিকভাবে মননশীলততার চর্চার পথ সুগম হয়নি। দিবসসমূহও বেনিয়াবৃত্তির আবরণে ঢাকা পড়ে গেছে।

যতীন সরকার বলেছেন, ‘লোকসংস্কৃতি হলো আমাদের শেকড়। লোকসংস্কৃতিই পারে মৌলবাদ-জঙ্গিবাদ ও সামপ্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে।’ কিন্ত এদেশে আকাট মুর্খ তৈরির অনেক কারখানা আর কারিগর থাকলেও মানুষ তৈরির কারখানা আর কুশিলবের বড়ই অভাব। মননশীলতার চর্চা কিংবা মুক্তিযুদ্ধের সেই চেতনা বিকাশের জন্য যে স্কুলিং এর প্রয়োজন তা আমাদের দেশে যথেষ্ট পরিমাণে নেই।

আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে মননশীলতার চর্চা কিংবা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কোনো প্রভাব নেই। যে দেশের শিক্ষকের নামে দুর্নীতির অভিযোগ উঠে, মাদ্রাসার শিক্ষকের নামে ধর্ষণের অভিযোগ আসে, সেদেশে আদর্শ শিক্ষা ব্যবস্থার প্রচলন অসম্ভব। সেখানে দেশপ্রেমিক নাগরিক সৃষ্টি হবে না। আমাদের দেশে এখনও একমুখী শিক্ষা চালু করা যায়নি। নাগরিকের মধ্যে দেশপ্রেম না থাকলে, শিশু-কিশোরদের মধ্যে মননশীলতার চর্চার সুযোগ না থাকলে, সৃজনশীল চেতনাবোধ জাগ্রত করতে না পারলে সৃষ্টিশীল মানুষেরা বারে বারে প্রতিহিংসার শিকার হবেন। এদেশের মানুষের মধ্যে জাতিগতভাবে দেশপ্রেম বিকশিত হয়নি, যতটুকু সাম্প্রদায়িকতা বিকশিত হয়েছে।
আজকাল বুঝার এবং বুঝানোর মতো তেমন মননশীল মানুষ নেই। তেমন পরিবেশও নেই। একটি মননশীল চেতনাকে ধারণ করে দেশ স্বাধীন হলেও এর চর্চা তেমনভাবে হয়নি। এ ব্যাপারে শিশু একাডেমিসহ শিশু সংগঠনগুলোর সক্রিয় ভ্থমিকা প্রত্যাশিত ছিল। নতুন প্রজন্মকে মননশীলতা চর্চার মাধ্যমে আকাট মুর্খতা থেকে রক্ষার উদ্যোগ নিতে পারে জাতীয় পর্যায়ে জাগরণমূলক কর্মসূচি; যেমনটি সম্প্রতি ‘বাংলাদেশ শিশু সাহিত্য একাডেমী’ করেছে। বলছিলাম শিশু একাডেমীর কথা। এ লেখা যখন লিখছি, তখনই জানলাম, শিশু একাডেমীর মহাপরিচালক হিসাবে যোগদান করছেন শিশু সাহিত্যিক আনজীর লিটন। খবরটা আনন্দের। কারণ আমি বিশ্বাস করি, এই সংকটটা তিনি উপলব্ধি করেছেন। মহাপরিচালক হওয়ার পর তাঁর সঙ্গে কথা বলে তেমনটিই মনে হয়েছে। তাছাড়া তিনি কদিন আগে চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত ‘শেখ রাসেল ছোটদের বইমেলা ও শিশু সাহিত্য উৎসব’-এর ‘পথ খুঁজছে শিশু সাহিত্য’ বিষয়ক আলোচনার মূল প্রাবন্ধিক ছিলেন। আশা করছি, তিনি উত্তাপটুকু উপলব্ধি করেছেন।

মানস গঠনের জন্য দরকার প্রয়োজনীয় আলো-হাওয়া-সামাজিকভাবে, রাষ্ট্রীয়ভাবে এবং পারিবারিকভাবে। তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত বই মেলা, সাহিত্য-সংগীত মেলা, লোকায়ত মেলা, শিল্প চর্চার পথ সুগম করতে হবে। আলোকিত মানুষ গড়ার কারখানা হিসাবে সুকুমার বৃত্তি চর্চার ব্যবস্থা থাকতে হবে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে। শিশু-কিশোরদের জন্য তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার পথ সুগম করে দিতে হবে। এই চর্চা একেবারে গ্রামীণ অবকাঠামো পর্যন্ত যেন আলোকিত করতে পারে, সে ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এসব কিছু মানস গঠনের কাজ সুগম করে। দেশব্যাপী শিশু-কিশোরদের মধ্যে গণজাগরণ গড়ে তোলার কাজ করতে হবে, যেমনটি চট্টগ্রামে ‘বাংলাদেশ শিশুসাহিত্য একাডেমি’ করেছে। তবেই একদিন, শিশু হত্যার বিক্ষোভে কেঁপে উঠবে বসুন্ধরা। এমনতর অনুভূতি জাগাতে হবেই হবে সব শিশুর মধ্যে। এটা একমাত্র জাতীয়ভিত্তিতে তৃণমূল স্তর পর্যন্ত শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি অর্থাৎ মননশীল চর্চার প্রসার ঘটানোর মাধ্যমে সম্ভব হবে। প্রতিটি শিশু-কিশোরের অন্তরে ধ্বনিত হতে হবে মননশীলতার মাঙ্গলিক শঙ্কনিনাদ। তবেই বাংলাদেশ ফিরে পাক মননশীলতা চর্চার সাহসী ঠিকানা। তৈরি হবে আলোকিত মানুষ। এ ব্যাপারে আমাদের পথ দেখিয়েছে, ‘বাংলাদেশ শিশুসাহিত্য একাডেমি’। সে পথে চললে হয়ত লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব হবে। অন্যতায় আগামীর বাংলাদেশ অন্ধকারে আরও বেশি নিমজ্জিত হবে।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক, নাট্যজন

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধযাদের ত্যাগে আজকের চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ